সৌন্দর্যবিলাস ও মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা

ফকির ইলিয়াস
Published : 8 Oct 2011, 03:49 AM
Updated : 8 Oct 2011, 03:49 AM

এক.

মানুষ সুন্দরকে ভালোবাসে। আবার মানুষ সুন্দর হতে চায়। যারা কোনো রিটেল স্টোরে কাজ করেন, তাদের কাজের প্রথম শর্ত হচ্ছে, নিজে স্মার্ট হওয়া। কারণ কিছু বিক্রি করার আগে বিক্রেতাকে হতে হবে ক্রেতার কাছে আকর্ষণীয়। এক আড্ডায়, নিউইয়র্ক ফ্যাশন ইনস্টিটিউট এন্ড টেকনোলজির প্রফেসর নিকোলাস টরেস বলেছিলেন, একজন সেলস প্রফেশনালকে মনে রাখতে হয়, তিনি নিজেকেই বিক্রি করছেন। এর অর্থ হলো এই, বিক্রেতার প্রেজেনটেশনেই ইমপ্রেসড হবে ক্রেতা। বাংলাদেশও নানা দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এখন বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। ফ্যাশন, সৌন্দর্য এখন আমাদের প্রাত্যহিক সভ্যতার অন্যতম অংশ। আমি সাজবো আমার মতো করে। তা বলা যেতেই পারে। তারপরও একটি সামাজিক অনুশাসন থাকে। একটি নিয়মনীতি থাকে। থাকে সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া। আর সব কিছুর সমন্বয় সাধন করেই ফ্যাশন ডিজাইনাররা একটি দেশের মানুষের জন্য ফ্যাশন প্রণালী নির্মাণ করেন।

মানুষের সৌন্দর্যচর্চায় ব্যক্তিস্বাধীনতার একটি বিষয় গোটা বিশ্বব্যাপী সংশ্লিষ্ট। ইউরোপ-আমেরিকার সড়কে ইচ্ছেমতো ছোট কাপড় পরে বের হওয়া যায় না। উদ্ভট কোনো পোশাক-আশাক কখনই দীর্ঘস্থায়ী হয় না কোনো সমাজেই। তারপরও মাঝে মাঝে আমরা এমন পোশাক বাজারে দেখি। কারো কারো গায়েও দেখি। আমরা জানি, ইউরোপ আমেরিকায় অনেক ক্লাব আছে, এমনকি মদের বার আছে, যেখানে ড্রেসকোড না মেনে ঢুকাই যায় না। তাহলে নিয়ম তো মানতেই হচ্ছে! সম্প্রতি ঢাকার একটি বিউটি পার্লার এন্ড স্পা সেন্টারে গোপন ক্যামেরা নিয়ে দেশ-বিদেশে বেশ হইচই শুরু হয়েছে। এমন গোপন ক্যামেরা রাখা উচিত কিনা, মানুষের ব্যক্তিগত ছবি ধারণ করা কতোটা নীতিসিদ্ধ, তা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে।

'পারসোনা' নামের এই বিউটি পার্লারের ড্রেস পাল্টাবার রুমে ভিডিও ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা থাকা উচিত কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আসতেই পারে। কারণ এই রেকর্ডকৃত ছবি কারো কাছে পাচার হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকেই যায়। এই ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে প্রশাসনে। সামাজিক জীবনেও। বহুল পরিচিত বিউটি পার্লার পারসোনা থেকে লুকানো ভিডিও ক্যামেরা উদ্ধারের ঘটনা তদন্ত করছে পুলিশ। গুলশান জোনের ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। ঘটনাটি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারকেও অবহিত করা হয়েছে। কমিশনারের নির্দেশে ঘটনা তদন্তে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নিজামুল হক মোল্লাকে প্রধান করে করা তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন সহকারী কমিশনার (প্রশাসন) মিজানুর রহমান ও সহকারী কমিশনার (পেট্রোল) নুরুল আলম। কমিটিকে কয়েকদিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা রয়েছে। ওদিকে এ ঘটনায় আলামত নষ্টের অভিযোগে গুলশান থানার এসআই মাসুদ রায়হানকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়েছে। গুলশান জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার স্বাক্ষরিত ক্লোজ করা সংক্রান্ত পত্রে বলা হয়েছে 'মিসকনডাক্ট করায় আপনাকে ক্লোজ করা হলো।' পুলিশি পরিভাষায় মিসকনডাক্টের অর্থ আচরণবিধি লঙ্ঘন করা বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অমান্য করা। মাসুদ রায়হান সাংবাদিকদের বলেছেন, আমাকে কেন ক্লোজ করা হলো তা আমি বলতে পারবো না।

