শিক্ষকের শিক্ষক, তারও শিক্ষক!

হাবিব
Published : 7 August 2014, 05:16 PM
Updated : 7 August 2014, 05:16 PM

প্রায় ৯০ বছর বয়সী খলিলুর রহমান স্যার। কোন সাহায্য ছাড়াই পায়চারী করছেন, দেখছেন এদিক, ওদিক। অতিকায় বৃদ্ধ এ মানুষটিকে দেখে কেউ পা ছুয়ে সালাম করছেন, কেউ বুকে বুক মিলাচ্ছেন, বর্তমান প্রধান শিক্ষক জয়নাল স্যারও তার পায়ে সালাম করলেন এবং কাচু মাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন !

কিছুক্ষন পরে অনুষ্ঠান শুরু হবার আগে, আমি সাহস করে খুজতে লাগলাম সেই ২৫ বছর আগের আমাদের প্রধান শিক্ষক গিয়াস আহম্মদ স্যারকে। সকাল বেলা যখন অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে বের হই, তখন সাহস নিয়েই চিন্তা করেছিলাম সেই ছাত্রবেলার না জানা একটি শব্দ (বগধা বাঙাল) অর্থ আজ গিয়াস স্যারের কাছ থেকে জানবোই। ছাত্রবেলায় গিয়াস স্যারের ক্লাশে পিনপতন নিরবতা থাকতো। বাড়ি থেকে পড়ে আসলেও স্যারের সামনে কিছুই মনে থাকতো না। স্যার তখন মিট মিট করে হাসতেন। স্যারের সে হাসিটা মনে হতো হিংস্র বাঘের চেয়েও হিংস্র। স্যারকে দেখলে পড়া আর গতো না। বয়সের ভাড়ে স্যারের সামনের সারির নিচের দিকের একটি দাত উঠে গিয়েছিল। আর সে ফাক গলিয়ে মাঝে মাঝে চিহ্হবাটা মাঝে মাঝে বের হতো। সেটা দেখে মনে আরো ভয় লাগতো, মনে হতো, বিষধর একটা সাপ এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। স্যার যখন মিট মিট করে হাসতেন, উদ্দেশ্যটা তখন বুঝা হয়ে যেতো। ভুলে যাওয়া পড়া মনে করার বারবার ব্যার্থ চেষ্টা করতাম। হাতে একটি পেন্সিল নিয়ে অতর্কিত পেটের চামড়া ধরে ওই পেনসিল দিয়ে ডলতে ডলতে বলতেন, "বগধা বাঙাল" পড়া মনে থাকে না কেন ? আবার কাউকে ডান হাতের তিনটা আঙুল দিয়ে কানটা বিশেষভাবে ধরতেন এবং কানের মধ্যে একটা ভাজ হয়ে যেত। একটু চাপ দিতেই পটাশ করে ফুটে উঠতো……উহ, ভেঙে যাবার মত শব্দ, ব্যাথায় চোখে পানি এসে গেলেও চিৎকার করবার সাহস কারো নাই। তবে স্যারের শাসন যতটানা কঠোর ছিল, ভালোবাসতেন সন্তান তুল্য। সকাল বেলা বাসায় গেলে না খাইয়ে ছাড়তেন না। তবে খাবার সময়ো ভয়ে খাবার গলা দিয়ে নিচে নামতো না।

বর্তমান প্রধান শিক্ষক জয়নাল স্যার হাতে একটা কঞ্চির লাঠি নিয়ে ক্লাশে প্রবেশ করতেন। পড়াতেন অতি যত্নকরে। যতবার বুঝিয়ে চাইতাম, ততবারই বুঝিয়ে দিতেন। পড়ায় ফাকি দিলে মাফ পাওয়া যেতো না। লাঠির শব্দটি এখনকার দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার মতই।
সেই জয়নাল স্যারকে দেখলাম শীর্নকায় সে লোকটির সামনে বেশ কাচু-মাচু। বিষয়টা মজাই লাগছিল। এখনো এ বয়সেও গিয়াস স্যার, জয়নাল স্যার, হামিদ স্যার সহ অন্যান্য স্যারদের সামনে চেয়ারে বসার কথা ভাবতেও পারিনা। বাস্তবতায় দেখলাম আমার সে শিক্ষাগুরুর সেই শীর্নকায় লোকটি তাদের শিক্ষাগুরু খলিল স্যার !

