হাঁটুন, হাঁটলেই আপনি মহারাজা

ডাক্তার সুলতানা আলগিন
Published : 17 Feb 2013, 05:25 PM
Updated : 17 Feb 2013, 05:25 PM

হাঁটুন। আসুন আমরা হাঁটি। প্লিজ হাঁটুন। হাঁটলেই আপনি মহারাজা। প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটুন। খেয়ালে হাঁটুন। ঘরের মধ্যে হাঁটুন। বাজারে হাঁটুন। অফিসে এমাথা ওমাথা হাঁটুন। সুযোগ পেলেই হাঁটার চেষ্টা করুন। দিন বদলে যাচ্ছে। দুনিয়া বদলে যাচ্ছে। চিকিৎসাও বদলে যাচ্ছে। যে আরামের সন্ধানে টাকা কড়ি কামাতে এই জীবন মাটি;যে আরামের সন্ধানে কত পরিশ্রম; সেই আরাম এখন হারাম। যত বেশী বেশী আরাম তত বেশী ব্যারাম। ব্যারাম থেকে রেহাই চান;না,না হাসপাতালে যেতে হবে না; ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচের দরকার নেই। বিনা টাকায় বিনা খরচে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে চাইলে একদম হান্ড্রেড পারসেন্ট ফ্রি প্রেসক্রিপশন হল হাঁটুন। দিনে অন্তত ৩০ থেকে ৬০ মিনিট হাঁটুন। সুন্দর স্বাস্থ্যের গ্যারান্টি। টাকায় যারা সুখ খুজছেন তাদের বলছি এবার সময় এসেছে হাঁটায় সুখ খুঁজুন। এই সুখ নিয়ে আসবে নিরাময়।

ইদের পার্বনে ভ্রমণ ও দাতব্য চিকিৎসা শিবিরে গ্রামে গিয়েছিলাম। গিয়ে শুনলাম একজন মহান শিক্ষক এর কথা। একটা গ্রাম একটা জনপদকে বলতে গেলে ওই শিক্ষক আলোকিত করেছেন। অনেককে জিজ্ঞেস করলাম স্যারের নাম কি। তাকে নিয়ে এত শ্রদ্ধা তার নাম কি। নাম বলতে পারল না তেমন কেউ।সবার মুখে মুখে উপনাম। ঘোড়া পন্ডিত। কেু বললে বানানটা ঘোরা পন্ডিত। আশ্চর্য একজন গুনি মানুষের নাম ঘোরা বা ঘোড়া হবে কেন! এ কেমন তামাশা। পরে দেখলাম ওই উপনামের মধ্যেই মিশে আছে তার প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা। তিনি কখনও গাড়ি ঘোড়াতে চড়েন নি। তিনি হাটতেন। হেটে বাড়ির থেকে দুরে স্কুলে যেতেন। ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি যেতেন। লম্বা লম্বা পায়ে হাটতেন। স্কুলের জমি জমা নিয়ে কোন প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা;সরকারি দপ্তরে যেতে হবে । জেলা শহর সেই কত কত দুরে। আড়াই তিন ঘন্টার হাটার পথ। পন্ডিত স্যার হেটে যেতেন। সবসময় দুপায়ের গাড়িতে চলেছেন। হেটে আসতেন। স্যারকে কেউ দমাতে পারে নি। স্যার ছিলেন সব সময় সবল সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। বেচেছিলেন ১০২ বছর। রোগ ভোগে মরেন নি। কিংবদন্তি আছে মরেছিলেন ঘোষনা দিয়ে। সন্তান নাতি নাতকুরদের বলেছিলেন আয়ু আর নেই। এবার যেতে হবে। তারপর নাকি খেয়ে দেয়ে সুন্দরভাবে পরকাল যাত্রা করেছিলেন।
পন্ডিত স্যারের এই যে পরমায়ু; বিড়ি সিগারেট খেতেন না। বিড়ি সিগারেট তার চলাফেরার চৌহদ্দির মধ্যে কাউকে পান করতেও দিতেন। দেবেন কি ; কেউ তো সাহসই পেত না। স্যার লাখো ছেলে মেয়েকে মানুষকে মানুষ করেছেন। ওই জনপদের সবাই সেজন্য তার কাছে এখনও কৃতজ্ঞ। তারপরও দেখুন সবাই সবচেয়ে শ্রদ্ধার সাথে মনে রেখেছে তার হাটাকে। তাই নাম রেখেছে ঘোরা বা ঘোড়া পন্ডিত। আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই ওই জনপদের মানুষকে স্যার একটি বড় শিক্ষা দিয়ে গেছেন তার হাটার মধ্যে দিয়ে। হাটায় রয়েছে পরমায়ু। হাটায় তিনি পেয়েছিলেন পরমায়ু। এত বড় শিক্ষাকে মানুষ মনে রেখেছে তাকে ঘোড়া পন্ডিত বলার মধ্যে দিয়ে।

