নদী ও নোঙর

নাহুয়াল মিথ
Published : 5 June 2011, 04:55 PM
Updated : 5 June 2011, 04:55 PM

বাংলার প্রায় ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের ভূখণ্ডের আটষট্টি হাজার গ্রাম এই আমাদের বাংলাদেশ। জালের মতো ছড়িয়েছিটিয়ে আছে শত শত নদ-নদী। নদীর আঁকা-বাঁকা গতিপথ গড়ে তুলেছে এক একটি জনপদ। নদীর বাক বদলে বদলায় জীবন। বদলে যায় জনপদের প্রকৃতি, জনপদের বৈশিষ্ট্য।

নদীর জোয়ার-ভাটা খেলায় গড়া বাংলা মায়ের পলল ভূমি। কৃষিজ অর্থনীতির শস্যভান্ডার নদীর আর দান। নদী এই বাংলা জনপদের আশির্বাদ। নদীমাতৃক ভূখন্ড নিরাপদ নৌ-ভ্রমণ যেমন নাগরিক অধিকার নদীর নাব্যতা হ্রাস, নদী-দখল, নদীদূষণের মতো বিপর্যের প্রতিরোধ নাগরিক আন্দোলনও তেমনি সময়ের দাবি।

আবহমান কাল ধরে ঐতিহ্যের লীলা ভূমি থেকে শুরু করে নগর, বন্দর, গঞ্জ সবকিছু গড়ে উঠেছে নদীতে কেন্দ্র করে। পৃথিবীর সুউচ্চ পর্বতমালা ও তাতে সঞ্চিত বরফরাশি কারণে সুবিশাল হিমালয়ের পাদদেশে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর বৃহত্তম পলি সঞ্চিত ব-দ্বীপ বাংলাদেশ। জীবনের উৎস জল আর পৃথিবীর অল্প জায়গায় সবচেয়ে বেশি সুস্বাদু পানিবাহিত ভূমি হওয়ায় বাংলার জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। পানিকে কেন্দ্র করে কৃষি, চলাচল, বাণিজ্য সুবিধাজনক বলে বাংলায় পৃথিবীর বিভিন্ন নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সমাবেশ ঘটেছে বিগত শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে। সবকিছু ভালোভাবেই চলছিল। বিপত্তি লাগল তখনই যখন মানুষ নদীকে বাধাগ্রস্থ করে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে অধিক সুবিধা নেয়া শিখল।

বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীর বুকে মানুষ ৪৫,০০০ বারের চেয়েও বেশি বার বাঁধ নির্মাণ করে জনপদ ধ্বংস করেছে। উদাহরণ হচ্ছে চীন, ভারত, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র। হিমালয়ের বেশির ভাগ পানি বঙ্গোপসাগরে নিপতিত হওয়ার আগে প্রবাহিত হয় বাংলাদেশের উপর দিয়ে। গঙ্গার উপরে ভারত কর্তৃক অবৈধ ও অনৈতিকভাবে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের ৫ কোটি মানু্ষের জীবিকা ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্থ করেছে।

ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা ৫৪ নদীর মধ্যে ৫৩ নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে ভারত। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের তোয়াক্কা না করে আবার নির্মাণ করছে টিপাইমুখ বাঁধ। আশঙ্কা করা হচ্ছে এতে বাংলাদেশের ৮ জেলার ৩ কোটি মানুষের জীবিকার সংস্থান বিনষ্ট হবে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে কিছু ৩ অ-দেশপ্রেমী, যারা নদী দখলকারী, ভূমিদস্যু, নদী দূষণকারী হিসেবে কুখ্যাত।

নদী-নালা খাল-বিল ভরাট ও জবর দখল করে যারা বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ তৈরি করছে প্রতিনিয়ত, সমাজ আজ তাদের ভয়াল থাবায় ক্ষতবিক্ষত। বছরের পর বছর অবৈধ, সম্পত্তির পাহাড় গড়ে আজকের এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। তাই আজ প্রয়োজন নদী-নালার নাব্যতা ও প্রতিন্ধকতার প্রতিরোধ গড়ে তোলা। বিবেক প্রতিবন্ধী ভূমি চোর ও ডাকাতের কাছে নদীপাড়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠী আর বন্দী থাকতে পারে না। প্রয়োজন যথাযোগ্য নয়, অবশ্যম্ভাবী শক্তিশালী সিদ্ধান্ত।

রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত তাদের সাথে সম্পৃক্ত নদী চোর নদী দস্যুদের বহিষ্কার করা। অবশেষে এটা বলা জরুরি যে, টেকসই উন্নয়ন ও জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে নদী মুক্ত করতে হবে। জীবনের উৎস গানি, আর একে যারা বাঁধাগ্রস্ত ও দূষিত করে তারা মানব সমাজে বসবাসকারী দানব, দৈত্য ও জানোয়ার। নদী ও দেশেকে দস্যু মুক্ত করি। নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে বাঁচবে কৃষি, বাঁচবে মানুষ। দেশ মাতার সর্ব বিপর্যয় রোধে সর্বাত্মক জাগরণের কর্মসূচি নিয়ে সংগ্রামনহীন সামাজিক সংগঠন নোঙর সর্বদা অঙ্গীকারাবদ্ধ।

বাঙালির হাজার বছরে ঐতিহ্য-সমৃদ্ধির পুরোটাই নদীকেন্দ্রিক। এদেশের ছোট্ট ভূখণ্ডের বিশাল জলভাগ-নদ-নদী, হাওড়, বাওড়, দিঘি-নালা এদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ। অথচ প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে নৌ-দূর্ঘটনা যেমন আমাদেরকে শোকাভিভূত বা বাক-রুদ্ধ করে তেমনি নদীর নাব্যতা হ্রাস এবং নদীদখল ও নদী-দূষণ চরম পরিবেশ বিপন্নতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে আমাদের। আমরা নিরাপত্তাহীন ও শঙ্কিত।

বিগত চার দশকে ২০ হাজার কিলোমিটার নদীপথ হারিয়েছে এদেশের মানুষ। প্রতিবছর সহস্রাধিক মানুষের সলিল সমাধি হচ্ছে নৌ-দুর্ঘটনায় । নদী-দখল ও নদী-দূষণ চরম পরিবেশ বিপর্যয়ে ফেলছে এদেশের মানুষকে।

নদী ও নিরাপত্তার সামাজিক সংগঠন নোঙর এর দাবি, নদী-দখল ও দূষণকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করা হোক। নদী-দখল ও দূষণকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। এখনি সময় নদী বিষয়ে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতনতা গড়ে তোলার। তা না হলে জাতি হিসেবে আমরা হবো বিপন্ন, ভূখ- হবে নিশ্চিহ্ন। কারণ উজানের পানি যদি ভাটিতে তার স্বাভাবিক গতিতে নেমে যেতে বাধাগ্রস্ত হয় তাহলে এই ভূখণ্ডে বঙ্গোপসাগরের লবনাক্ত পানির আধিক্য বাড়বে। তাতে এ অঞ্চলের ভূখন্ড মনুষ্য বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে।

****
(লেখাটি- নোঙরের প্রচারপত্রের অংশবিশেষ)

একটি নদীর ওয়েবসাইট – নদীমাতৃক