এদিকে তাকে ক্লোজ করার বিষয়ে জানতে চাইলে গুলশান জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার লুৎফুল কবির বলেছেন, একজন নারীর অভিযোগের ভিত্তিতে জব্দ করা হার্ডডিস্ক বেআইনিভাবে ওই এসআই অভিযোগকারীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। পুলিশ কোনো কিছু জব্দ করার পর তা আইনগতভাবে অন্যের হাতে দেয়া যায় না। সে এখতিয়ার থাকে আদালতের। তিনি বলেন, ধারণা করা হচ্ছে এসআই মাসুদ জব্দ করা হার্ডডিস্কটি আরেকজনের হাতে দেয়ার পর সেখান থেকে কিছু আলামত সরিয়ে ফেলা হতে পারে। সে জন্য ওই এসআইকে শাস্তিমূলক ক্লোজ করা হয়েছে।

অন্যদিকে গোপন ক্যামেরায় মহিলাদের ভিডিওচিত্র ধারণ করায় কেন আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে না জানতে চেয়ে পার্লারটির স্বত্বাধিকারী কানিজ আলমাস খানকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। জনস্বার্থে লিগ্যাল নোটিশটি পাঠিয়েছেন ঢাকা জজকোর্টের ৪ আইনজীবী। এরা হলেন- এডভোকেট মাহফুজ হাসান, আরিফুল হক, নুরুজ্জামান ও ইলিয়াস হুসাইন। নোটিশে বলা হয়েছে, কানিজ আলমাস খান বিউটি পার্লারে রূপচর্চার আড়ালে রূপচর্চার কক্ষগুলোতে গোপনে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে মহিলাদের আপত্তিকর ভিডিওচিত্র ধারণ করে আসছেন- যা জনজীবনে ভীতিকর প্রভাব সৃষ্টি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে। তবে কানিজ আলমাস বলেছেন তিনি এখনো ওই লিগ্যাল নোটিশ হাতে পাননি। সাংবাদিকদের তদন্ত কমিটির প্রধান এডিসি নিজামুল হক বলেছেন, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই বলা যাচ্ছে না। তবে বিষয়টি নিয়ে এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তিনি বলেন, উদ্ধারকৃত হার্ডডিস্কে শুধুমাত্র কিছু স্টিল ছবি পাওয়া গেছে। সেখানে কোনো ভিডিওচিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা ধারণা করছি পুলিশ সেটি উদ্ধারের আগে বা পরে কোনো এক সময় মুছে ফেলা হয়েছে। মুছে ফেলা ভিডিওচিত্র উদ্ধারের জন্য এক্সপার্টের সাহায্য নিচ্ছি। এক্ষেত্রে এসবি ও সিআইডির এক্সপার্টরা কাজ করছেন।

দুই.

সিকিউরিটি ক্যামেরার বলয় দিয়ে যাওয়া নিয়ে সম্প্রতি নিউইয়র্কে, প্রেসিডেন্ট ওবামার নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ঘটনার সূত্রপাত গেলো ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১১ মঙ্গলবার। প্রেসিডেন্ট ওবামা জাতিসংঘে ভাষণ দেয়া উপলক্ষে নিউইয়র্কের 'ওয়ার্ল্ডফ এস্টোরিয়া' হোটেলে অবস্থান করছিলেন। দীপু মনিও ছিলেন সেই হোটেলের অতিথি। রাত সাড়ে ৮টার দিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজ কক্ষে ঢুকতে গেলে শীর্ষ নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে সিকিউরিটি চেকআপ স্ক্যানিং পার হয়ে যেতে বলে। দীপু মনি এতে রাজি না হয়ে বলেন, আমি একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এতে সিকিউরিটির লোকজন কর্ণপাত না করে তাকে ওদিকে যেতেই বলে। বাদানুবাদের পর তিনি ওদিকে যেতে রাজি হলে, বিকট শব্দে এলার্ম বেজে ওঠে। বলা দরকার, জুয়েলারি কিংবা চাবির রিং সঙ্গে থাকলেই এরকম এলার্ম বেজে ওঠা এখন নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার।

