সমকালীন ভাবনা: দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষমতায়ন চাই

আজমাল হোসেন মামুন
Published : 23 Feb 2011, 06:26 AM
Updated : 23 Feb 2011, 06:26 AM

এসএসএসি এবং এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় স্টার মার্কস পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে অনার্স এবং মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে শিরিন আকতার। অনায়াসে স্ক্রিন রিডার সফটওয়ারের মাধ্যমে কম্পিউটারের সব কাজ করতে সক্ষম। সরকারি চাকরিতে দরখাস্ত করে ইন্টারভিউ বোর্ডে হাজির হয়েছে একাধিকবার। কিন্তু ভাগ্যে জোটেনি সোনার হরিণ নামের সরকারি চাকরি। বর্তমানে তিনি ন্যাশনাল অ্যালাইয়েন্স অব ডিজঅ্যাবল্ড পিপলস অর্গানাইজেশনস (ন্যাডপো) নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। যেহেতু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে প্রধান হিসেবে কাজ করেন, সেহেতু তাকে অনেক সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হয়। তিনি সাদাছড়ি হাতে নিয়ে একা চলাফেরা করতে পারেন। অনেক সময় সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে অ্যাডভোকেসি করার জন্য তাকে যেতে হয়।

তিনি জানান, সাদাছড়ি হাতে থাকলে কোনো ভয় নেই রাস্তায় চলাফেরা করতে। বিপদে পড়লে সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসেন সহযোগিতার জন্য। এটি আমাদের সম্বল। আমাদের নিরাপত্তার প্রতীক।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বলতে 'প্রতিবন্ধী বিষয়ক জাতীয় নীতিমালা'-১৯৯৫-এ যে সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ১) যিনি একেবারেই দেখতে পান না; ২) যিনি এক চোখে দেখতে পান না; ৩) যথাযথ লেন্সের মাধ্যমেও যদি কারও ভিজ্যুয়েল অ্যাকুইটি ৬/৬০ বা ২০/২০০ (লেন্সের পদ্ধতি) অতিক্রম না করে; ৪) ফিল্ড অব ভিশন যদি ২০ ডিগ্রি কোণের বিপ্রতীপ কোণের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তাকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বোঝায়।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠী। তবে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীরা আরও বেশি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। একদিকে নারী, অন্যদিকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। দুনিয়ার আলো, রূপ-রস, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাস্তবে উপভোগ থেকে বঞ্চিত। যদিও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখে থাকেন, তবু চলাফেরা, কাজকর্মে অনেক বাধার সম্মুখীন হন তারা। বাংলাদেশে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে স্বাধীনতার পরপরই কাজ শুরু হয়। এরপর থেকেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষার দ্বার উন্মোচন হয়। ১৯৭৪ সালে তত্কালীন সমাজকল্যাণমন্ত্রী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উচ্চশিক্ষা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তখন শওকাত হোসেন ভূঁইয়া নামের এক দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর নেতৃত্বে 'দৃষ্টিহীন শিক্ষা অধিকার আদায় পরিষদ' গঠিত হয়ে ২০০ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নিয়ে ঢাকা শহরে ২ মাস আন্দোলন চলেছিল। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের দাবি পূরণ করে উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মোচন করেন। ক্রমান্বয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীরাও শিক্ষার জন্য এগিয়ে আসে।

বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছে। যার মধ্যে ৩০ ভাগ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। যাদের শিক্ষার হার ২০ শতাংশের কম। ২০০৫ সালে প্রকাশিত 'বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়' গ্রন্থের তথ্যমতে, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ৫টি, মোট ২৪০টি সিট এবং সমন্বিত কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিটি জেলায় একটি স্কুলে ১০ আসন হিসেবে ৬৪ জেলায় ৬৪০ আসন রয়েছে, যা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের তুলনায় একেবারে নগণ্য।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীরা অন্য প্রতিবন্ধী নারীদের চেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার। সম্প্রতি সেভ দ্য চিলড্রেন এবং বাংলাদেশ জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন পরিচালিত 'প্রতিবন্ধী শিশুদের যৌন নির্যাতনের ঝুঁকি বিষয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৬ দশমিক ২১ শতাংশ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশু নির্যাতনের শিকার। ৯১ দশমিক ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিশু নির্যাতনের সঙ্গে পরিবার ও পরিবারের নিকটতম সদস্যরাই জড়িত।

বাংলাদেশে শিক্ষার দিক থেকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা অন্য প্রতিবন্ধীদের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও চাকরি বা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। প্রতিবন্ধী নারীদের অধিকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীদের প্রতিনিধিত্বের হার হতাশাজনক। অথচ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীদেরই ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি।

উচ্চশিক্ষিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীদের অনেকেই কম্পিউটারের সাহায্যে সব কাজকর্ম অনায়াসে করতে সক্ষম। ইন্টারনেট ব্রাউজ ছাড়াও ডাউনলোড-আপলোড করতে কোনো অসুবিধা হয় না। ফলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীদের সরকারি চাকরির পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে টেলিফোন অপারেটর, প্রশিক্ষক, শিক্ষক, পাবলিক রিলেশন অফিসার এবং কল সেন্টারে কাজ করার সুযোগ দিলে দক্ষতা প্রমাণ করতে পারবেন। অনেকে প্রমাণ করেছেনও।

সম্প্রতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সব প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্রে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বয়স ৪০ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু সব সরকারি চাকরিতে ৩৫ বছর করা হলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য সুবিধা হতো। কারণ এদের অনেকের চাকরির বয়স শিক্ষাজীবনেই শেষ হয়ে যায়। কোটা নির্ধারণের ক্ষেত্রে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীদের অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশ প্রতিবন্ধীকল্যাণ আইন, জাতীয় প্রতিবন্ধী বিষয়ক নীতিমালা এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ সনদে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীদের অধিকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তা মানা হয় না। আসুন আমরা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীদের অধিকারগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে ক্ষমতায়নের পথকে সুগম করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করি।

এ ব্যাপারে জাতীয় অন্ধ সংস্থার (এনএফবি) প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক চেয়ারম্যান শওকাত হোসেন ভূঁইয়্যা জানান, আমাদের দেশে সবচেয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী বেশি অবহেলিত। কারণ একদিকে তারা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী অন্যদিকে নারী। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ ট্রাফিক আইন মোতাবেক কোনো অবস্থায় অনির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি থামানো না গেলেও রোড ক্রস করার সময় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সংশোধনী আনা প্রয়োজন। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সাদাছড়ি উত্তোলন করলে ট্রাফিককে লাল সিগন্যাল দিতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রাস্তা পারাপার না হবে, ততক্ষণ যানবাহন বন্ধ রাখতে হবে। দেশব্যাপী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে সাদাছড়ি ব্যবহারের প্রচলন ঘটাতে হবে। এছাড়াও দেশে সাদাছড়ি আইন অনুমোদন করতে হবে। সাদাছড়ি ব্যবহারের ব্যাপারে মোবিলিটি ট্রেনিং দিতে হবে।
————————————————————
লেখক-
উন্নয়নকর্মী এবং ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
মোবাইল নং-০১১৯১০৮৯০৭৫.