সাফল্য গাঁথা: চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জের শারীরিক প্রতিবন্ধী মো: বিল্লাল ভিক্ষা ছেড়ে ট্রাইসাইকেলে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে

আজমাল হোসেন মামুন
Published : 19 July 2011, 10:55 AM
Updated : 19 July 2011, 10:55 AM

''আমি জীবনে বহু স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করে যেটুকু সন্তুষ্টি তার চেয়ে বেশি আত্মতৃপ্তি পেয়েছি বিল্লালের ভিক্ষা জীবনের পরিবর্তন দেখে। আগে যদি জানতাম যে, প্রতিবন্ধী বিল্লালের মত লোকের ভিক্ষা ছাড়া কাজ করে খেতে পারবে তাহলে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করতাম না এবং দুস্থদের মাঝে সাহায্য বিতরন না করে আজীবন প্রতিবন্ধী মানুষের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে কাজ করতাম। কথা গুলো বলেছিলেন, ফরিদগঞ্জ উপজেলার একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও বিশিষ্ট সমাজ সেবক মরহুম কসমিক শফিউল্ল্যাহ।''

মোঃ বিল্লাল হোসেন (৪৫) জন্মগত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নয়। তার জন্ম ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১৫ নং রূপসা (উত্তর) ইউপির রুস্তমপুর গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে। বাবার নাম মরহুম বারেক মোল্লা ও মাতার নাম কুরফুন নেসা। সেই বেশি দিনের কথা নয়, ৯৫ সালের পূর্বে সে রাজ মিস্ত্রির কাজ করে স্বাভাবিকভাবে সাচ্ছন্দ্যে জীবন অতিবাহিত করতো। কিন্তু বিধি-বিড়ম্বনার কারণে হঠাৎ প্যারালাইজড হয়ে নিম্নাঙ্গ অবশ হয়ে যায়। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় করতে না পেরে গ্রাম্য ডাক্তারের নিকট চিকিৎসা গ্রহণ করে। এতে কোন সুফল না পাওয়ায় ১ মাস পর সিআরপি-তে যান চিকিৎসার জন্য। সিআরপি-র কর্তব্যরত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ তাকে আসাদ গেটের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে রেফার করলেও অভিভাবক না থাকায় যাওয়া হয়নি। ফলে ১৯৯৬ সালে শারীরিক প্রতিবন্ধিতার শিকার হন।

প্রতিবন্ধিতার শিকার হওয়ার পর দুই ছেলে, স্ত্রী ও বৃদ্ধা মা কে নিয়ে বিপাকে পড়ে সে। কারণ, ১৬ শতক বসত ভিটা ছাড়া তার কোন সহায় সম্বল ছিলো না। ফলে ১৯৯৬ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত বাড়িতে বসে হতাশায় ভূগছিলো। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন মসজিদ ও ঈদগাহে যেত সহাযোগিতার জন্য। যে টাকা সংগ্রহ হতো তা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে অতি কষ্টে সংসার চলত। এমনকি অগত্য হয়ে ভিক্ষা করা আরম্ভ করে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি (বিপিকেএস) ''উন্নয়নে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্ব-উদ্যোগ (পিএসআইডি)'' এপ্রোচ বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে। উক্ত এপ্রোচের অনুকূলে প্রাথমিক অবস্থায় জরিপ চালানো হয়। জরিপে প্রায় ৮ শতাধিক বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে মোঃ বিল¬ালকেও সনাক্ত করা হয়।

মোঃ বিল¬াল তৃণমূল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনের সদস্য হন এবং আত্ম উন্নয়নের ওপর ১২টি বিষয়ের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। দুই লাঠির ওপর ভর করে তাকে চলাফেরা করতে হতো বলে সহায়কের বাই সাইকেলে চড়ে সে মিটিং-এ নিয়মিত উপস্থিত হতে থাকে। ফলে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি'র (বিপিকেএস) পক্ষ থেকে তাকে একটি হুইল চেয়ার উপহার দেওয়া হয়। হুইলচেয়ার পেয়ে সে হুইলচেয়ারে বসে ভিক্ষা করতে থাকে।