এই ঘটনার পর নিরাপত্তাকর্মীরা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেহ তল্লাশি করতে চায়। এতে তিনি আরো বিগড়ে যান। তিনি ফোন করেন, বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন, দূতাবাসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের। ডা. দীপু মনি বলেন, এটা জেনেভা কনভেনশন নামার বরখেলাপ। সবশেষে, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন ও দূতাবাসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সমঝোতা ও আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়। দীপু মনি তার কক্ষে প্রবেশ করার সুযোগ পান। এই ঘটনা আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে, নিরাপত্তার নামে এই বিশ্ব এখন জেনেভা কনভেনশন চুক্তিও মানতে নারাজ। কিন্তু কেন? আমরা, বিশ্ববাসীরা তো শান্তির জন্যই ঐ চুক্তিটি করেছিলাম। এখন ব্যক্তিবিশেষের নিরাপত্তার জন্য অন্য শীর্ষদের খাটো করার চেষ্টা করা হচ্ছে কেন?

আগেই বলেছি, মানুষ সৌন্দর্যের পূজারী। কিন্তু কিছু মানুষ এই বিশ্ব থেকে প্রতিদিনই সুন্দরকে হত্যা করছে। প্রজন্মের প্রশ্বাসকে বিঘ্নিত করছে। শিল্পীরা চেতনার অভ্যন্তরের অন্ধকারের এক প্রতীক গড়ে তোলেন। আমরা জানি, মানুষের প্রকৃত মুখকে আড়াল করে থাকে যে মুখোশ, সেই মুখোশের ভেতর জমে থাকা অন্ধকারকে বিশ্লেষণ করে অসুন্দরের প্রতীক নির্মাণ করেন চিত্রশিল্পীরা।

আদিম যুগ থেকেই মানুষের শিল্পের ভেতর প্রকৃতির প্রসন্ন রূপ ও ভীষণ রূপ- দুটোই প্রকাশিত হয়েছে। ভয়ঙ্করতাকে যখন শিল্পিত করেছে মানুষ, তখন শিল্পের নিয়মেই তার ভেতর থেকেই উৎসারিত হয়েছে এক সংঘাতের বা সংক্ষুব্ধতার সৌন্দর্য। এটা আপাতভাবে মনোহর নয়। কিন্তু গহন এক সত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে বলে, তার ভেতর নান্দনিক সৌন্দর্যও উদ্ভাসিত হয়। পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্তেই আদিম যুগের মানুষ এ রকম তমসার সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। আধুনিক যুগে শিল্পের আধুনিকতাবাদের যুগে বিশেষত, আদিমতার এই অন্তর্লীন সংহত শক্তিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন ইউরোপের অনেক শিল্পী। এডওয়ার্ড মুঙ্খ, পিকাসো থেকে সুররিয়ালিস্ট সালভাদোর দালি পর্যন্ত অসুন্দরকে শিল্পিত করার যে ধারাবাহিকতা তা আজ পর্যন্তও প্রবাহিত। সময় ক্রমশ জটিল হচ্ছে। শিল্পীর প্রতিবাদী চেতনায় অন্ধকারের শিল্পরূপ ততোই ঘনীভূত হয়ে নানা আঙ্গিকে প্রকাশিত হচ্ছে। আমাদের জীবনে, আমাদের রাজনীতি-সমাজনীতিতেও তেমন সৃজনশীল বিবর্তন চাই। চাই মানুষের মননের উন্মেষ। মানুষকে বুঝতে হবে, কোনো পাপাচার কিংবা ব্ল্যাকমেইলিং কোনো সমাজকে এগিয়ে নেয় না। সমাজকে এগিয়ে নেয় ধ্যানী চেতনা। প্রজন্ম সেই সত্যই বরাবর ধারণ করুক।