পান্তা ইলিশ কেন? সেদ্ধ কচু খান…

হাবিব
Published : 13 April 2015, 05:26 PM
Updated : 13 April 2015, 05:26 PM

শতভাগ বাঙালিয়ানা দেখাতে পহেলা বৈশাখের রকমারি আয়োজনের কমতি থাকেনা বাংলাদেশের আনাচে কানাচে। শৈশবে বর্ষবরন সীমাবদ্ধ ছিল ১০ টাকার হাজার পাওয়ারী অথবা ৫শ পাওয়ারী নামের রঙের মধ্যে। গ্রামে গ্রামে নারী পুরুষ প্রায় সবাই একে অপরকে রঙ মাখাতে ব্যাস্ত থাকতো। এর পাশাপাশি নারী, পুরুষ মিলে নদী, পুকুর বা জলাশয়ে মাছ ধরতে যেন। দু-চার গ্রাম মিলে আয়োজন হতো কবিগান, পালাগান, ধামের গান সহ পুতুলনাচ। বসতো ১ দিনের জন্য মেলা। মেলায় রকমারি চুরি, মাটির তৈরী জিনিসপত্র, শাখা সিঁদুর-সব মিলে যেন সে মেলা গ্রাম বাংলার মানুষের মনের মেলা, মিলন মেলা। সে যেন আলাদা একটা বৈশিষ্ট আর বন্ধনে আবদ্ধ ছিল বাঙালি।
তখনো রাজধানীর সেই রমনা বটমূল, শিল্পকলা, টিএসসিতে আয়োজন হতো লোকজ সঙ্গিত, মঙ্গল যাত্রা। রমনা বটমূলে সমস্বরে গেয়ে উঠতো এসো এসো হে বৈশাখ…। এই বিংশ শতাব্দীতেও গ্রামীন সংস্কৃতির সেই বাংলা বর্ষবরন জাগ্রত রয়েছে। তবে বর্ষবরনের নামে অপসংস্কৃতির ছড়াছড়ি। এটা অনেক আনন্দের সংবাদ যে, ওপর তলার মানুষরা যোগদিতে শুরু করেছে বাঙালীর এই বর্ষবরনে। তারাও ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে নেচে গেয়ে বরন করে নিচ্ছে বাংলা নববর্ষকে।

তারপরেও কোথায় যেন একটা অপূর্নতা রয়ে গেছে। বর্ষবরনের আয়োজনে, খ্যাত বা অখ্যাত স্থান বা জেলা বা উপজেলা প্রশাসনের বর্ষবরন অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়েছে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ধুম। অসময়ের এই আবদার আর আহলাদে ইলিশের প্রজননের বারোটা বেজেছে, অন্যদিকে যে পান্তা বাংলাদেশে বসবাসকারী শতকরা ৮০ ভাগ কৃষক, কৃষি মজুরের সকাল বেলার প্রধান খাদ্য। সেই পান্তাকে তোলা হয়েছে নিলামে। নামী-দামী কোন পাত্রে সে পান্তার আয়োজন, অত:পর মাটির পাত্রে সাহেব বাবুদের মাঝে সেই পান্তা আহারের পরিবেশন গ্রামীন মানুষকে কটাক্ষ বা লজ্জা দেবার মতই অবস্থা।

বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ন হলেও, এখনো গ্রামীন কৃষক, কৃষি মজুর মাসের ৩০ দিনে ৯০ বেলার আহার জোটাতে পারেনা। কখনো কখনো ভদ্রলোকদের শখের এই পান্তা কৃষি মজুর বা কৃষককে দিনভর খেতে হয়। কৃষক বা কৃষিমজুর, দিনমজুর এই পান্তা খেতে মোটেই আপত্তি করেনা। কারন একদিকে পান্তার সাথে, সামান্য তৈল, পেয়াজ ও মরিচ হলেই পান্তা খাওয়া যায়। অনেকেই এই পান্তাকে আরো সুস্বাদু করার জন্য, শুকনা মরিচ পুড়িয়ে ভর্তা করে অথবা সিদোল বা শুটকি ভর্তা দিয়ে খায়। কৃষক, কৃষি মজুর বা দিনমজুর অতিতৃপ্তি সহকারে এই পান্তা খেয়ে একটা তৃপ্তির ঢেকুর তোলে, তারপরে আবার নেমে যায় কাজে।

