ফৌজদারি মামলা পরিচালনায় আইনজীবীর নৈতিক ও পেশাগত কর্তব্য

শাহানূর ইসলাম সৈকত
Published : 20 August 2014, 07:10 AM
Updated : 20 August 2014, 07:10 AM

কিছু লিখিত-অলিখিত নৈতিকতা সব আইনজীবীরই থাকা উচিত। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী (ডিফেন্স ল ইয়ার) ও সরকারি পক্ষের কৌঁসুলির (প্রসিকিউটর) জন্য পেশাগত জীবনে অবশ্যপালনীয় নীতিমালা হিসেবে বিভিন্ন উৎস থেকে উৎপত্তি হয়েছে। কমন ল-ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোয় বিদ্যমান বিচারব্যবস্থায় বিভিন্ন বিচারিক নজির, সংবিধি অথবা নিয়ন্ত্রণকারী আইনজীবী সংগঠন (বার কাউন্সিল/ অ্যাসোসিয়েশন) কর্তৃক নির্ধারিত/প্রণীত আচরণবিধির মাধ্যমে এসব নীতির উৎপত্তি হয়েছে। এসব নীতি পালনে ব্যর্থতার জন্য অনেক সময় একজন আইনজীবীকে ভর্ৎসনা, বরখাস্তসহ বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সম্মুখীন হতে পারে। তাই একজন আইনজীবীর পেশাগত জীবনে এসব নীতি মেনে চলা নৈতিক ও পেশাগত কর্তব্য।

অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীর কর্তব্য : বিচারক ও সরকারি কৌঁসুলির সঙ্গে মামলা সম্পর্কিত কার্যক্রম পরিচালনায় অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীর সব সময়ই পেশাগত আচরণ করা উচিত। অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে সব সময় কার্যকর প্রতিনিধিত্ব করা একজন ডিফেন্স ল ইয়ারের নৈতিক দায়িত্ব। অসাধু বা অনৈতিক আচরণ একজন ডিফেন্স ল ইয়ারের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সুনাম নষ্ট করতে পারে। এমনকি যেহেতু একজন ডিফেন্স ল ইয়ার অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব করেন, তাই তার অসাধু বা অনৈতিক আচরণ অভিযুক্ত ব্যক্তির বিশ্বাসযোগ্যতা ও সুনামও নষ্ট করতে পারে।

মক্কেলের প্রতি কর্তব্য : মক্কেলের প্রতি একজন ডিফেন্স ল ইয়ারের প্রচুর দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। আইনগত পরামর্শদাতা হিসেবে একজন ডিফেন্স ল ইয়ারের অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে কার্যকর ও মানসম্মত প্রতিনিধিত্ব করা নৈতিক দায়িত্ব। অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে যৌথভাবে মামলা পরিচালনার সময় একজন ডিফেন্স ল ইয়ারের সম্ভাব্য স্বার্থের সংঘাত এড়িয়ে চলা নৈতিক দায়িত্ব। যুক্তিসঙ্গত দ্রুততা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে মামলা পরিচালনা করাও একজন ডিফেন্স ল ইয়ারের নৈতিক দায়িত্ব। মক্কেলের সঙ্গে সম্পাদিত সব ধরনের যোগাযোগের গোপনীয়তা বজায় রাখা একজন ডিফেন্স ল ইয়ারের নৈতিক দায়িত্ব। মামলার প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো সম্পর্কে যত দ্রুত সম্ভব তথ্যানুসন্ধানপূর্বক প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে তা মামলা পরিচালনায় ব্যবহার করা তার নৈতিক দায়িত্ব।

