হাচিকোঃ যে ভালোবাসা পুরাণের গল্পকেও হার মানায়

নীলকণ্ঠ জয়
Published : 9 April 2015, 07:56 PM
Updated : 9 April 2015, 07:56 PM

কল্পকাহিনী নয়, সত্যিকারের একটি গল্প বলবো আজ। ভালোবাসার গল্প। মানুষের নয়, মানুষ আর একটি কুকুরের ভালোবাসার গল্প। গল্পটি অনেকেই জানেন আবার অনেকেই বাস্তব গল্পটি নিয়ে নির্মিত ছবিটি দেখেছেন। যারা জানেন, তাদের কাছ থেকে আরো জেনে নিবো, আর যারা জানেন না তাদের জন্য এই পোস্ট।

১৯২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। অন্যান্য দিনের মতই বাড়ি ফিরছিলেন জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটির প্রোফেসর হিদেসাবুরো উনো [ Hidesaburō Ueno ]। ফিরতি পথে হঠাৎ ছোট্ট একটা কুকুরের বাচ্চাকে অসহায়ের মত হাঁটতে দেখে ভারী মায়া হলো তাঁর। বেশকিছুক্ষণ খুঁজেও কোথাও কুকুরের মালিককে দেখতে পাননি তিনি। তিনি হাঁটতে গেলেই কুকুরটাও পিছু নেয় তাঁর।  কুকুরের বাচ্চাটিকে দেখে ভীষণ পছন্দ হয়, মায়া হয় নিজের সন্তানের মতো। অগত্যা বাচ্চাটাকে নিয়েই বাড়ি ফেরেন তিনি।

অন্যস্থানে পড়েছি, তার প্রকৃত মালিক তাকে নিয়ে কোন এক যায়গায় যেতে গিয়ে খাঁচাশুদ্ধ হাচিকে হারিয়ে ফেলে। আর হাচি ভাগ্যের টানে চলে আসে এক স্টেশনে, যেখানে সে একজন প্রফেসরকে খুঁজে পায়, প্রফেসর ট্রেনে করে তার ভ্রমণ থেকে ফিরছিলেন। এত সুন্দর আর অসহায় কুকুরকে দেখে প্রফেসরের মনে মায়া হলো । প্রকৃত মালিককে কুকুর ফিরিয়ে দেয়ার জন্য নানা বিজ্ঞপ্তি দিলেও মালিককে খুঁজে পাওয়া যায় নি। আর এরই মধ্যে প্রফেসরের মনে কুকুরটির জন্য একরকম ভালোবাসা কাজ করে।

প্রফেসরের স্ত্রী মোটেই সহ্য করেত পারতেন না কুকুর। তাই তিনি কুকুরটাকে লুকিয়ে রাখেন ঘরের বাইরে আরেকটি স্থানে। কিন্তু কিছুদিন পরেই স্ত্রীর হাতে ধরা পড়ে যান তিনি। কিন্তু কুকুরছানাটির প্রতি প্রফেসরের ভালোবাসা দেখে স্ত্রীও মেনে নেন কুকুরটিকে। প্রফেসর কুকুরটির নাম রাখেন "হাচিকো" । জাপানিজ ভাষায় "হাচি" অর্থ আট এবং "কো" অর্থ রাজপুত্র।

এই প্রজাতির কুকুরগুলো একটি বিশেষ প্রজাতির, নাম আকিতা। এর উত্পত্তি জাপানে। বর্তমানে এর ২টি প্রজাতি রয়েছে। জাপানিজ আকিতা এবং আমেরিকান আকিতা।

প্রফেসরের বিশ্ববিদ্যালয় ছিল শহর থেকে বেশ দূরে। তাই তিনি ভোরে বেরিয়ে যেতেন এবং স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে চেপে যেতেন বাকিটা পথ। হাচিকোও রোজ যেতো তার সাথে আবার রাতে প্রফেসর ফেরার আগেই এক দৌড়ে পৌঁছে যেত স্টেশনে। সেখান থেকে একসাথে তারা বাড়ি ফিরতো। এভাবেই পরিবারের একজন সদস্য হয়ে উঠেছিলো হাচিকো। স্টেশনের সবাই অল্প কিছুদিনেই চিনে ফেলেছিল প্রফেসরের এই ছোট্ট বন্ধুটিকে।

এভাবেই পেরিয়ে গেল একটি বছর। ১৯২৫ সালের মে মাসের এক সকাল। বরাবরের মতই প্রফেসর বেরুচ্ছিলেন ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করাবেন বলে। কিন্তু সেদিন কেন যেন হাচিকো সকাল থেকেই খুব চিৎকার করছিল। বারবার প্রফেসরের পোষাক দাঁত দিয়ে কামড়ে টেনে ধরছিল, যেন আজ কিছুতেই যেতে দেবেনা তাঁকে। স্টেশনে গিয়েও খুব চীৎকার শুরু করে কুকুরটি। প্রফেসর ট্রেনে উঠে যান। আর ফেরা হয়নি তাঁর। সেরিব্রাল হ্যামারেজ অর্থাৎ হঠাৎ মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যান তিনি।

