মানবাধিকার দিবস ও আমাদের মানবাধিকার

মো ফয়সাল আহম্মদ
Published : 10 Dec 2012, 06:18 AM
Updated : 10 Dec 2012, 06:18 AM

মানব শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় তার অধিকার প্রতিষ্ঠার যাত্রা। পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতিভেদে মানব শিশু পায় তার অধিকার। লালন বলেন, "অনন্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই, শুনি মানব রূপের উত্তম কিছু নাই"। তবু এই উত্তম রূপ মানবই করে আরেক মানবকে অধিকার বঞ্চিত। মানবাধিকার ও মানবাধিকার লংঘন জায়গা করে নেয় পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতিভেদে মানব জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে। আজ বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও এ দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হচ্ছে। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর ঘোষিত মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের সম্মানার্থে ১৯৫০ সাল থেকে ১০ ডিসেম্বরকে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। এবারের মানবাধিকার দিবসটিকে মালালা ইউসুফজাইকে উৎসর্গ করেছে জাতিসংঘ। এবারের মানবাধিকার দিবসের স্লোগান হচ্ছে "মালালার পক্ষে সোচ্চার হও-কন্যাশিশুদের শিক্ষার অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হও"। এখন এই স্লোগানকে বুকে নিয়ে আগামী একবছর আমরা কি করতে পারবো সেটাই দেখার বিষয়। তবে আমি মোটেও আশাবাদী হতে পারছি না। কারণ আমাদের দেশের কন্যা শিশুরা যেভাবে নিগৃহীত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত হচ্ছে কাগজে লিখে শেষ করা যাবে না। এখানে কন্যা শিশুদের যখন খেলাধূলা করার বয়স তখন তাদের অনেককেই বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে, কখনও কখনও কন্যা শিশু জন্ম গ্রহণ করলেই পারিবারিকভাবে তাদের তুচ্ছ করে দেখা হয়, কখনওবা ধর্মীয় গোড়ামী কিংবা দারিদ্র্যতার কারণে তাদের স্কুলের বারান্দাতেও যাওয়া হয় না। পদে পদে লংঘিত হয় তাদের মানবাধিকার।

আমাদের দেশে বর্তমানে আকাশে বাতাসে চারদিকে লাশের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। কখনও ফ্লাইওভার ভেঙে, কখনও গার্মেন্টসে আগুন লেগে, কখনও রাষ্ট্রীয়ভাবে গুম বা হত্যার মাধ্যমে, কখনও সন্ত্রাসী কর্তৃক হত্যা, কখনও ধর্মীয় গোড়ামিতে হত্যা ও লুণ্ঠন, কখনও বহিঃরাষ্ট্র কর্তৃক সীমান্ত হত্যা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে পদে পদে আমাদের মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে পারছে না। যা মানবাধিকারের চরম লংঘন। এতদিন যাবৎ আমাদের দেশের সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো এ দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালন করলেও প্রকৃত অর্থে এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি আমাদের মানবাধিকার। আমাদের দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি খুব একটা সুখকর নয়। গৃহকোণ থেকে রাষ্ট্রীয় আওতা পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে নানাভাবে মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে। অবস্থাভেদে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা কম বেশি হলেও মানবাধিকার পরিস্থিতি এখানে সব সময়ই উদ্বেগজনক।

রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশে একটি গণপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার কায়েম হয়েছে। তা সত্ত্বেও দেশের রাজনৈতিক সন্ত্রাস অব্যাহত আছে যা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। কোন দুর্বলতার সুযোগে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হলে নাগরিকদের মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার হুমকির সম্মুখীন হয়। দেশের মৌলিক অধিকার কার্যকর রাখার জন্য যে ধরনের গণতান্ত্রিক সহাবস্থানমূলক পরিবেশ থাকা দরকার তা আমাদের দেশে যথার্থ অর্থে বিদ্যমান আছে কিনা সন্দেহজনক।

