স্ট্রিট চিলড্রেন- পেশাদার অপরাধী তৈরির আঁতুড়ঘর (০১)

বিন্দুবিসর্গ
Published : 26 Dec 2012, 09:07 AM
Updated : 26 Dec 2012, 09:07 AM

ঘটনা-০১
হঠাৎ করেই রেল লাইনের পাশে জ্ঞাত-অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা বেড়ে গেল। বেশ চিন্তায় পড়ে গেল রেলওয়ে পুলিশ। হেডকোয়ার্টাস এর কৈফিয়ত তলব। অফিসাদের ঈদের ছুটি বাতিল। এক সপ্তাহ পর রিপোর্ট্ এল-ট্রেনের ছাদে ভ্রমনরত অবস্থায় কতিপয় অজ্ঞাত দুস্কৃতিকারী কর্তৃক ছিনতাইয়ের পর ট্রেনের ছাদ হতে ধাকা দিয়ে ফেলে দেওয়ায় তাদের মৃত্যু হয়েছে। এবার কড়া ভাষায় নির্দেশ এল এক সপ্তাহের মধ্যে দুস্কৃতিকারীদের ধরে আইনের আওতায় আনতে হবে।
এর ঠিক তিন দিনের মাথায় জামানের ফোন পেলাম। যেখানেই থাকি না কেন অতি সত্বর কমলাপুর রেলওয়ে থানায় রিপোর্ট্ করার নির্দেশ পেলাম। জামান কোন গুরুত্বপূর্ণ খবর না হলে এভাবে বলে না। অগত্যা কিছুটা পায়ে হেটে, কিছুপথ রিকসায় করে কমলাপুর রেলওয়ে পুলিশ থানায় উপস্থিত হলাম। ওসি সাহেবের রুমে ঢুকতেই দেখি একগাদা সাংবাদিক আর কিছু বাচ্চা বাচ্চা ছেলে যাদের সবারই হাতে হাত কড়া লাগানো। জামানের বন্ধু বলে ওসি সাহেব আমাকে আগে থেকেই চেনেন। ওসি সাহেবের চেয়ারে বসা জামান। আমাকে দেখেই ইশারায় বসতে বলল। বুঝলাম গুরুত্বপূর্ণ কোন কেইস। আমার আগ্রহটাও বেড়ে গেল দ্বিগুন।

"স্যার, ছিনতাইয়ের পর যদি মনে হয় বেটায় আমারে চিনবো বা চিইনা ফালাইসে তয় হেরে আর আমরা রাখি না।" সহজ স্বীকারোক্তি।

কিভাবে মার? জামানের প্রশ্ন।

স্যার মারার জন্য আমাদের তিনটা পদ্ধতি আছে। প্রথম পছন্দ ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া। তার পর যদি মনে হয় বেটায় বাইচা যাইবো এবং আমাদের চিনে ফেলছে তয় আম্মাজান না হয় কৃষ্ন মালা।

সেটা কি রকম?

স্যার মা্ন্নার আম্মাজান ছবি দেখছেন? ওর হাতে একটা সুন্দর ছোরা ছিল। আমাদেরও একটা আছে। ওইটার নাম আম্মাজান। আর কৃষ্ন মালা হচ্ছে গামছা গলায় দিয়ে ফাসদিয়ে মারা ।

একজন এসআই একটি ছোরা ও একটি পাকানো নতুন গামছা এনে রাখল জামানের সামনে। "স্যার এইগুলো ওদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছ।"

একটা বাকানো সৌখিন ছোরা। সাধারনত কুরবানির ঈদে কসাইদের হাতে দেখা যায়। বেশ বড়ই। আঠারো ইন্ঞি এর মত হবে। একদম চকচকে ধারালো।

কয়টা মেরেছিস এ পযর্ন্ত ?

স্যার হিসেব নাই। ত্রিশ পয়ত্রিস তো হবেই। বেশিও হতে পারে।

তোর বয়স কত?

কি জানি স্যার। বয়সের হিসেব তো করি না । হবে হয়ত ২০/২২।

২০/২২ বয়সের যুবকটিই এদের ওস্তাদ। নাম জীবন। তবে সাগরেদদের মাঝে সে অসহায় জীবন নামে পরিচিত। তার নামের কথা জিজ্ঞাসা করতেই সে বলল।

স্যার মা বাবায় তো জন্ম দিয়া জীবনটাই দিছে। আর তো কিছু দেয় নাই। তার পর জন্মের পরই বাবাই নাকি কই গেছে গা। আমার বয়স এই ধরেন স্যার ৪/৫ হবে তখন মা আমারে এই রেলস্টেশনে ফালায় গেছে গা। তারপর আর একদিনও মাকে দেখি নাই। স্টেশনে স্টেশনে বড় হয়ছি। আমারে দেখাইয়া একবেটি ভিক্ষা করত আর আমারে পালত । একটি বড় হলে এই মনে করেন ৭/৮ হইব তখন থেকে আমি আমার মত। কেউ আমার না। হাত পাইতা খায়ছি। এখন জোর করে ডাকাতি করে খায়। মানুষ মারা স্যার আমার কাছে কিছুই না। একবেলা ভাত খাওনের মতই।

তোর আসল ঠিকানা কোথায়?

স্যার আমার তো কোন ঠিকানা নাই। মায় তো বলে যায় নাই। আমি যখন যেখানে থাকি সেটাই আমার ঠিকানা। এই এখন থানায় আছি, থানাটায় এখন আমার ঠিকানা। কাল জেলে যাব। কাল থেকে জেলই আমার ঠিকানা। যদি ফাসি হয় তয় কেউ তো আমার লাশটা স্যার নিবে না। তাই আন্জুমান যেখানে কবর দেয় সেটাই আমার আসল ও শেষ ঠিকানা।

বাকি ছেলেদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। তাদেরও একই অবস্থা। অতিমাত্রায় দুষ্ট হওয়ায় একজনকে তার বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।
তাদেরকে হাজত খানায় রাখা হল।

ঘটনা-0২
শহরের একজন নাম করা ডাক্তার খুন হলেন তার নিজ বাসায়। ডিবি পুলিশ বেশ ক'দিনের চেষ্টায় কয়েকজন পেশাদার চোরদের পাকড়াও করল। তারা বাসা বাড়িতে চুরি ডাকাতির পাশাপাশি ভাড়ায় ডাকাতি ও কিলিং মিশনে যায়। জিঞ্জাসাবাদে ডাঃ নারান চন্দ্র হত্যার সাথে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেল। আদালতে তারা জবান বন্দিও দিল।

উপরিউক্ত ঘটনা দুইটি আমাদের সবারই কম বেশি জানা। আমরা যে বিষয়টি জানি না বা জানার চেষ্টা করি না তা হল এর পিছনের অংশটা। অর্থাৎ ঐ ছেলেগুলোর এরকম পেশাদার অপরাধী হয়ে উঠার গল্পটি আমাদের অজানায় রয়ে যায়। আমাদের সমাজ বিঞ্জানীগন অবশ্য এর কিছু ব্যাখ্যা আমাদেরকে মাঝে মাঝে দিয়ে থাকেন।

উপরিউক্ত ঘটনা দুইটি শুধুই কোন ঘটনা নয়, আমাদের জন্য বিশেষ করে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য একটি সতর্ক সংকেতও বটে।

(চলবে——–)