ধর্ষকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এখনই সময়

মো ফয়সাল আহম্মদ
Published : 25 Feb 2013, 07:22 PM
Updated : 25 Feb 2013, 07:22 PM

গত কিছু দিন যাবত্‍ পত্র-পত্রিকা কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার খবর যেদিকেই তাকাই না কেন বেশ কিছু ঘটনা আমাদের মনকে নাড়া দিচ্ছে৷ এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ধর্ষণের ঘটনা৷ আজ কুমিলস্না তো কাল চট্টগ্রামে, কোথাও না কোথাও একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে৷ আজকাল আবার ধর্ষণ একটা শৈল্পিক রূপও পেয়েছে, কখনও চলনত্ম বাসে আবার কখনও পাহাড়ের উপর ধর্ষিত হচ্ছে আমাদের মা-বোন কিংবা শিশুরা৷ সাম্প্রতিক সময়ে এ বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে আমাদের বিবেকবান সকল শ্রেনী পেশার মানুষদের৷ যদিও বিগত বছরগুলোতেও এ ধরনের বহু ঘটনা আমাদের নজরে এসেছিল কিন্তু বর্তমান বছরের শুরুতেই যেভাবে এটা মহামারি আকারে ধারন করেছে তা আগে কখনো দেখা যায়নি৷ আমরা যদি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ২০১২ সালের হিসাব পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাবো ৫,৬১৬ জন নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছে৷ তবে অধিকারের তথ্য অনুযায়ী ২০১২ সালে ৮০৫ জন নারী ও শিশু ধর্ষনের শিকার হয়৷ কিন্তু ২০১৩ সালের শুরম্নতেই চাঁদপুর ১০ বছরের এক বাক প্রতিবন্ধী ধর্ষণ ও হত্যা, টাঙ্গাইলে গণধর্ষণ, হবিগঞ্জের মাধবপুর ১৫ বছরের কিশোরী ধর্ষণ, রাজবাড়ীতে ৫বছরের শিশু ধর্ষণ, নিলফামারীতে চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্রী ধর্ষণ, মানিকগঞ্জে চলনত্ম বাসে তরম্ননী ধর্ষণ, চট্টগ্রামের বকলিয়াতে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী গনধর্ষণ, চট্টগ্রামের খুলসী থানাধীন ৬ বছরের শিশু ধর্ষণ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিৰক কর্তৃক গৃহকর্মী ধর্ষণসহ বিভিন্ন আলোচিত ঘটনা ঘটে৷ এছাড়াও আরও কত ধর্ষণের ঘটনা আমাদের খবরের আড়ালেই থেকে যাচ্ছে৷ বাংলাদেশ মানবাধিকার বাসত্মবায়ন সংস্থার এসএএইচআর প্রকল্পের চট্টগ্রাম ইউনিটের পরিসখ্যান অনুযায়ী গত ২০১২ সালে বৃহত্তর চট্টগ্রামে নারী ও শিশু ধর্ষণ হয়েছে ৫৬৷ তার মধ্যে ১ জন শিশু ও ২ জন নারীকে ধর্ষনের পর হত্যা, ১ জন শিশু ও ৯ জন নারী গণ ধর্ষনের শিকার এবং ১৪ জন শিশু ও ২৯ জন নারী ধর্ষিত হয়৷ কিন্তু ২০১৩ সালের জনুয়ারী মাসেই বৃহত্তর চট্টগ্রামে ১৭ জন নারী ও শিশু ধর্ষিত হয়৷

এখনই এর লাগাম টেনে ধরতে না পারলে পুরো বছর শেষে এ হার কোথায় গিয়ে দাড়াবে তা সকলেরই বোধগম্য৷ দেশের সর্বত্র যখন ধর্ষনের প্রতিবাদে ঝড় বইছে তখনও ধর্ষকরা নিশ্চিনত্মে ধর্ষণ করে বেরাচ্ছে৷ আমাদের প্রতিবাদ, আইন, প্রশাসনের হুমকি কিছুতেই তারা রম্নখছে না৷ আর তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না বৃদ্ধ কিংবা শিশু কেহই৷ আসলে আমাদের মা-বোন কিংবা শিশুদের এ নরপশুদের হাত থেকে এখনই রৰা করতে সকলকে এগিয়ে আসতে হতে৷ এজন্য শুধুমাত্র প্রতিবাদ, মিছিল, মিটিং, সেমিনার, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন কিংবা মানববন্ধন করলেই হবে না৷ আমাদের এসব ঘটনার আসল কারণ বের করতে হবে এবং কারণের উপর ভিত্তি করে এর প্রতিকার কিংবা প্রতিরোধে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে তাহলেই এটা নির্মূল করা সম্ভব হবে৷ আমি একজন ৰুদ্র মানবাধিকার কমর্ী হিসাবে আমার সীমিত অভিজ্ঞতার আলোকে ধর্ষণের কতিপয় কারন বের করার চেষ্টা করেছি৷ যা হচ্ছে- আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, নৈতিক চরিত্রের অবৰয়, মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা, পারিবারিক সু-শিৰার অভাব, আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়া, ধর্মীয় শিৰার অভাব, বন্ধু-বান্ধবের সাথে অহেতুক আড্ডা দেয়া, বেকারত্ব, ইন্টারনেট, কোন ঘটনা ঘটলে প্রতিবাদ না করা, নারীদের অসহায়ত্ব, অশালীনতা, পারিবারিক সম্পর্কের ফাটল, সুস্থ বিনোদনের অভাব ও অবাদ পতিতাবৃত্তি ইত্যাদি৷ আমার দৃষ্টিকোন থেকে উপরোক্ত কারণ গুলোই ধর্ষণের সাথে প্রত্যৰ কিংবা পরোৰ্যভাবে জড়িত৷

