কাজী আনোয়ার হোসেন – বাংলা সাহিত্যের নিঃসঙ্গ কলম্বাস

হৃদয়ে বাংলাদেশ
Published : 9 Sept 2012, 07:09 PM
Updated : 9 Sept 2012, 07:09 PM

ঐতিহ্যময় বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অসংখ্য কৃতী পুরুষ ও নারী রয়েছেন, কিন্তু কোন বিশেষ শাখায় পথিকৃতদের সংখ্যা নগন্য। বিশেষ করে এদের মধ্যে যারা নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ, আত্মমগ্ন (বা যথেষ্ঠ প্রচারঢাকী নিয়োগ করেন নি) তাঁদের নিয়ে খুবই কম আলোচনা হয়। এ জাতীয় জীবিত মানুষদের মধ্যে কাজী আনোয়ার হোসেন, আমাদের কাজীদা, অগ্রগন্য। আমার রচনার শুরুতেই আমি কাজীদা কে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানিয়ে জানাতে চাই, কাজীদা, আমরা আপনাকে ভুলিনি।

দয়া করে কেউ ভাববেন না যে আমি বলতে চাইছি যে কাজীদা বাংলাসাহিত্যের, (প্রধানতঃ) রহস্যসাহিত্য, আরো সঠিকভাবে বললে থ্রিলার লেখার সূচনাবিদ। থ্রিলার সাহিত্যের যে চারা তিনি পুতে নুতন ধারার সুচনা সেই ষাটের দশকে বাংলাদেশে করেছিলেন, তা গত চল্লিশ বছরে প্রায় তিন প্রজন্মের কাছে আজ পত্রপল্লবে, ফুলে-ফলে, বৃহৎ এক মহীরুহে পরিনত হয়েছে। বিপুল পাঠকসৃষ্টির এবং বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার প্রথম কৃতিত্বও কাজী আনোয়ার হোসেনের। শুধু তাইই নয়, প্রায় তিনপ্রজন্মের পাঠকদের তার রচনা ঘিরে সমাবেশ ঘটিয়ে বাংলা রহস্যসাহিত্যের এক অনন্য ইতিহাসও তাঁর দখলে। এককালে মাসুদ রানা বা কুয়াশা পড়া পাঠকদের পাঠাভ্যাস গড়ে উঠার পরে এগিয়ে গেছেন বিশ্বসাহিত্যের অন্দর মহলে। আজ এদের
অধিকাংশই আর মাসুদ রানার পাঠক কি না আমার সন্দেহ আছে, কিন্তু "প্রভু, মোদের সভা হল ভঙ্গ! এখন আসিয়াছে নূতন লোক, ধরায় নব নব রঙ্গ!"

প্রথমে রহস্যসাহিত্যে কুয়াশা সিরিজ দিয়ে শুরু, বিদ্যুৎ মিত্র ছদ্মনামে। এর পরে সে সময়কালের পাঠককুলকে চমকিত করে শুরু করলেন মাসুদ রানা সিরিজ। যে সময়ে রহস্য সাহিত্যে রোমান্স প্রায় অদৃশ্য (বড়জোর 'মোহন গাঢ় স্বরে ডাকিল, রানী'), সেই রক্ষনশীল সমাজে জেমস বন্ডকে অনুসরন করে (অনুকরন নয়, পরে ব্যাখ্যা দিচ্ছি) উদ্দাম এক তরুন স্পাই, কালক্রমে সুপার স্পাই মাসুদ রানা যেন এক ভুমিকম্প! কাজীদার কলম সময়ের চাইতে এগিয়ে যেয়ে ফাঁসলো, তাঁর স্বর্ণমৃগ পুস্তক অশ্লীলতার দায়ে উচ্চআদালতের নির্দেশে কাপড়চোপড়ে ঢেকে পূনঃপ্রকাশিত হলো। আদালতের বিচারকদের সমালোচনা করার দুঃসাহস আমার নেই, তবে বহুবার আমরা আদালতকে দেশে-বিদেশে নৈতিকতার দ্বারবানের দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি। বাংলাদেশে (তৎকালীন পাকিস্তানে) এই মামলায় কাজীদার আর্থিক ক্ষতি কি হলো জানিনা, তবে মাসুদ রানার গুনগ্রাহী পাঠকের সংখ্যা বৃদ্ধি লাভ করলো। সে থেকে আজ পর্যন্ত, চিরতরুণ সে দেশপ্রেমিক আজো ছোঁ মেরে পাঠকদের নিয়ে যায় কল্পনার জগতে। সেখানে চার দশক ধরে নিপুন বাস্তবতায় চিত্রিত মাসুদ রানার সাথে পাঠকেরা কখনো শিঁউরে উঠেন, কখনো আতঙ্কে দমবন্ধ হয়ে পরের পৃষ্ঠায় যান আর সবশেষে বিজয়ী মাসুদ রানার সাথে বিজয়ীর হাসিটি হাসেন। যেন মাসুদ রানা নয়, যা করার পাঠক (আমি পাঠিকা শব্দ ব্যবহার করিনা, এতে পুরুষতান্ত্রিকতার প্রকাশ পায় বলে) নিজেই করলো, উফ্‌!