এদিকে অন্যান্য দিনের মতই হাচিকো রাতে স্টেশনে অপেক্ষা করতে থাকে। অন্যপথে প্রফেসরের কফিন মোড়ানো মরদেহ এসে পৌঁছায় তার বাসায়। কিন্তু হাচিকো অপেক্ষা করতেই থাকে। এর কয়েক দিন পর কুকুরটিকে প্রফেসরের পরিবার বাসায় নিয়ে যায়। কিন্তু হাচিকো কিছুতেই থাকতে চাইতো না। সে এসে বসে থাকতো স্টেশনে, তার বিশ্বাস, প্রফেসর ফিরবেনই! একটু দেরী হচ্ছে হয়তো!

প্রফেসরের মৃত্যুর ৭ বছর পর তাঁর এক ছাত্র জানতে পারে প্রফেসরের এই কুকুরটির এখনো অপেক্ষা করে থাকার কথা। সে শিবুয়া স্টেশনে কুকুরটিকে দেখতে আসে ও আশপাশের লোকজন ও প্রফেসরের বাগানের পুরোনো মালীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে "Tokyo Asahi Shimbun" নামক পত্রিকায় প্রকাশ করে। এর পরপরেই হাচিকোর কাহিনী জাতীয়ভাবে সবার নজরে আসে। এবং সে হয়ে ওঠে বিশ্বস্ততার এক জাতীয় প্রতীকে।

মুভি দৃশ্য অনুসারে, মুভিটির শেষ পর্যায়ে প্রফেসরের স্ত্রী এসে যখন হাচিকে স্টেশনের ঠিক সেই যায়গাটিতে বসে থাকতে দেখে তখন সে উক্তিটি করে , 'Hachi ,You are still waiting'। পৃথিবীটা এমনই মানুষ মানুষকে কিছুদিনেই ভুলে যায় , প্রচন্ড ভালোবাসার বাবার মৃত্যুর শোক ভুলে যায় , কিন্তু কেউ কেউ থাকে যে কখনও আশা ছাড়ে না যে তার ভালোবাসার মানুষটি ফিরে আসবে। এটাই ভালোবাসা যা মানবতার উর্ধ্বে।

এভাবেই কেটে যায় ৯ টি বছর! নিঃসঙ্গ কুকুরটি একা একাই স্টেশনে বসে অর্ধাহারে, অনাহারে কাটিয়ে দেয় তার জীবনের শেষ দিনগুলি ও তার প্রভুর প্রতীক্ষায়।

১৯৩৫ সালের ৮ মার্চ হাচিকোকে সেই রেলস্টেশনেই মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ক্যান্সার ও কৃমিতে আক্রান্ত হয়ে কুকুরটি মারা যায়।

হাচিকোর স্মরনে শিবুয়া রেলস্টেশনে নির্মাণ করা হয় তার ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য। প্রতি বছর ৮ এপ্রিল সেখানে পালন করা হয় শোক দিবস। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে কুকুরপ্রেমীরা জড়ো হন সেখানে।

এছাড়াও এই সত্যি কাহিনীর অবলম্বণে নির্মিত হয়েছে অনেক সিনেমা, যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, রিচার্ড গিয়ার অভিনীত Hachi: A Dog's Tale (অগাস্ট ২০০৯) ও Seijirō Kōyama পরিচালিত Hachi-kō (Hachikō Monogatari, 1987)।

এছাড়া Natural History Museum এ গেলেও দেখতে পাবেন হাচিকোর সংরক্ষিত মমি।

উপরের গল্পটি বিভিন্ন সাইটে পাওয়া যাবে সার্চ দিলে, এই পোস্টটি হাচিকোকে নিয়ে জাপানিদের ভালোবাসা কতটুকু চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করবো।

হাচিকো এবং তাঁর মনিবের কিছু আলোকচিত্রঃ

হাচিকোকে নিয়ে ফিচার, চলচ্চিত্র এবং গল্পঃ

হাচিকোকে নিয়ে আঁকা কিছু ছবিঃ

হাচিকোর সমাধিঃ

যন্ত্রচালিত আধুনিক পৃথিবীতে ভালোবাসা মানেই ক্ষণিকের একটি অধ্যায়। খুব সহজেই মানুষ ভুলে যায় মানুষকে, ভালোবাসার স্পষ্ট স্মৃতিও একদিন ম্লান হয়ে যায় সময়ের স্রোতে ভেসে। হাচিকোর গল্প আমাদের এমন ভালোবাসাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়, হাচিকোর অপেক্ষা আমাদের শিক্ষা দেয় ভালোবাসা ক্ষণিকের নয়, চীরদিনের। ভালোবাসা ঠুনকো কোন বন্ধন নয়, ভালোবাসা সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় বাঁধা একটি সম্পর্ক ।

তথ্য ও ছবিসূত্রঃ
– অন্তর্জালের বিভিন্ন সাইট ও হাচিকোকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন আর্টিক্যাল।