এই পান্তাভাত গ্রামীণ সমাজের প্রচলিত সকালের নাস্তা হলেও, কৃষক, কৃষি মজুর বা দিনমজুরগন একটু বেশি আয় করলেই সকালের নাস্তায় পান্তার পরিবর্তে গরমভাত বা অন্য কিছু যুক্ত হয়। অর্থাৎ এই গ্রামীন মানুষগুলো একান্ত আয় কম হবার কারনে পান্তা খেয়ে জীবন বাচানোর চেষ্টা করে। এই পান্তাকে তারা কখনো বিলাসিতার খাদ্য হিসেবে গন্য করেনি কখনো।

তথাকথিত ভদ্র সমাজের বাংলা বর্ষবরন আয়োজনের অন্যতম একটি উপাদান হলো, পান্তা ইলিশ খাওয়া। কয়েকটি গ্রামের সহস্রাধিক পরিবারে সমীক্ষা চালিয়ে জানা গেছে, গত ৬ মাসে তারা একদিনের জন্যও পরিবারের খাদ্য তালিকায় ইলিশ যুক্ত করতে পারেনি। গ্রামের নদী, জলাশয় থেকে এই গ্রামের মানুষরা শোল, বোয়াল, মাগুর, কৈ সহ নানাবিধ মাছ ধরতে সক্ষম হলেও নিজেরা তা খেতে পারে না। বাবুদের চাহিদা অনুযায়ি এক কেজি মাগুর মাছের দাম ৮শত টাকা। এক কেজি শোল মাছের দাম ৬শত টাকা বা বোয়াল এক কেজির দাম ৬শ টাকা। অথাৎ এই এক কেজি মাছের দাম তাদের তিন অথবা ৪ দিনের মজুরির সমান। আর গ্রামের কোন হাট বাজারে মাছ বিক্রেতারা সিলভার কার্প, পাঙ্গাস, রুই, কাতলা, সমূদ্রের কিছু কমদামী মাছ বিক্রি করতে আনলেও গত এক বছরের মধ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোন গ্রাম্য বা কোন নামীদামী বাজারে ইলিশ মাছ বিক্রি করতে আনেনি কোন মাছ ব্যবসায়ি। কারন একটি মাঝারি বা ছোট সাইজের ইলিশের দাম একজন কৃষি মজুরের ১০ থেকে ১২ দিনের মজুরির সমান।

বাঙালির বাংলা বর্ষবরণ একটা প্রানের উৎসব। বাঙালিয়ানার সকল সংস্কৃতি জিইয়ে রাখতে এমন উৎসবের কোন বিকল্প নাই। তারপরেও এই পান্তা ইলিশ বর্ষবরনে যুক্ত হওয়ায় গ্রামের শোষিত, নিপিড়িত, অনাহার আর অর্ধাহারে থাকা মানুষদের অমর্যাদার সামিল। শহরের বাবুরা ডাংগুলি খেলা কেড়ে নিয়ে ক্রিকেটে রুপান্তর করেছে, হাডুডু কেড়ে নিয়ে হকি, বেডমিন্টন বা আরো অন্য কিছুর প্রচলন ঘটিয়েছে। যার জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে গ্রামীন পরিবেশেও।

গ্রামীণ সমাজের অলংকার এই বর্ষবরনকে শহরের বাবুরা বিকৃত রুপ দিয়ে পালন করছে, তাতে শহুরে সব সংস্কতি লালন করা হচ্ছে গ্রাম বাংলার নাম দিয়ে। বৈশাখীর সাদা কালো পোশাক আর বাহারি পোশাকের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে গ্রাম বাংলার মানুষ। আজ থেকে ১০ বছর আগেও বাংলা বর্ষবরনে গ্রামের মানুষের মধ্যে উৎসবের আমেজ লক্ষ্য করা গেলেও এখন তা বিলীন। কৃষানীর তেল চকচকে মুখমন্ডলে এখন আর রঙ মাখানো দেখা যায় না, প্রৌঢ় নানা, দাদুর সফেদ সাদা দাড়িতে, ধুতিতে নাতি-নাতনীরা রঙ মেখে হেসে গড়াগড়ি যায় না। চলিমু মেলায় বলে দুরন্ত ছেলের দুরন্তপনা নেই। চারদিকে রঙের বাহারে তাল মিলানোর ক্ষমতাহীন গ্রামীন মানুষরা শহুরে বর্ষবরন শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে অথবা শোনে। গ্রামের মানুষের বিশেষ এই দিনটি অন্যদিনের আলো অন্ধকারে, আর শহুরে সাদাকালোর ভিড়ে হারিয়ে গেছে অনেক আগেই।

