ব্রেভ হার্ট: এক বীর নারীর মৃত্যু

ডাক্তার সুলতানা আলগিন
Published : 29 Dec 2012, 02:09 PM
Updated : 29 Dec 2012, 02:09 PM

দিল্লীর ওই তরুনীকে ব্রেভহার্ট বলতেই হবে। তার করুন মৃত্যু আমাদের সবার মনে এক মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা দিয়ে গেল।বেচে থাকার জন্য অশেষ আকুতি শেষে মরে গিয়ে সে প্রমাণ করে গেল সকল মরণই মরণ নয়- কিছু মৃত্যু হল মানুষের হিংস্রতা, পশুতা, সহিংসতার বিরুদ্ধে ভয়ংকর প্রতিবাদ। সে মরে গিয়ে আমাদের অপরাধী করে গেল। সে মরে গিয়ে নিজের প্রাণের বিনিময়ে জাগিয়ে গেল ভারত উপমহাদেশের সকল নাগরিককে। নাগরিক অধিকার , নাগরিক নিরাপত্তার ইস্যুতে সে উপমহাদেশের মানুষকে এই বার্তা দিয়ে গেল-আবার তোরা মানুষ হ। আর মানুষ হতে হলে সম্মিলিত নাগরিক অধিকার আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই। বিডি নিউজ২৪ এর প্রতিবেদন বলছে-মেয়েটি বাঁচতে চেয়েছিল

"ধর্ষণের পর সামাজিক হেনস্তার ভয়ে আত্মহননের নজির ভারতসহ উপমহাদেশে ভুরিভুরি হলেও দিল্লির ওই মেডিকেল ছাত্রীর প্রাণপণ চেষ্টা ছিল বাঁচার।

বাসে ধর্ষিত ওই তরুণী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাঁচার আকুতি তার পরিবারকে জানিয়ে যান বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

ধর্ষণের পর বাঁচার এই লড়াইয়ের জন্য ওই তরুণীকে 'ব্রেভহার্ট' অভিহিত করেছে ভারতের সংবাদ মাধ্যম। তার এই মৃত্যুকে 'বীরের মৃত্যু' আখ্যায়িত করেছেন দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিও।

গত ১৬ ডিসেম্বর ধর্ষণ ও মারধরের পর ২৩ বছরের ওই ছাত্রীকে তার বন্ধুসহ দিল্লির রাস্তায় চলন্ত বাস থেকে ফেলে দেয় কয়েকজন পুরুষ সহযাত্রী, যে সংখ্যাটি ৬ ছিল বলে দেশটির গণমাধ্যম জানিয়েছে।

মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম নিয়ে ১৩ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে শনিবার ভোরে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে মারা যান। উন্নত চিকিৎসার জন্য ২৭ ডিসেম্বর তাকে নয়া দিল্লি থেকে সিঙ্গাপুর উড়িয়ে নেয়া হয়েছিল।

সিঙ্গাপুরে নেয়ার আগে দিল্লির হাসপাতালে ছিলেন ওই তরুণী। সেখানে ১৯ ডিসেম্বর মা ও ভাইকে বেঁচে থাকার প্রবল আকুতি তিনি জানিয়েছিলেন বলে জি নিউজ জানিয়েছে।

দিল্লি হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সর্বাঙ্গে ব্যথা নিয়েও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দুইবার জবানবন্দি দিয়েছিলেন তিনি। ধর্ষণের ওই ঘটনা এবং ধর্ষণকারীদের বিস্তারিত বর্ণনাও দিয়ে যান তিনি।

ধর্ষণকারীদের যে বিচার চান, তাও ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেছিলেন ওই তরুণী।

ম্যাজিস্ট্রেটকে দেয়া ওই তরুণীর বিবৃতিকে 'সাহসী' আখ্যায়িত করেছেন সবদরজঙ্গ হাসপাতোলের চিকিৎসকরা, যেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।

মেডিকেলের ওই ছাত্রী ধর্ষিত হওয়ার পর ভারতজুড়ে আন্দোলন চলছে। বিক্ষোভসহ বহুমাত্রিক কর্মসূচি পালিত হচ্ছে দেশটিতে।

ধর্ষণের শিকার ওই ছাত্রী মারা গেলেও তার পরিবার চায়, তার এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হলেও ভারতের ভূমি যেন নারীদের জন্য নিরাপদ হয়। যেন আর কারো জন্য এই ধরনের পরিণতি না আসে।

ধর্ষণের এই ঘটনার জন্য বিতর্কিত মন্তব্য করে একদিন আগেই ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ছেলে অভিজিত মুখার্জি।

তবে রাষ্ট্রপতির মুখে ছিল ওই তরুণীর প্রশস্তি। ওই তরুণীর মৃত্যুর পর প্রণব মুখার্জি বলেন, "সে আমাদের প্রকৃত বীর।"

"মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সে যে লড়াই করেছে, তা বীরোচিত। সে ভারতের নারীদের প্রতীক।"

এই ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেজন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

যে রাজ্যে ওই তরুণী নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত বলেছেন, "মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এই ঘটনা আমার জন্য লজ্জার।"

ওই তরুণীর মৃত্যুর পর এখন পর্যন্ত সারা ভারতে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের খবর পাওয়া গেছে।"

মেয়েটি কাপুরুষ ছিলনা। মেয়েটি ভীতু ছিল না। মেয়েটি মরতে চায় নি। ভারতীয় গনমাধ্যমের নানা খবরে পড়েছি মেয়েটি শেষ পর্যন্ত বাচতে পেয়েছিল। জীবনের পথে ফিরে এসে ওই ভয়ংকর অপরাধের প্রতিবাদে শামিল হতে চেয়েছিল। আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা যে তাকে বাচানো গেল না।তাকে উপমহাদেশের এই সামাজিক নাগরিক আন্দোলনে শামিল পাওয়া গেল না।

তাকে শেষ সালাম জানাই। জানাই স্যালুট। হে নারী তোমার মৃত্যু নেই। যদি কোন দিন দক্ষিন এশিয়া তথা উপমহাদেশের এই দেশগুলোয় নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়- সেই অধিকার আদায়ের লড়াই য়ে তুমি অমর হয়ে থাকবে। তোমার নাম সূর্য়ের মত জ্বলজ্বল করবে।

'লড়াই না করে কোনোভাবেই হারব না'—

'লড়াই না করে কোনোভাবেই হারব না'—গত শনিবার পুলিশকে দেওয়া জবানবন্দিতে এমন কথা বলেছিলেন ভারতে গণধর্ষণের শিকার মেডিকেলের ছাত্রী। কিন্তু মৃত্যু তাঁর এ লড়াইয়ে বাদ সাধল। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে শনিবার স্থানীয় সময় ভোর চারটা ৪৫ মিনিটে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কেলভিন লোহ বলেছেন, 'শান্তিতেই মারা গেছেন তিনি। মৃত্যুর সময় স্বজন ও ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা তাঁর পাশেই ছিলেন।'
কেলভিন জানান, মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে আট সদস্যের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকদের একটি দল ওই তরুণীর চিকিত্সা করছিল। তবে শরীরে ও মস্তিষ্কে মারাত্মক আঘাতের কারণে তাঁর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে পড়ছিল। এ কারণেই তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হলো না। তাঁর মস্তিষ্ক, ফুসফুস ও তলপেটে গুরুতর জখম ছিল।

তাঁর মৃত্যু যেন বৃথা না যায়: মনমোহন সিং

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তৎক্ষণাৎ টুইটারে লিখেছেন, মেয়েটি মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে পরাজয় বরণ করে নিলো ঠিকই; কিন্তু তাঁর এ মৃত্যু যেন বৃথা না যায় তা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে। দিল্লী পুলিশের এক মুখপাত্র রাজন ভাগত টুইটারের মাধ্যমে জানান, নয়াদিল্লিতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। তবে এ ঘটনায় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের জন্য জনতার মঞ্চ ও রামলিলা ময়দান রয়েছে বলেও যোগ করেন তিনি। আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল ১১টার সময় জনতার মঞ্চে এক বিশাল প্রতিবাদ সভার ডাক দিয়েছেন। জি নিউজ ইন্ডিয়া

তাঁর সাহস ছিল সীমাহীন:সোনিয়া গান্ধী
ভারতের দক্ষিণ দিল্লিতে গণধর্ষণের শিকার সেই ছাত্রীর মৃত্যুতে থমকে গেছে ভারতবাসী। তাঁর মৃত্যুর পর দেশের ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, তাঁর সাহস ছিল সীমাহীন। মেয়েটি মারা গেলেও তাঁর সাহসের মৃত্যু নেই। খবর টাইমস অব ইন্ডিয়ার।
তিনি বলেন, 'আমার হূদয় আজ বেদনায় ভারাক্রান্ত। শুধু আমার নয়, পুরো ভারতবাসী আজ কাঁদছে। কারণ, ২৩ বছরের যে মেয়েটি আজ পৃথিবী থেকে চলে গেছে, আমাদেরই অনেকের ঘরে রয়েছে তারই মতো বোন বা কন্যা। ২৩ বছরের ওই মেয়ের জীবন ছিল সম্ভাবনায় উজ্জ্বল। তার সব সম্ভাবনা আজ শেষ হয়ে গেছে।'
সোনিয়া গান্ধী বলেন, 'একজন নারী ও মা হিসেবে আমি মেয়েটির পরিবারের মানসিক অবস্থা অনুভব করতে পারি।'
কংগ্রেসের সভানেত্রী বলেন, 'ধর্ষকদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। আমরা ও আমাদের প্রশাসন সর্বোচ্চ চেষ্টা করব দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার।' তিনি বলেন, ভারতে নারী নির্যাতন আজ একটি ভয়ংকর অবস্থায় পৌঁছেছে। সবাইকে একসঙ্গে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
১৬ ডিসেম্বর রাতে দক্ষিণ দিল্লিতে ২৩ বছর বয়সী ওই ছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হন। এরপর তাঁকে ও তাঁর ছেলেবন্ধুকে বেদম মারধর করে দুর্বৃত্তরা। বন্ধুটিকে রড দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয় এবং চলন্ত বাস থেকে তাঁদের ফেলে দেওয়া হয়। এরপর ওই ছাত্রীকে নয়াদিল্লির সফদরজং হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ১০ দিন চিকিত্সার পর অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় উন্নত চিকিত্সার জন্য তাঁকে ২৭ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে আজ স্থানীয় সময় ভোর চারটা ৪৫ মিনিটে মারা যান তিনি। তাঁর চিকিত্সার ব্যয়ভার বহন করছিল ভারতের সরকার।