আসলে ডাক্তার যদি কোন রোগের কারণ জানতে পারে তাহলে তার জন্য চিকিত্‍সার প্রতিসেদক দেয়া অনেকটা সহজ হয়৷ তদ্রম্নপ ধর্ষণ নামক এমন একটি সামাজিক ব্যাধি থেকে সমাজকে রৰা করতে হলে যেসব পদৰেপ নেয়া যেতে পারে তা হচ্ছে-সরকারীভাবে আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব কিছুটা নিয়ন্ত্রন করা, মোবাইল ফোন ব্যবহারে কিছুটা নিয়ম নীতির আশ্রয় নেয়া, পারিবারিকভাবে সন্তানদের সু-শিৰায় শিৰিত করে তোলা, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা, ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা, ইন্টারনেটের বিভিন্ন পর্ন সাইটগুলো সরকারীভাবে বন্ধ করে দেয়া, সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা, অবাধ পতিতাবৃত্তি নিয়ন্ত্রনে কিছু নীতিমালা তৈরী করা, কোন ঘটনা ঘটলে সকলকে প্রতিবাদী হওয়া ও আইনের আশ্রয় নেয়া৷ আমাদের আইন শৃংখলা রৰাকারী বাহিনীকে সবচেয়ে বেশী তত্‍পর হতে হবে, কোথাও কোন ঘটনা ঘটলে তাত্‍ৰণাত্‍ দোষীদের আইনের আওতায় আনতে হবে, বিভিন্ন যায়গাতে বিশেষ করে পাবলিক প্যালেসগুলোতে ধর্ষণের শাসত্মি সম্পর্কে বিলবোর্ড স্থাপন করে সচেতনতার ব্যবস্থা করা৷ তাছাড়া কোন ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে বিচারের দীর্ঘ সূত্রিতা করা যাবে না, প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে দ্রম্নত বিচার আইনে ধর্ষকের বিচার করা ও প্রমান সাপেৰ্যে ধর্ষকের একমাত্র শাসত্মি ফাঁসির ব্যবস্থা করা৷ সবের্াপরি সরকারকে ধর্ষণ নির্মূলে আনত্মরিকভাবে সচেতন হতে হবে৷ আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ভদ্র মুখোশের আড়ালে অনেক পুরম্নষের মনেই নারী ও শিশুদের প্রতি সহিসংতার প্রবৃত্তি লুকিয়ে আছে৷ উপযুক্ত সময় সুযোগ পেলেই তা বিকশিত হয়৷ বর্তমানে আমাদের দেশের নারী ও শিশুরা পরিবার, ঘর, বেডরম্নম, শিৰা প্রতিষ্ঠান, রাসত্মা-ঘাট, অফিস-আদালত কোথাও নিরাপদ নয়৷ স্বামী, প্রেমিকা, শিৰক, সহাপাঠী, কার্যৰেত্রের সহকর্মী, চাচাতো-ফুফাতো কিংবা মামাতো ভাই, নিকট কিংবা দূর আত্মীয়, পাড়ার কিংবা রাসত্মার বখাটে ছেলে এমন কোন পুরম্নষ নেই যার কাছে আমাদের নারী ও শিশুরা নিরাপদ৷ আমাদের সমাজের মানুষরূপী কিছু নরপশু সময় ও সুযোগ পেলেই তাদের আসল পরিচয় প্রকাশ করে দেয়, আর ধর্ষণের শিকার হয় একের পর এক নারী ও শিশু৷ আমার প্রত্যাশা উপরোক্ত কারণ ও সমাধানের উপায়গুলো আমলে নিয়ে পরিবার, সমাজ, সরকার, মিডিয়া, বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাসহ সকলে যদি এগিয়ে আসে তাহলেই ধর্ষণের মত এমন ঘৃন্য সামাজিক ব্যাধি থেকে আমাদের সমাজ মুক্তি পাবে৷ আসলে সকলকেই রম্নখে দাঁড়াতে হবে নরপশু রূপি ঘৃন্য ধর্ষকদের বিরূদ্ধে, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে আমাদের সমাজকে ধর্ষক মুক্ত রাখতে৷

-মোঃ ফয়সাল আহম্মদ, জেলা সমন্বয়কারী, এসএএইচআর প্রকল্প, চট্টগ্রাম ইউনিট, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তাবায়ন সংস্থা৷