আদালতের প্রতি কর্তব্য : নৈতিক ও পেশাগত আচরণের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে আদালতের সামনে অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বার্থ সংরক্ষণ করা একজন ডিফেন্স ল ইয়ারের কর্তব্য। একজন ডিফেন্স ল ইয়ার কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে আদালতের সামনে ভুল তথ্য বা আইনের ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করবেন না। যেমন যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি ডিফেন্স ল ইয়ারের কাছে তার কৃত অপরাধের কথা স্বেচ্ছায় স্বীকার করেন, তবে আদালতের সামনে অভিযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক ওই অপরাধ সংঘটিত হয়নি মর্মে জবানবন্দি প্রদানে একজন ডিফেন্স ল ইয়ার কখনো পরামর্শ দেবেন না। মামলা পরিচালনায় অভিযুক্ত ব্যক্তির অনৈতিক ও অবৈধ নির্দেশনা অনুসরণ করা একজন ডিফেন্স ল ইয়ারের জন্য অবশ্য অনুচিত। প্রাসঙ্গিক আইন ও বিধিগুলো যা সরাসরি অভিযুক্ত ব্যক্তির অনুকূলে যায়, কিন্তু সরকারি পক্ষের আইনজীবী আদালতে উত্থাপন করেননি, সেসব আইন ও বিধিগুলো খুঁজে বের করে আদালতে উত্থাপন করা একজন ডিফেন্স ল ইয়ারের অবশ্য-দায়িত্ব। তিনি অভিযুক্ত ব্যক্তি ও মামলাসংশ্লিষ্ট অন্য সব পক্ষের মধ্যে বিদ্যমান স্বার্থের দ্বন্দ্ব অবশ্যই এড়িয়ে চলবেন। ফৌজদারি বিচার প্রশাসনের উন্নয়ন ও পুনর্গঠন এবং মূল আইন (সাবস্টান্টিভ ল) ও পদ্ধতিগত আইনে (প্রসিডিউরাল ল) যদি কোনো অপ্রতুলতা থেকে থাকে তবে তা খুঁজে বের করে নিরসনের উদ্যোগ নেয়া একজন ডিফেন্স ল ইয়ারের নৈতিক দায়িত্ব।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি বা প্রসিকিউটরের কর্তব্য : উনিশ শতকের গোড়ার দিকে অধিকাংশ মামলাই অভিযোগকারী (ভিকটিম) ব্যক্তিগতভাবে নিজে পরিচালনা করতেন। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (প্রসিকিউটর) অভিযোগকারীর পক্ষে মামলা পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। বর্তমানে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি রাষ্ট্র ও ভিকটিম উভয়ের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন। ফৌজদারি মামলার কার্যকর পরিচালনায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (প্রসিকিউটর) মুখ্য ভূমিকা রাখেন। কারণ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনীত অপরাধের অভিযোগগুলো প্রমাণে তিনি কার্যকর সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। যদি অভিযোগকারী কর্তৃক আনীত অপরাধগুলো অভিযুক্ত ব্যক্তি সম্পাদন করেছেন মর্মে বিশ্বাস করার সম্ভাব্য যথেষ্ট কারণ থাকে, তবেই একজন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির ওই মামলা পরিচালনা করা উচিত। অন্যথায় ভবিষ্যতে মামলাটি পরিচালনা না করে বাতিলের পরামর্শ দেয়া তার নৈতিক দায়িত্ব। বিচারের সময় অবৈধভাবে প্রাপ্ত সাক্ষ্যগুলো ব্যবহার করা রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির কোনোভাবেই উচিত নয়। অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধ সংঘটন করেননি মর্মে কোনো সাক্ষ্য বা প্রমাণাদি পেলে সে তথ্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জানানো রাষ্ট্রপক্ষের কেঁৗসুলির নৈতিক দায়িত্ব।

মামলায় বিচারের আগে, বিচার চলাকালে বা বিচার-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির অযৌক্তিক মন্তব্য যেমন ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষীর গ্রহণযোগ্যতাকে হেয় করে এমন কোনো মন্তব্য; বর্ণ, জাতীয়তা, লিঙ্গ বা অন্য কোনো কারণে পক্ষপাতিত্বমূলক মন্তব্য; প্রতিহিংসা বা সহানুভূতিশীল মন্তব্য; সাক্ষ্য থেকে বাদ দেয়া হয়েছে এমন খারাপ কাজ সম্পর্কে মন্তব্য; জিজ্ঞাসাবাদের সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির নিশ্চুপ থাকার অধিকার প্রয়োগ সম্পর্কে মন্তব্য ইত্যাদি করা থেকে বিরত থাকা উচিত।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের অধিকাংশ আইনজীবী মক্কেলের প্রতি তাদের নৈতিক ও পেশাগত দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞাত নন। যদিও বা কিছু কিছু আইনজীবী তা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, কিন্তু সিনিয়র, জুনিয়র, খ্যাতিমান, অখ্যাত নির্বিশেষে অধিকাংশ আইনজীবীর সেসব নৈতিক ও পেশাগত কর্তব্য পালনে অনীহা লক্ষ্য করা যায়। ফলে মক্কেলরা অনেক সময় হয়রানির শিকার হন, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই বিচারব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে একজন আইনজীবীর মক্কেলের প্রতি তাদের নৈতিক ও পেশাগত দায়িত্ব-কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করা উচিত।