নাসিমারাও মানুষ

মো ফয়সাল আহম্মদ
Published : 1 Nov 2012, 06:52 PM
Updated : 1 Nov 2012, 06:52 PM

বাংলার মাটিতে নারী নির্যাতন ব্যাপারটা ডাল-ভাতের মতো৷ অনেকটা নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই স্বাভাবিক৷ হর হামেশাই ঘটছে এসব৷ সব ঘটনা যেমন মিডিয়াতে আসেনা তেমনি সব ঘটনাই আবার পুলিশ পর্যন্ত গড়ায় না৷ ভুক্তভোগী নারীরা বড়ই হতভাগা, বড়ই অসহায়৷ আমার আজকের লেখাটা কোন মহা মানবীর জীবনী নয়৷ একজন হতদরিদ্র ও নির্যাতিত নাসিমাকে নিয়ে৷

নাসিমা আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর পূর্বে লৰীপুর জেলার খোসাখালীর একটি অতি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করে৷ দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করার কারনে স্কুলের বারান্দাতেও যাওয়া হয়নি তার৷ এক সময় দরিদ্র পিতা-মাতার সংসারে একটু হাসি ফোটানোর জন্য প্রায় ১৩ বছর বয়সে চট্টগ্রামে আসে গার্মেন্টসে চাকুরী করার জন্য এবং আশ্রয় নেয় একই এলাকার গার্মেন্টসকর্মী রেহেনা বেগমের নয়াবাজারস্থ বাসায়৷ রেহেনা বেগমের বাসায় থাকতো তার বড় ভাই রিক্সা চালক লম্পট ফয়েজ আহমেদ৷ একই যায়গায় থাকার কারনে ফয়েজ আহমেদের সাথে নাসিমার সখ্যতা গড়ে উঠে এবং এক সময় তাদের মধ্যে গড়ে উঠে প্রেমের সম্পর্ক৷

প্রায় ১০ বছর পূর্বে নয়াবাজারস্থ মসজিদের এক হুজুরের মাধ্যমে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং মৌসুমী আবাসিক এলাকাস্থ পদ্মপুকুর পার ক্লাবের পার্শ্ব একটি বাসা ভাড়া নিয়ে তারা বসবাস শুরম্ন করে৷ নাসিমা গার্মেন্টসে চাকুরী করে মাস শেষে যে টাকা বেতন পেত তা ফুসলিয়ে তার স্বামী নিয়ে যেতো৷ রহিমা সংসারের সুখের কথা চিনত্মা করে কখনও কিছু বলতো না৷ এক সময় নাসিমা সনত্মান নেয়ার ইচ্ছা পোষন করে৷ কিন্তু তার লম্পট স্বামী সনত্মান নিতে চায় না৷ সে শুধু চায় নাসিমাকে ভোগ করতে এবং তার বেতনের টাকা হাতিয়ে নিতে৷ নাসিমা বিষয়টি বুঝতে পেরেও স্বামীর উপর অঘাত বিশ্বাস, ভালোবাসা ও ভক্তির কারনে কখনও কিছু বলতে পারে না৷ হঠাত্‍ নাসিমার স্বামী রিক্সা চালানো বন্ধ করে দেয়৷ রহিমা কিছু বললে মারধর করে৷ একদিন সে রহিমাকে জানায় রিঙ্া চালাতে তার ভালো লাগে না৷ পারলে কিছু টাকা তোর বাড়ী থেকে এনে দে আমি নয়াবাজার মোড়ে চায়ের দোকান দিবো৷ নাসিমার বাবার টাকা দেবার সামর্থ নেই তাকে জানালে ফয়েজ আহমেদ তার উপর চালায় মধ্যযুগীয় নির্যাতন এবং টাকা না দিতে পারলে নাসিমাকে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেয়৷ নাসিমা প্রানের ভয়ে কাউকে কিছু বলার সাহস পায় না৷ শুধু স্বামীকে বলে কিছু দিন গেলে আমি তোমাকে কিছু টাকা দিবো দোকান করার জন্য৷

এরপর নাসিমা গার্মেন্টসে বেশী বেশী ওভার টাইম করে কিছু টাকা জমিয়ে নয়াবাজার মোড়ে একটি ভাসমান চায়ের দোকান করে দেয়৷ কিন্তু ফয়েজ আহমেদ একদিন দোকান করে তো তিন দিন বন্ধ রাখে৷ মাঝে মধ্যে নেশা করেও বাসায় ফিরে৷ নাসিমা কিছু বললে তাকে মারধর করে৷ নাসিমা মুখ বুঝে সব সহ্য করে৷ এক সময় নাসিমা তার স্বামীকে নাজানিয়ে গর্ভবতী হয়৷ পরবতর্ীতে তার স্বামী যখন বিষয়টি বুঝতে পারে তখন বাসায় বাজার করা বন্ধ করে দেয় এবং নাসিমাকে সনত্মান ফেলে দিতে বলে৷ নাসিমা রাজি না হওয়াতে তার ওপর চালায় অমানসিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন৷ নাসিমা অর্ধাহারে অনাহারে গর্ভের সনত্মানকে নিয়ে গার্মেন্টসে যায়৷ মাস শেষে যে টাকা পায় তা জোর করে তার স্বামী নিয়ে যায়৷ এক সময় নাসিমা শারীরিক অসুস্থতার কারনে গার্মেন্টসে যেতে পারে না৷ কিন্তু তার স্বামী তাকে প্রতি নিয়ত গার্মেন্টসে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে৷ যাইহোক কিছু দিন পর নাসিমার কোল আলো করে জন্মগ্রহণ করে একটি পুত্র সনত্মান৷ আদর করে সনত্মানের নাম রাখে আরমান আহমেদ৷ নাসিমা সনত্মানের মুখের দিকে তাকিয়ে সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যায়, ভুলে যায় তার স্বামীর নির্যাতনের কথা৷ একদিন নাসিমা তার সনত্মানকে স্বামীর কোলে দিতেই ফয়েজ আহমেদ সনত্মানকে তুলে আছার মারতে যায়৷ নাসিমা হাতে পায়ে ধরে তার সনত্মানকে বাঁচায়৷ এরপর ফয়েজ নাসিমাকে বলে যে, তুই তোর সনত্মানকে কারও কাছে পালক দিয়ে চাকুরী শুরম্ন কর না হলে তোকে আর তোর সনত্মানকে মেরে ফেলব৷ নাসিমা তার আদরের সনত্মানকে কারও কাছে দিবে ভাবতেই পারে না৷ তার পরও তার স্বামীকে জানায় যে, ও আর একটু বড় হোক তারপর কারও কাছে দিয়ে দিবো৷