আহ কি যে শিষ্ঠাচার। এ আনন্দের দিনেও চোখে পানি এসে গেলো। তবে গর্ববোধ করলাম, আমি এসব শিক্ষকেরই উত্তরসুরী শিক্ষকের ছাত্র ছিলাম।

যা বলছিলাম, গিয়াস স্যারকে সাহস নিয়ে খুজতে গিয়ে দেখলাম একিট সোফায় খলিলুর রহমান স্যার, গিয়াস স্যার, হামিদ স্যার অর্থাৎ এই তিনজন প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক বসে আছেন। সাহস করে সামনে যেতেই, গিয়াস স্যারের সেই চিরাচরিত হাসি, আমার সব সাহসকে মহুর্তে বিলুপ্ত করে ফেললো। কেন সেখানে গেলাম তাও ভুলে গিয়েছিলাম। হামিদ স্যার হাতটা ধরে সোফায় বসার জন্য বললেন ! সে সময় আমার কাছে মনে হলো, নিশ্চই বড় কোন অপরাধ করে ফেলেছি, নইলে স্যার পাশে বসতে বলবে, তাও আবার হাতটা ধরে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় আমি ধপাস করে তাদের পায়ের কাছে বসে পড়লাম। সেভাবেই সালাম করলাম তাদের। সহকর্মী ছোটভাই রাফিক আমার অবস্থা দেখে হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছে আর ছবি তুলছে একের পর এক। অনেক কষ্টে সেখান থেকে একটু দুরে এসে প্রানভরে নিশ্বাস নিলাম। বন্ধু মনোয়ার বললো, কিরে স্যারকে জিজ্ঞেস করলি, বগধা বাঙাল শব্দের অর্থটা কি ? না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললাম তোরা যা।

১৯১৪ সালের কোন এক শুভক্ষনে জমিদার বুদ্ধিনাথ কুলীক নদীর ধারে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন রানীশংকৈল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। আজ ২০১৪ সাল। শততম বর্ষপূর্তি পালন হলো। অনেক বন্ধু-বান্ধবীও এসেছে। প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থী মিলে প্রায় ২০ হাজার জনের উপস্থিতি।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন, সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম, সংসদ সদস্য ইয়াসিন আলী, সংসদ সদস্য সেলিনা জাহান লিটা, বিদেশে গবেষক হিসেবে কর্মরত ডক্টর আবুল হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রক্টর ডক্টর আমজাদ হোসেন, একটি এনজিওর পরিচালক ডক্টর শহীদ-উজ-জামান, ঠাকুরগাও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আখতারুজ্জামান সাবু সহ অনেক পদস্থ লোকজন।
সোফায় বসা তিনজন প্রধান শিক্ষকের সামনে দেখি ওই বাঘা বাঘা সংসদ সদস্যরাও কাচু-মাচু হয়ে আছেন। মুখ দিয়ে যেন তাদেরও কথা বের হচ্ছিল না। সংসদ সদস্যরাতো রীতিমত ঘামছিলেন। ভাবলাম সংসদ আর রাজপথে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছেন, গলাবাজি করছেন, এখন ওই তিনজনের সামনে এমন অবস্থা কেন ? তাদের দেখে আমার হাসি পেলেও দেখলাম আমার চেয়ে তাদের অবস্থা আরো খারাপ।

বন্ধুদের সাথে গলা মিলিয়ে বেশ খোসগল্প হলো। এভাবেই কেটে গেলো সারাটি দিন। স্মৃতিময় জায়গাগুলোতে সেই শৈশবের মতই ছুটে বেড়ালাম। এমন ছুটাছুটিতে দেখলাম মিজান স্যার লাঠি নিয়ে তেড়ে আসছেন না, তিনি অনেক আদর করেই কুশল বিনিময় করলেন। এমন শৈশব, পথচলা, সব স্মৃতি তবে সবই সুখ স্মৃতি। যদি রিমোর্ট কন্ট্রোল দিয়ে রিওয়াইন্ড করা যেত সেই শৈশব, তবে নিশ্চই বলে উঠতাম, এমন জীবন চাইনা, আমার সে শৈশবই ভালো।