রাষ্ট্র সংবিধানে নারীদের জন্য নীতিমালা ও আইন করেছে তবুও এই দেশে নারীরা অবহেলিত, এদেশের শিশু, প্রবীণ, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীরাও সমাজে হচ্ছে মৌলিক অধিকার থেকে সুবিধাবঞ্চিত, প্রতিনিয়ত হচ্ছে অত্যাচার, বঞ্চনা আর অবহেলার শিকার। এই অবহেলার প্রবৃত্তিরও সামাজিকরণও হয়েছে যুগ যুগ ধরে দেশ, জাতি ও ধর্ম নির্বিশেষে। তাই মানাবধিকার সনদ বা রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও পদে পদে লংঘিত এসব মানুষের অধিকার এবং শোষিত হয় তারা ক্ষমতাবানদের হাতে। তবু আশার কথা হচ্ছে কিছু বেসরকারি সংস্থা, সমাজের বিবেকবান মানুষের একাংশ আজ সোচ্চার হয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালার আলোকে আইনের সঠিক বাস্তবায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং শিক্ষার মাধ্যমে নারী, শিশু ও দরিদ্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠায়।

আমাদের আশেপাশে এমন কিছু মানুষ রয়েছে যেমন- মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী, না পুরুষ না মহিলা (হিজড়া), যৌনকর্মী, সামাজিকভাবে চিহ্নিত নিম্ন সম্প্রদায় যেমন দলিত সম্প্রদায়, ঋষি সম্প্রদায় এবং আরও অনেকে; তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা খুব কমই উচ্চারিত হয়। অন্যদিকে পাহাড়ের কান্না ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা আজ চরম বিতর্কে রূপ নিয়েছে 'আদিবাসী' না 'উপজাতি' এ দুটো শব্দ নিয়ে। আমরা অনেক ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছি। এই স্বাধীন দেশের এই মানুষদের যারা বাংলাদেশেরই নাগরিক তাদের অবহেলিত রেখে, বঞ্চিত করে, তাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা না করে কোন ভাবেই দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রয়োজন তাদের উন্নয়নে সরকারের উপযোগী নীতিমালা গ্রহণ, প্রয়োজনে আইন ও নীতিমালার প্রয়োগ। আরও প্রয়োজন আমরা যারা সুবিধাভোগী আছি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা, সবাইকে সচেতন করে তোলা, সরকারকে সহযোগিতা করা।

মানবাধিকার বিষয়টি বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে কাগজে কলমে রয়েছে। যেমন-বাংলাদেশের সংবিধান, মানবাধিকার এর সার্বজনীন ঘোষণাপত্র ইত্যাদি। আর এসব আলোচিত হচ্ছে বিভিন্ন উপরিমহলে। বাস্তব অর্থে তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষকে এ বিষয়ে জাগ্রত করা হচ্ছে না, যারা তাদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন এবং যার ফলে তারা কোন প্রতিকার পাচ্ছে না। বাস্তব অর্থে তৃণমূল পর্যায়ে মানবাধিকার বিষয়টি তুলে ধরতে হবে। উঁচু স্তরে সভা সেমিনার না করে মাঠ পর্যায়ে মানবাধিকারের তাৎপর্য তুলে ধরতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, আমরা তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ। এখানে শিক্ষার হার যেমন কম, তেমন বেশিরভাগ লোকই দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। মানবাধিকার বিষয়টি অনেকেরই অজানা, অচেনা। তাই মানবাধিকার বিষয়টি সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। সকলকে অবগত করতে হবে তাদের অধিকার সম্পর্কে। এজন্য আমাদের সুশীল সমাজ ও মিডিয়াগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে মানবাধিকার সম্পর্কে জন সাধারণকে অবগত করতে ও অধিকার সচেতন করতে। আর যখনই সাধারণ মানুষ তাদের অধিকার সম্পর্কে অবগত ও সচেতন হবে তখনই প্রকৃত অর্থে প্রতিষ্ঠা পাবে মানবাধিকার এবং মানবাধিকার দিবসটি আমাদের জন্য বহুমুখী তাৎপর্য বয়ে আনবে।

লেখক: জেলা সমন্বয়কারী, এসএএইচআর প্রকল্প, চট্টগ্রাম ইউনিট, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা।