মামলা জট নিরসনে প্রয়োজন নিয়মতান্ত্রিক সমন্বয়!

শাহানূর ইসলাম সৈকত
Published : 10 Nov 2014, 11:21 AM
Updated : 10 Nov 2014, 11:21 AM

বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যমান ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় দেশের বেশীভাগ জনগণের সহজে প্রবেশগম্যতা নেই বললেই চলে। নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধি সহ দরিদ্র নারী ও শিশুরাই বিশেষত সময়মত ন্যায় বিচার প্রাপ্তিতে বেশীরকম সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। বিচার নিষ্পত্তির ধীরগতি মূলত বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রিতার সৃষ্টি করে। অন্যান্য কারণের সাথে মামলা নিষ্পত্তির জটিল পদ্ধতি এবং কার্যকর কেস ম্যানেজমেন্টের অভাবে সমগ্র দেশে প্রায় ২.৮ মিলিয়ন মামলা জটের সৃষ্টি হয়েছে। যা সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থার ওপর বিশাল চাপের সৃষ্টি করেছে। ফলে বিচারপ্রার্থীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তি বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে এবং তাদের প্রতিনিয়ত অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।

বিচার ব্যবস্থার সাথে জড়িত বিভিন্ন স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধুমাত্র নিয়মিত যোগাযোগ, সহযোগিতা ও সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির হার অনেকাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব। যদি পুলিশ প্রশাসন ও পাবলিক প্রসিকিউটরের কথা বিবেচনা করি তাহলে দেখা যায় যে, তদন্তকারী পুলিশ অফিসার এবং পাবলিক প্রসিকিটর একটি ফৌজদারী মামলার ভিত্তি রচনা করে। তদন্তকারী পুলিশ অফিসার এবং পাবলিক প্রসিকিটর কর্তৃক প্রস্তুতকৃত নথির মান এবং উহার সবল ও দূর্বল দিকের উপর একটি মামলা কত দ্রুত নিষ্পত্তি হবে তাসহ মামলার ফলাফল অনেকাংশে নির্ভর করে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যদি পুলিশ অফিসার একজন অভিযুক্ত আসামীকে গ্রেফতার করে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমান প্রসিকিউটরের নিকট প্রেরণ না করে তবে মামলা বিচারকালে তা অবশ্য জটিলতার সৃষ্টি করে। তেমনি মামলা তন্তকালে প্রশিকিউশন যদি তদন্তকারি কর্মকর্তাকে নিয়মিত মতামত প্রদান না করে বা প্রয়োজনীয় নির্দিষ্ট তথ্য প্রমান সংগ্রহের মাধ্যমে সহযোগিতা জন্য তদন্তকারি কর্মকর্তাকে অনুরোধ না করে তবে সময়মত একটি উৎকৃষ্ট ও সন্তোষজনক তদন্ত এবং তদন্ত প্রতিবেদন আশা করা যায় না।

ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় সরকারী কৌশলীর কিছু কিছু ক্ষমতা আছে যা পুলিশ কর্মকর্তার নেই। তেমনি পুলিশ কর্মকর্তার কিছু দক্ষতা আছে যা সরকারী কৌশলীর নেই। তাই পুলিশ ও সরকারী কৌশলীর মধ্যে সহযোগিতা ও সমন্ব্য় সাধন একটি মামলার লক্ষ্য, মেরিট এবং সবল ও দুর্বল দিক সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিশ্চিত করে। তা না হলে অনেক সময় পদ্ধতিগত জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। যেমনঃ সংগ্রহিত তথ্য প্রমান বিবেচনার অযোগ্য হতে পারে বা যেখানে সময়ের সীমা রয়েছে সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি মুক্তি পেয়ে যেতে পারে বা মামলা খারিজ হতে পারে। এমনকি আদালত গ্রেফতারকে আইনসংগগত হয়নি মর্মে বাতিল ঘোষণা করতে পারে।

ফৌজদারী কার্যবিধি, পুলিশ রেগুলেশনসহ অন্যান্য অপারেশনাল ম্যানুয়াল ও রেগুলেশন অনুযায়ী তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা ও সরকারী কৌশলীর মাঝে যোগাযোগ, সহযোগিতা ও সমন্বয়ের যতেষ্ট সুযোগ থাকা সত্তেও বাস্তবে ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় তাদের মাঝে সেসবের যতেষ্ট ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা ও সরকারী কৌশলীর মাঝে যোগাযোগ, সহযোগিতা ও সমন্বয়ের অভাবেই ফৌজদারী মামলায় সাজার হার মাত্র ২০ শতাংশ বলে অনুমান করা যায়। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে সহযোগিতা লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু তা নিয়মতান্ত্রিকভাবে হয় না, যেটুকু হয় শুধুমাত্র রাজনৈতক প্রয়োজনে বা দূর্নীতি করার সুবিধার্থে।

মামলায় নথি প্রস্তুতির ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সরকারি কৌশলির মধ্যে নামমাত্র সহযোহিতা ও সমন্বয়ের ফলে বিচার নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা পরিলক্ষিত হয়, যা প্রকারান্তে মামলা জটের সৃষ্টি করে। তাছাড়া, সরকারি কৌশলির মত একটা গুরুত্বপূর্ণ পেশার স্থায়ী ক্যাডার সার্ভিস না থাকায় সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সর্বোপরি, তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সরকারি কৌশলির মধ্যে পেশাগত ও সাংস্কৃতিগত পৃথক মানসিতার জন্যেও অনেক সময় উভয়ের মাঝে সমন্বয়ের ঘাটতি দেখা যায়।

ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় বিদ্যমান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা ও সরকারি কৌশলির মধ্যে নিয়মতান্ত্রিক ও কার্যকর যোগাযোগ, সহযোগিতা এবং সমন্বয় বৃদ্ধির মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির হার বহুলাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব। তাই আর বিলম্ব না করে সরকার তথা বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।যাতে করে বিচারপ্রার্থীর ভোগান্তি কমে ন্যায় বিচার প্রাপ্তি সহজ ও নিশ্চিত হয়।