তিস্তা নদীর পানি বন্টনের রুপরেখা

মোঃ খালেকুজ্জামান
Published : 4 Jan 2012, 02:52 AM
Updated : 4 Jan 2012, 02:52 AM

পানির অপর নাম যেমন জীবন, তেমনই বাংলাদেশের অপর নাম নদী। হয়তো এই সত্যটা বাঙ্গালীরা বরাবরই জানতো, আর তাই সঙ্গত ভাবেই স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে বাঙ্গালীদের একটি প্রিয় স্লোগান ছিল, "তোমার আমার ঠিকানা – পদ্মা, মেঘনা, যমুনা"। বাংলাদেশের ৮০% এলাকাই নদী-প্লাবন ভূমি। নদীবাহিত পলিমাটির স্তরায়নের মাধ্যমেই কোটি কোটি বছর ধরে বঙ্গীয় ব-দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে। আর তাই, বাংলাদেশের প্রতিটি নদীর স্বাস্থ্যের উপরই দেশের প্রকৃতি এবং অর্থনীতির স্বাস্থ্যও নির্ভরশীল। নদীর গতি-প্রকৃতির উপর নির্ভর করেই প্রতিটি নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠে জীববৈচিত্র এবং সমাজ ও সভ্যতার সোপান। সে অর্থে প্রতিটি নদীর অববাহিকার পরিবেশ, প্রতিবেশ, কৃষি, মৎস্য সম্পদ, নৌ-চলাচল, শিল্প-কারখানা, এবং সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই আবর্তিত হয় নদীর প্রবাহমানতার উপর ভিত্তি করেই। তিস্তা নদীর অববাহিকায় বিদ্যমান প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র ও বসবাসরত জনগোষ্ঠীর বেলায়ও এ কথাটি সর্বোতভাবে প্রযোজ্য।

বাংলাদেশে ছোট বড় কয়েকশত নদী প্রবাহমান। প্রতিটি নদীর উৎসমুখ থেকে নিম্নমুখ পর্যন্ত অংশ এবং নদীর দুইপাশের প্লাবনভূমিকে ঐ নদীর অববাহিকা বলা হয়, যা কিনা প্রাকৃতিক নিয়মে গঠিত একটা ভূমিঅঞ্চল। নদীর অববাহিকা প্রশাসনিক সীমারেখা মেনে চলেনা, তাই বাংলাদেশের অনেক বড় নদীর অববাহিকার বড় অংশই দেশের সীমানার বাইরে অবস্থিত। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার মতোই, তিস্তা নদীর অববাহিকার বিস্তির্ন অঞ্চলই ভারতের সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। একটি দেশের কিংবা মহাদেশের প্রতিটি অঞ্চলই কোন না কোন নদীর অববাহিকায় অবস্থিত, আবার ছোট নদীর অববাহিকা অন্য কোন বড় নদীর অববাহিকারই অংশ। সে অর্থে, তিস্তা নদীর অববাহিকা ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকারই অংশ, যা কিনা আবার মেঘনা অববাহিকায় গিয়ে মিশেছে। একটি নদীর অববাহিকার উজানের অঞ্চলের প্রাকৃতিক এবং নৃগোষ্ঠির কর্মক্রিয়ার প্রভাব নিম্ন অঞ্চলে ব্যাপক ভাবে অনুভূত হয়। এই জন্যই পানিবিজ্ঞানে একটা কথা চালু আছে, "আমরা সবাই আমাদের নদীর অববাহিকার নিম্নাচলে বাস করি"। সে অর্থে, তিস্তা নদীর উজানে কি ঘটছে তার প্রভাব সেই নদীর নিম্নাঞ্চলেও অনুভূত হচ্ছে, এবং বৃহত্তর অর্থে বঙ্গীয় ব-দ্বীপের গঠন প্রনালীতেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলছে।