নাসিমার সনত্মানের বয়স তখন ৩ মাস ৮ দিন৷ হঠাত্‍ রাত্র বেলা ফয়েজ আহমেদ নাসিমাকে বলে, তুই এত দিন চাকুরী করলে আমি প্রায় ৫০,০০০/- টাকা পেতাম৷ এখন এই টাকা তোর বাপের বাড়ী থেকে এনে দিবি আর ছেলেকে কারও কাছে দিয়ে কাল থেকে চাকুরী শুরম্ন করবি৷ এ সময় নাসিমা তার স্বামীকে জানায় তার বাবার পৰে এ টাকা দেয়া সম্ভম না৷ অমনি ফয়েজ আহমেদ খেপে গিয়ে বটি নিয়ে আসে এবং নাসিমার গলায় বটি বসায়৷ নাসিমা ভয়ে চিত্‍কার করার ভাষাও হাড়িয়ে ফেলে৷ একসময় ফয়েজ নাসিমাকে পায়ের নিচে রেখে তার মাথার সব চুল কেটে দেয় এবং শিশু সনত্মানসহ রাত্র বেলা বাসা থেকে বের করে দেয়৷ নাসিমা সারা রাত সনত্মানকে বুকে জড়িয়ে রাসত্মায় কাটায়৷ সকাল হওয়ামাত্র সে পাশ্ববতর্ী একটি থানাতে যায়৷ ঘটনাটি ঐ থানা এলাকাতে না হওয়ায় থানা থেকে নাসিমাকে ঘটনাস্থল সংলগ্ন থানাতে যাওয়ার পরামর্শ ও বাংলাদেশ মানবাধিকার বাসত্মবায়ন সংস্থার ঠিকানা দেওয়া হয়৷ নাসিমা তাত্‍ৰণিক বাংলাদেশ মানবাধিকার বাসত্মবায়ন সংস্থার অফিসে আসে৷

সংস্থার চট্টগ্রাম ইউনিটের অফিসে নাসিমার মুখ থেকে তার উপরোক্ত বর্ননা শুনে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলাম না৷ আমার চোখ থেকে অনবরত পানি জরতে থাকলো আর একজন পুরম্নষ হিসেবে নিজেকে লজ্জিত মনে হতে থাকলো৷ আমরা পুরম্নষরা কতখানি কাপরম্নষ হতে পারি তা নাসিমার ঘটনা থেকে বুঝতে পারলাম৷ তত্‍ৰণিক একটি তদনত্ম টিম ঘটনাস্থলে পাঠালাম এবং ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় আমরা সংস্থার পৰ্য থেকে মামলার প্রস্তুতি নিলাম এবং কিছু মিডিয়াকে বিষয়টি অবগত করলাম৷ পরের দিন ঘটনাটি কিছু প্রিন্ট মিডিয়াতে প্রকাশিত হওয়ায় বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে এবং ২ আগষ্টও একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলে বিষয়টি প্রচারিত হয়৷ যাই হোক ২ আগষ্ট আমরা সংস্থার পৰ থেকে মহামান্য আদলতে একটি মামলা দায়ের করি এবং আদালত ঐ দিনই আসামীর বিরূদ্ধে সমন জারি করে৷ জানিনা নাসিমার জন্য কতটুকু কি করতে পারবো তবে আমাদের পৰ থেকে আসামীর শাসত্মি প্রাপ্তিতে যথাসাধ্য চেষ্টা অব্যাহত থাকবে৷ আর একজন নবীন মানবাধিকারকমর্ী হিসেবে নাসিমার জন্য যদি কিছু করতে পারি তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করবো৷

পরিশেষে বলতে চাই এভাবে হাজারো নাসিমা নীরবে নিবৃতে নির্যাতিত হচ্ছে৷ আমাদের পুরম্নষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নাসিমার মতো এভাবে হাজারো নারীকে তাদের ভোগের পন্য মনে যেমন খুশি তেমন ব্যবহার করছে এবং নাসিমারাও যে মানুষ সেটা বেমালুন ভুলে যাচ্ছে৷ হয়তো কেউ প্রতিবাদি হয় আবার বেশীরভাগই কোন প্রতিবাদ করতে পারে না৷ আসুন আমরা সবাই যে যার অবস্থানে থেকে এ রকম যেকোন নির্যাতনের প্রতিবাদ করি এবং নারী ও পুরুষ একে অপরের পরিপুরক মনে করে সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করি৷

মোঃ ফয়সাল আহম্মদ
জেলা সমন্বয়কারী
রোড টু রাইটস প্রকল্প
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাসত্মবায়ন সংস্থা, চট্টগ্রাম ইউনিট৷