বটতলার বড় ষ্টেজে এখনো আয়োজন হয় পালা গান বা কবি গানের। তবে পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যহীন হওয়ায় এসব যেন উপহাসে পরিনত হয়েছে। শহুরে ষ্টেজে গ্রামীণ এসব আয়োজন শহুরে বাবুরা বেশ হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আর হাসে, ঠিক যেন চিড়িয়াখানা বা যাদুঘড়ে রক্ষিত সেই আমলের কিছু দেখছেন তারা।

খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন বাংলাদেশে এখনো কৃষি মজুর বা দিন মজুর শ্রেনীর অনেকেই হয়তো ২ বেলা নয়তো এক বেলা অথবা কখনো অনাহারে দিন যাপন করে। যদিও বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছয় এর উপরে। কৃষকের জমি এখন জোতদারদের কবলে, আর জোতদাররা প্রায় সবাই শহরে বসবাস শুরু করেছে। গ্রামের সে সকল মানুষ তার নিজের জমিতেই বর্গাচাষী অথবা কৃষি মজুর হিসেবে কাজ করছে।

৮০ এর দশকেও বাংলা আর্শ্বিন-কার্তিক মাসকে মঙ্গা বা অভাবের মাস হিসেবে ধরা হতো। বিংশ শতাব্দীদের ফসল উৎপাদনের কৌশল পাল্টে গিয়ে আর্শ্বিন-কার্তিক মাসের সেই মঙ্গা হয়তো নেই, তার বদলে সৃষ্টি হয়েছে সারা বছরই মঙ্গা বা অভাব।

স্বেচ্ছাসেবি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এই মঙ্গা শব্দটিকে ব্যবহার করে, গ্রামীন মানুষদের মাথা আর সম্ভ্রম বিক্রি করে দেশি বিদেশী সাহায্যকারীদের কাছ থেকে অনুদান গ্রহন করে তাদের নিজের মঙ্গা দুর করে পূজিপতিতে পরিনত হলেও, গ্রামীন মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। সরকারিভাবে কাজের বিনিময়ে খাদ্য, কাজের বিনিময়ে টাকা এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করার মহতি উদ্যোগেও গ্রামীন মানুষের পরিবারের বা বসবাসকারীদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। গ্রামীন মানুষের সম্ভ্রম, মাথা বিক্রি করে ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে,ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য থেকে শুরু করে সচিবালয়, আইন প্রনেতাসহ সরকার প্রধানের।

নির্লজ্জভাবে মিথ্যাচার করে, গ্রামীন মানুষের সেবার নাম করে দেশি বা বিদেশি অনুদান গ্রহনকারী্ এই মানুষগুলোই গ্রামের মানুষের কাছ থেকে বর্ষবরন নামক উৎসবটি হরন করেছে। অপমান করছে দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষকে। ইলিশ সুস্বাদু খাবার নি:সন্দেহে। তাই হয়তো পান্তার সাথে এই ইলিশের যোগসূত্র ঘটানো হয়েছে। মঙ্গার সময় এখনো গ্রামীন কিছু মানুষ এক ধরনের কচু, যা চমুক কচু নামে পরিচিত, তা সেদ্ধ করে খায়।

বর্ষবরনে সকল বাঙালির প্রতি বৈষম্যলোপ করতেই শহুরে বাবুরা বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আএয়াজন কর এবং সে অনুষ্ঠানে যুক্ত করে পান্তা ইলিশ। এ পান্তা ইলিশ শহুরে বাবুদের আনন্দে মাতোয়ারা করে তুললেও দুরত্ব সৃষ্টি করে ফেলেছে শহর আর গ্রামের মানুষের মধ্যে।

গ্রামের মানুষের অলংকার হরণকারি বাবুদের সত্যিকার ইচ্ছা যদি হয় বিভেদ ঘুচানো, তবে পান্তা ইলিশ নয়, আয়োজন করতে সেদ্ধ কচু খাওয়ার। তবেই হয়তো একদিনের একটি মহুর্তের জন্য হলেও দুরত্ব কমানো সম্ভব হবে, শহুরে আর গ্রামের মানুষের মধ্যে। নইলে বর্ষবরনের এমন আয়োজন গ্রামীন মানুষকে বিদ্রুপ করাই বোঝাবে।