দিন বদলেছে। দিন বদলাচ্ছে। আমরা হাটা ছেড়েছিলাম। হাটতে চাই নি। হাটে গায়ের মানুষ। আমরা গাড়িতে চড়ছি। বিলাসবহুল গাড়ির ভিড়ে ঢাকাতে চলাই এখন দায়। গাড়িতে চড়া , না হাটা ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। এখন সেই দিন নেই। এখন চিন্তাধারা বদলাতে হবে। এখন হাটতে হবে। যত কম গাড়িতে চড়া; ততই উপকার। শরীর না টিকলে ঠুনকো আরাম আভিজাত্যর অহম দিয়ে কি হবে।
ধুমপানের কথাই ধরি না কেন!এক সময় সিগারেট ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। ছিল ফ্যাশন। সিনেমার নয়ক কি সুন্দর করে সিগারেট ধরিয়েছে; তা নিয়ে কত আলোচনা। এখন সিগারেট মানেই যেন ঘেন্না। অনেকেই ঘৃনা করেন ধুমপানকে। আগে শুনতাম স্বামী খুব স্টাইল করে পান করায় স্ত্রী খুব গর্বিত। হা হা। অনেক মেয়্রেও সিনেমায় টিনেমায় ধুমপান করত। এখন এসবই কদর্য দৃশ্য। ধুমপান এখন ইতরজনের প্রিয় নেশা। আমরা মানসিক রোগের চিকিৎসকরা ধুমপানকে আর দশটা বাজে নেশা থেকে আলাদা করে ভাবছি না। গাজা যেমন নেশা। সিগারেটও তেমনি নোংরা নেশা। সিগারেট কখনওই উত্তমের নেশা ছিল না। ইতর জন, মাস্তান ,খিস্তি করা কুলি;বখে যাওয়া তারুণ্য;হতাশ মানুষেরা আর দশটা বাজে নেশার মত সিগারেট পান করে থাকে। ধুমপানের চেয়ে সিগারেট ত্যাগ, ধুমপান না করা তারুন্যের সেরা ফ্যাশন হিসেবে , সেরা পরিচয় হিসেবে এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এখন তারুন্যের সঙ্গে ধুমপান মানানসই নয়। বরং তা নষ্ট তারুন্য; হতাশ যৌবনের দুর্দশাকেই তুলে ধরছে।

ভেবে অবাক হই গ্রামের সেই পণ্ডিত স্যার কত আগেই এই মহান আধুনিকতাকে তুলে ধরেছিলেন। তেমনি হাঁটাই হচ্ছে তারুণ্য ও দীর্ঘ জীবনের হাল ফ্যাশন। দেশী বিদেশী পত্রিকা ও বৈজ্ঞানিকদের গবেষণাতে পাচ্ছি হাঁটার উপকারের নানা তথ্য।

মার্কিন এক গবেষনা দল বলছেন হাঁটলেই পরমায়ু। হাঁটলে সুস্থ শরীর যেমন হাতের মুঠোয় তেমনি দীর্ঘ আয়ুও মিলবে বিনে অষুধে। বিনা পথ্যে। পথ্য ও অষুধ হিসেবে হাটাই যে মহার্ঘ্য।প্রতি সপ্তাহে মাত্র ৭৫ মিনিটের হাঁটা ২০ মাস পর্যন্ত আয়ুবর্ধন করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও ব্রিগহ্যাম উওমেন হাসপাতালের একটি যৌথ গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।

বিভিন্ন রকম শারীরিক কার্যক্রমের সঙ্গে দেহের ভর-সূচক বা বডি ম্যাস ইনডেক্স (বিএমআই) কতোটা পরিবর্তিত হয় এবং এ পরিবর্তন উন্নতির দিকে হলে কতোটুকু আয়ু বাড়ানো সম্ভব, তা নিয়ে গবেষণাকালে এ তথ্য বেরিয়ে আসে।

গবেষকদলের সদস্য আইমিন লি বলেন, "আমরা আবিষ্কার করেছি, কেউ যদি প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত ছোটখাটো শারীরিক কার্যক্রম করেন- যেমন ৭৫ মিনিট হাঁটা- তাহলে তিনি ৪০ বছরের পর অন্যদের তুলনায় ন্যূনতম ২০ মাস বেশি আয়ু পেতে সক্ষম"।

তবে আরও অধিক শারীরিক কর্মকাণ্ডের ফলে আয়ু আরও বাড়ানো সম্ভব বলে তিনি জানান।

লি বলেন, "যেমন, প্রতি সপ্তাহে ৪৫০ মিনিটের হাঁটা আপনার আয়ু সাড়ে ৪ বছর পর্যন্ত বর্ধিত করতে পারে। আমরা গবেষণা করে দেখেছি, স্বল্প, অধিক বা স্বাভাবিক, সব ওজনের মানুষের জন্যই এটি প্রযোজ্য।"

এ গবেষণায় সাড়ে ছয় লক্ষাধিক মানুষের ১০ বছরের স্বাস্থ্য রেকর্ড নিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এদের মধ্যে মাত্র ৮২ হাজার মানুষ উল্লিখিত বর্ধিত আয়ু শেষ হওয়ার আগে মারা যান।

ঘোড়া পণ্ডিত সেই আমলেই হাঁটতেন। হেটে হেঁটেই তিনি এলাকায় হয়েছেন নমস্য। তিনি বিড়ি সিগারেট সহ্য করতেন না। তিনি শতায়ু ছিলেন। প্রতিটি এলাকাতেই এমন কোন না কোন নমস্য ঘোড়া পণ্ডিত স্যার রয়েছেন। তারা তাদের জীবনাচরণে রেখে গেছেন সুস্থ জীবনের অমূল্য রহস্য। হাটা আর নেশা মুক্ত জীবন। আপনার আমার জন্যও নিশ্চিত করতে পারে পরমায়ু। সকল এলাকার সকল ঘোড়া পণ্ডিত স্যারকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।