একদিন চাঁদপুর-ডিপিওডির পরিচালক তাকে লক্ষীপুর জেলার রায়পুর উপজেলায় ভিক্ষারত অবস্থায় দেখে। পরিচালক তাকে ভিক্ষা করতে নিরুৎসাহিত করে কিছু আয়বর্ধকমূলক কার্যক্রম করার পরামর্শ দেন। মোঃ বিল্লল উৎসাহ পেয়ে ১৯৯৯ সালের শেষদিকে পবিত্র রমযান মাসে রাস্তার পার্শ্বে মুড়ি, খেজুর, ছোলা বিক্রি আরম্ভ করে। এতে কিছু লাভ পায়। কিন্তু তা হলে কী হবে। রমযান মাস শেষ হলে এ ব্যবসা চলবে না। বিধায় তাকে একটি ব্যবসার উপযোগি ট্রাইসাইকেল তৈরি করে দেওয়া হয় বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি (বিপিকেএস) থেকে। ট্রাইসাইকেলের পিছনে এক বক্স তৈরি করা হয় যাতে ৭০ থেকে ৮০ কেজি মালামাল বহন করা যায়।

মোঃ বিল¬াল নতুন এই পদ্ধতি পেয়ে মাত্র ২ হাজার টাকা পুজি নিয়ে নিজে লক্ষীপুর জেলার রায়পুর উপজেলা থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় মালামাল যেমন: শরিষার তেল, ডাল, লবন, মুছুরির ডাল, সাবান, আচার, বিস্কুট ও চাটনিসহ প্রভৃতি মালামাল ক্রয় করে রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করতে থাকে। প্রারম্ভিক অবস্থায় স্থানীয় এলাকাবাসী ও চাঁদপুর-ডিপিওডি তাকে সহযোগিতা করেছে।

২০০৩ সালে উপজেলা ফরিদগঞ্জ সমাজ সেবা অফিস থেকে ১০ হাজার টাকা এবং চাঁদপুর-ডিপিওডি থেকে ৪ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ক্রমান্বয়ে ব্যবসার প্রসার ঘটাতে থাকে। সপ্তাহের মঙ্গলবার ব্যতীত ৬ দিন সকালে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়ে ফরিদগঞ্জের বদরপুর, রুস্তমপুরসহ বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে। মহিলা ও শিশুরা দেখলে তার নিকট সওদা ক্রয়ের জন্য ছুটে আসে। কারণ, সে ভেজাল মিশ্রিত মালামাল বিক্রি করে না। দ্রব্য নিয়ে টাকার পরিবর্তে চাল, ডিম, আলুসহ নানা দ্রব্য দেয়। এতে তার দুই দিকে লাভ হয়। একদিকে মালামাল বিক্রি করে অন্যদিকে প্রাপ্ত মালামাল বিক্রি করে।

এই ট্রাইসাইকেলে ব্যবসা চালিয়ে সে ৩ টি গরু ক্রয় করলেও পাশের লোকে হিংসায় দুটি গরু বিক্রি করে ৫ বছরের জন্য ১ টি পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ করছে। দুটির ছেলের মধ্যে প্রথম ছেলে মোঃ মোস্তফা (১৪) ৭ম শ্রেণীতে ও মোঃ আনোয়ার (১২) ৫ম শ্রেণীতে লেখা-পড়া করছে। ছেলেদের লেখা-পড়ার জন্য গৃহ শিক্ষকও রেখেছে বাড়িতে। বর্তমানে সে ৩শ থেকে সাড়ে ৩শ টাকা দৈনিক আয় করে থাকে।

তার অবস্থার পরিবর্তনের কারণ সম্বন্ধে জানতে চাওয়া হলে সে জানায়, আমার আত্মবিশ্বাস ও চাঁদপুর-ডিপিওডির উৎসাহ ও সহযোগিতা। কারণ, চাঁদপুর-ডিপিওডি ২০০৩ সালে তাকে 'বন্যা পরবর্তী পুনবার্সন' প্রকল্পের আওতায় ১টি নতুন ঘর দেওয়া হয়। ২০০৮ সালে চাঁদপুর-ডিপিওডি তাকে বিনা সুদে ১০০ সপ্তাহে পরিশোধের শর্তে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ প্রদান করেছে। বর্তমানে ১০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে আবারও চাঁদপুর ডিপিওডি নামক বেসরকারি সংস্থা থেকে। তার সংসারে সুখের সীমা নেই। শাশুড়িও থাকে তার সাথে বলে জানান।