বাংলাদেশের বড় বড় ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে তিস্তা চতুর্থ বৃহত্তম নদী। এই নদীটি প্রায় ৪০০ কিঃমিঃ দীর্ঘ, যার নিম্নাঞ্চলের ১৭২ কিঃমিঃ বাংলাদেশে অবস্থিত। এই নদীর অববাহিকার আয়তন ১২১৮২ বর্গ কিঃমঃ, যার মধ্যে ২০১৭ বর্গ কিঃমঃ, অর্থাৎ ১৭% বাংলাদেশে অবস্থিত। যেকোন নদীর পানি প্রবাহের পরিমাণ নিম্নাঞ্চলে ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলে, কারণ নিম্নাঞ্চলে শুধু উজানের ভূ-উপরিস্থ সমস্ত পানি প্রবাহই বয়ে আসেনা, ভাটিতে অবস্থিত অববাহিকা অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানিও ভাটি অঞ্চলের নদীতে বাড়তি পানি সরবরাহ করে। আর তাই উজানের ৯৯% অববাহিকা অঞ্চলের পানি প্রবাহের পরিমাণ ভাটি অঞ্চলের সর্বশেষ ১% অববাহিকা অঞ্চলের পানির পরিমাণ থেকেও কম হয়। অর্থাৎ প্রাকৃতিক নিয়মে কোন নদীকে প্রবাহিত হতে দিলে উজানের সমস্ত পানিই ভাটি অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়, এবং প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে মানিয়ে নিয়েই জীববৈচিত্রের স্থিতিস্তাপকতা তৈরী হয়। তিস্তা নদীর বেলায়ও এ নিয়মের ব্যাত্যয় হয়নি। বাংলাদেশে অবস্থিত ১৭% অববাহিকা অঞ্চলেই সমগ্র তিস্তা অববাহিকায় বসবাসরত ২৯ মিলিয়ন জনগোষ্ঠির ২১ মিলিয়ন মানুষ (অর্থাৎ ৭২%) বসবাস করে, এবং সেই জনগোষ্ঠি তিস্তার পানির উপর নির্ভর করেই তাদের জীবন প্রক্রিয়া সাজিয়েছে। সিকিমে এবং পশ্চিমবঙ্গে তিস্তা অববাহিকার যথাক্রমে ৭০২৬ বর্গ কিঃমিঃ এবং ৩০৮৫ বর্গ কিঃমিঃ অঞ্চল অবস্থিত হলেও সেখানে যথাক্রমে ৫,৪০,৪৯৩ জন (প্রায় ২%) এবং ৮ মিলিয়ন (৩৮%) মানুষ বসবাস করে।
সাম্প্রতিককালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি নিয়ে ব্যাপক আলচনা হয়েছে। সে সফরকে কেন্দ্র করে যে কথাটা বারবার আলোচিত হয়েছে তাহলো, তিস্তার পানিতে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা কি হওয়া উচিত। মূলতঃ এ প্রশ্নটি অমিমাংসীত থাকার কারণেই শেষ পর্যন্ত তিস্তা পানিবন্টন চুক্তি স্বাক্ষরীত হয়নি। কথিত আছে, পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর আপত্তির মুখে খসড়া যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি তাতে ভারত এবং বাংলাদেশ ৫০: ৫০ হিস্যা পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু মমতা ব্যানার্জী মনে করেন কোনভাবেই বাংলাদেশকে ২৫% এর বেশী পানি দেওয়া সম্ভব হবেনা, কারণ তাতে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা হবেনা। পশ্চিমবঙ্গের পত্রপত্রিকায় এও বলা হচ্ছে যে বাংলাদেশকে দেওয়ার মতো কোন বাড়তি পানিই আসলে শীতের মওশুমে তিস্তা নদীতে থাকেনা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তিস্তা নদীতে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা কি হওয়া উচিত? এই প্রশ্নের পানিবিজ্ঞান-সম্মত এবং পরিবেশবিজ্ঞান-সম্মত সহজ উত্তর হচ্ছে অববাহিকার ভাটির অঞ্চল হিসেবে তিস্তা নদীতে প্রবাহিত সব মওশুমের ১০০% পানিই বাংলাদেশের প্রাপ্য। প্রকৃতির নিয়ম সেটাই বলে। পানি সম্পদের প্রাকৃতিক ব্যাবস্থাপনা মেনে নিলে সব পানি এবং পানি-বাহিত পলিমাটির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হলে শুধু অর্থনীতিরই ক্ষতি হবেনা, ক্ষতি হবে বঙ্গীয় ব-দ্বীপ গঠন প্রক্রিয়ারও, যা কিনা এখন বাড়তি হুমকীর মুখে পড়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে এবং সমুদ্রপৃষ্টার উচ্ছতা বাড়ার কারনে। বঙ্গীয় ব-দ্বীপ গঠন প্রক্রিয়া অক্ষুন্ন রাখার জন্য বর্ষাকালের প্লাবন এবং জোয়ারভাটা নিয়মিত প্লাবন ও পলি স্তরায়নের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ভূমিউচ্চতা বাড়িয়ে তোলার কোন বিকল্প বাংলাদেশের জন্য সুফল বয়ে আনবেনা। সে অর্থে, শুধু তিস্তা নয়, সমস্ত অভিন্ন নদীর পানি এবং পলি প্রবাহ প্রাকৃতিক হারে বজায় রাখা ছাড়া বাংলাদেশের ভবিষ্যত সত্যিই হুমকীর মুখে পড়বে। তাই, বন্যার প্লাবন যতই বিপত্তিদায়ক মনে হোক না কেন, অতীতে ভূতাত্বিক নিয়মে যেমন বন্যার প্লাবনেই বাংলাদেশের বিস্তর প্লাবনভূমি গড়ে উঠেছে, ভবিষ্যতেও একই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বাংলাদেশের ভূখণ্ড ঠিকে থাকতে পারবে।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারনে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের সমস্ত নদী এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপরই প্রভাব পড়েছে এবং কোন নদীই আর প্রাকৃতিক নিয়মে বাধাহীনভাবে প্রবহমান নেই। প্রতিবেশী দেশ থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা সবকটি নদীর প্রবাহেই বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প গড়ে তোলার মাধ্যমে স্বাভাবিক গতিপ্রবাহে বিঘ্ন ঘটানো হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও নদী সমুহে নানামুখী প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাকৃতিক প্রবাহ বিঘ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে তিস্তা নদীতে ডালিয়া নামক স্থানে ১৯৯৩ সালে একটি ব্যারেজ এবং ১০০০ কিঃমিঃ দীর্ঘ সেচ-খাল ও ক্যানেল তৈরী করে নীলফামারী, রংপুর, এবং বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার ১১৩০০০ একর কৃষিজমিতে সেচের ব্যাবস্থা করা হয়। এই সেচ প্রকল্পের সর্বোচ্চ লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৮০০০০০ একর জমি। শুকনো মওশুমে গড়ে ৯০০০ কিউসেক পরিমাণ পানি প্রবাহের প্রাপ্যতা ধরে নিয়ে এইসব প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। ডালিয়ায় অবস্থিত ব্যারেজ প্রকল্পের ভাটিতে পরিবেশ, প্রতিবেশ, এবং কৃষির উপর এই প্রকল্পের কোন বিরুপ প্রতিক্রিয়া পড়েছে কিনা তা নিয়ে কোন গভেষনা করা হয়নি। এই সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকা অঞ্চলের ৬৩% এলাকা সেচের আওতায় এনে সারা দেশের প্রায় ১৪% ফসল ফলানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এই সেচ প্রকল্পের সাফল্য বেশীদিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ডালিয়ার উজানে, পশ্চিমবঙ্গের গোজালডোবায় একটি ব্যারেজ তৈরী করে ১৯৯৬ সন থেকে শুকনো মওশুমের পানিপ্রবাহের প্রায় ৮৫% সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুরের ১২৬১১০ একর জমি ইতোমধ্যেই সেচের আওতায় আনা হয়েছে এবং সর্বমোট ৩২০০০০ (মতান্তরে ২২৭৭৩৪০) একর জমি সেচের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে তিস্তা সেচ প্রকল্পের মধ্যে অন্য অববাহিকার জমিও রয়েছে, যা কিনা আন্তঃনদী সংযোগেরই নামান্তর। গোজালডোবায় ব্যারেজ নির্মানের আগে যেখানে শুকনো মওশুমে বাংলাদেশে গড়ে ৫০০০ থেকে ৮০০০ কিউসেক পানি আসতো, সেখানে বর্তমানে ২০০০ কিউসেকেরও কম পানি আসছে। এখানে উল্লেখ্য যে, কৃষি কাজের বাইরেও নদীর প্রাকৃতিক কার্য্যক্রম এবং প্রতিবেশজনিত জীববৈচিত্র ধরে রাখার জন্য নূন্যতম প্রবাহের প্রয়োজন হয়, যেটাকে পানিবিজ্ঞানের ভাষায় পরিবেশ প্রবাহ বলা হয়। গভেষকদের মতে, শুকনো মওশুমে তিস্তা নদীর নুন্যতম পরিবেশ প্রবাহের পরিমাণ ৩২০০ থেকে ৯৫০০ কিউসেক হওয়া আবশ্যক। বলাই বাহুল্য যে, বর্তমান প্রবাহের ২০০০ কিউসেক পানি সেচ কিংবা পরিবেশ প্রবাহ এর কোনটির জন্যই প্রতুল নয়।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তিস্তা সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে যেহেতু ইতোমধ্যেই শুকনো মওশুমের প্রায় ৮৫% পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে এবং আরো বেশী জমি সেচের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে, তাদের পক্ষে ৫০ : ৫০ পানিবন্টন চুক্তিতে আসা সম্ভব নয় বলেই কোন চুক্তিই না করা তাদের জন্য লাভজনক। তিস্তা অববাহিকায় বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার আনুপাতিক হার ৭০ : ৩০। সেই হিসেবেও পরিবেশ-প্রবাহের জন্য নুন্যতম ৩২০০ কিউসেক পানি রেখে বাকী পানির ৭০ : ৩০ হারে বন্টন করা যুক্তিযুক্ত। গোজালডোবা ব্যারেজ নির্মাণের পূর্বের ঐতিহাসিক পানিপ্রবাহকে ভিত্তি ধরে নিয়ে ৭০ : ৩০ হারে চুক্তি হলে উভয়পক্ষের জন্য ন্যায় বিচার করা হবে। পানি বিজ্ঞানের সুত্র, আন্তর্জাতিক নীতিমালা, এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তিতেই তিস্তা এবং অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানি বন্টনের সুরাহা হবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা।

মোঃ খালেকুজ্জামান, ভূতত্ত্ব বিভাগ, লক হ্যাভেন ইউনিভার্সিটি, পেনসিলভেনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র