আমি কেন কাজীদাকে মাসুদ রানা সৃষ্টি করতে জেমস বন্ডের চরিত্রের অনুকরণকারী বলিনা তার প্রধান কারন, মাসুদ রানার বাঙ্গালীয়ানা। শুরুতে জেমস বন্ডের ছায়া থাকলেও আজকের মাসুদ রানা এক আন্তর্জাতিক সুপার স্পাই হয়েও অন্তর জুড়ে তার বাংলাদেশ। তাই নীল নয়না স্বল্পবেশ ব্লন্ডের চাইতে কৃষ্ণনয়না, শাড়ি পড়া লম্বাচুলের বাঙ্গালী ললনা অনেক দুর এগিয়ে যায়। তাইতো ইতালির অখ্যাত শহরে বিখ্যাত গিল্টি মিয়া "রিস্টুরেন্টে" ঢুকে নির্বিকার চিত্তে এক পেলেট গরম ভাত আর সর্ষে ইলিশের অর্ডার দিয়ে দেয়। কে ভাবতে পেরেছিলো থ্রিলারে শরতের আকাশ সুপার স্পাই মাসুদ রানার মনে রবীন্দ্রনাথ গুঞ্জরণ তোলে, "কাছে এলো পুজোর ছুটি, রোদ্দুরে লেগেছে চাঁপা ফুলের রং, হাওয়ায় শিশির উঠছে শিরশিরিয়ে, মন লাগেনা কোন কাজে"। অর্থাৎ মাসুদ রানা এক আবহমান বাঙ্গালী, জেমস বন্ডের হনুকরণ নয়। আর, মাসুদ রানা কাজী আনোয়ার হোসেনের সৃষ্টি।

আমি এতক্ষন মাসুদ রানা নিয়ে বলেছি বলে এর অর্থ এই নয় যে কাজীদার সোনার হাতের স্পর্শে বুঝি শুধু মাসুদ রানাই জেগেছে। ভুল। মাসুদ রানার কোন্‌ পাঠক ভুলবেন গিল্টি মিয়া, কাঁচাপাকা ভুরুর নীচের কঠোর চোখের রাহাত খান, সদা হাসিখুশি সলিল সেন, সেই উ-সেন, গগল, রেমারিক, এমন কি ইউসুফ বে কে? আর সোহানা?
কাজীদার উদ্ভাবনী মস্তিস্কের সৃষ্টি ওয়েষ্টার্ণ, তিন গোয়েন্দা, নিজেকে জানো, ধুমপান ত্যাগে আত্মসন্মোহন বা যৌন সঙ্গম জাতীয় অসাধারন সিরিজ। যারা স্বাধীনতার আগের রহস্য পত্রিকা দেখেন নি, তারা আসলেই বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের এক মহামূল্যবান দ্রষ্টব্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

একজন মানুষ নিজেকে কতটুকু ছড়িয়ে বিকাশিত হতে পারেন তা নিয়ে হুমায়ুন আহমদ জীবৎকালেই যতো আলোচিত হয়েছেন তার একাংশেরও কম আলোকিত হয়েছেন, কাজী আনোয়ার হোসেন। তাঁর সংগীতশিল্পী জীবনের কথা বলা বাহুল্য, তবে সেই ষাটের দশকে (১৯৬৪) গাওয়া অন্ততঃ এইযে আকাশ এইযে বাতাস গানটি সংযুক্ত না করলে মহা বেঈমানী হয়ে যাবে। কে জানে, ফের আবার গিল্টি মিয়াকেই তিনি পাঠিয়ে দেন কি না।


কাজীদা, গত চল্লিশ বছরের বেশী সময় ধরে একাকী কলম্বাস হয়ে আমাকে, আমার দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মকে নিরলস সমুদ্রযাত্রায় সাথে নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁর জন্য আপনার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আপনার সুদীর্ঘ কর্মময় জীবন কামনা করছি একান্ত ভালোবাসায়, কাজীদা।