মালালা ইউসুফজাই পাকিস্তানের একজন সাহসী বীর-কিশোরী

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 12 Oct 2012, 05:37 PM
Updated : 12 Oct 2012, 05:37 PM

বীরত্ব আদতেই রক্তের মধ্যে থাকতে হয়। নইলে যে দেশে প্রতিনিয়ত ধর্মান্ধতা-কূপমন্ডুকতা এমন কি জঘন্যতম ব্লাসফেমি আইন-এর শিকার বানানোর অন্যায়-অনাচার চলছে সেই দেশের এক কিশোরী তালেবানদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় ! অসীম সাহসের সঙ্গেই লড়াই চালায় ! মালালা-র বাবার উতসাহে মালালা ২০০৯ সাল হতেই তালেবানদের অন্যায়-এর বিরুদ্ধে বিবিসি-র ওয়েব-ব্লগে লিখতে শুরু করেই লিখে (উর্দুতে) –

"আজ ছুটির দিন। দেরীতে ১০টার দিকে ঘুম থেকে জেগে বাবাকে বলতে শুনি – 'গ্রিনচকে আরও ৩টি মরদেহ পড়ে আছে।' খবরটা পড়ে আমার মন খারাপ হয়ে যায়।" (৩জানুয়ারী ২০০৯)

"তালেবানের ভয়ে শিক্ষকরা আমাদেরকে উইনিফর্ম পরে স্কুলে যেতে নিষেধ করেছেন। তাই আমি আমার প্রিয় গোলাপী পোশাকটা পরেই স্কুলে যাই। অন্য মেয়েরাও রঙিন পোশাক পরে। স্কুলটা বাড়ির মতোই মনে হয়েছে।" (৫জানুয়ারী ২০০৯)

"স্কুলে যেতে-যেতে আজ মনটাই খারাপ হয়ে গেল। কারণ। কাল থেকে স্কুলে শীতকালীন ছুটি। কিন্তু প্রিন্সিপ্যাল স্কুল ছুটির ঘোষণা দিলেও কবে স্কুল খূলবে সে বিষয়ে কিছুই বলেন নি।" (১৪জানুয়ারী)

মালালা তখন নিতান্ত ছোট। অথচ তখন থেকেই সে টার্গেট হয় তালেবানের। সে সময় তালেবানরা সোয়াত অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। প্রথমেই তালেবানরা নারীদের 'পরেই নিষেধাজ্ঞা জারি করে ও রাতারাতি চারশো মেয়েদের স্কুল বন্ধের ঘোষণা এবঙ মেয়েদের বোরকা ছাড়া বাইরে বেরুনো নিষেধ করে দেয়। নিষেধ-এর অমান্য মানেই কঠিনতম শাস্তি। অর্থাৎ মৃত্যুদন্ড ! এবঙ সাজাপ্রাপ্তদের শিরোচ্ছেদকৃত মৃতদেহকে ঝূলিয়ে রাখতো শহরের প্রত্যেক মোড়ে-মোড়ে ! অন্যরা যাতে শাস্তির ভয়ঙ্কর পরিণতির অবস্থাটি দেখেই তালেবানী শাসন অমান্য করার সাহস না পায়। কিন্তু মালালা অসীম সাহসে তালেবানী শাসন-এর বিরুদ্ধে কলম চালায়। দমবদ্ধকর অন্যায় বিশেষতঃ মেয়েদের উপর আরও কঠিনতম নিষেধাজ্ঞা আরোপ-এর বিরুদ্ধে নিয়মিত লিখতে থাকে মালালা তার ব্লগেই। স্কুল বন্ধের নির্দেশ অমান্য করে মালালা লেখে –

"আমি পড়ালেখা করব, করবই। স্কুলে, ঘরে। অন্য কোনওখানে, কেউ তা বন্ধ করতে পারবেনা।"

মালালা তখন-ই তালেবানের রোষানলের টার্গেট হয়। তালেবানরা মালালা-র জন্য ফতোয়া জারি করে এবঙ তা মাথায় করেই মালালা-র লেখাও অব্যাহত চলতে থাকে। মৃত্যুদন্ডাদেশের ফতোয়া স্বত্বেও মালালা-র বীরত্বগাথা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তাই, মালালা হয়ে ওঠে অনেক পড়ুয়ার আদর্শ সাহসী বীরের কন্ঠস্বর। যদিও পাকিস্তান সরকারের লোকজন কেউ-ই মালালা-র রক্ষার জন্য কোনও উদ্যোগ-ই নেননি তালেবানদের ভয়েই। জঙ্গীবাদ এবঙ বহুবিধ ধর্মান্ধ কূপমন্ডুকতা পাকিস্তানের এক পশ্চাদপদ সামাজিক সমস্যা। যেখানে আবদ্ধ সরকার সমেত গোটা সমাজ। কিন্তু মালালা তার লেখনী দিয়েই আন্তর্জাতিকভাবে সাহস-এর প্রতীক রূপে অর্জন করে বিশেষ মনোযোগ। এবঙ আন্তর্জাতিক চাপে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও অভিযানে নামতে বাধ্য হয় ও মালালা-র প্রতিকুলতা ডিঙিয়েই ২০১১ তে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ শান্তি পুরস্কার পাওয়া হয় যা পাকিস্তানের মতো পশ্চাদপদ বহুবিধ ধর্মান্ধ অনুশাসনে আবদ্ধ দেশে একটি আশ্চর্য অধ্যায়।

অল্প আগেই যে দেশে আরেক প্রতবন্ধী কিশোরী ব্লাশফেমি আইন-এর শিকার হয় এবঙ তা নিয়েও আন্তর্জাতিক মিডিয়া প্রবল আলোড়িত হয়ে ওঠার ফলে মামলা দায়ের সম্ভব হয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে যে প্রতিবেশি ইমাম ধর্মীয় বিদ্বেষজাত হীনস্বার্থে কিশোরী প্রতিবন্ধী রিমশা মাশিহ-র ব্যাগের ভিতর পবিত্র কুরআন-এর পোড়ানো পৃষ্ঠা ঢুকিয়ে দিয়ে রিমশা মাশিহ-কে ব্লাশফেমি আইন-এর মাধ্যমে গ্রেফতার করায়। প্রতিবন্ধী মেয়েটি অন্যায় হাজতভোগ করে। এবঙ অবশেষে আন্তর্জাতিক চাপের মুখেই নাটকীয় মুক্তির পরেও নিরাপত্তার অজুহাতে সশস্ত্র সামরিক বুহ্যের ভিতর হেলিকপ্টারে করে অজ্ঞাতবাসে নেয়ার দৃশ্যটি টিভি ক্যামেরা ধারণ করায় আমরাও দেখতে পাই। তখন আবারও আন্তর্জাতিক চাপে রিমশা মাশিহ-কে পরিবারের কাছে ফেরত দেয়া হয়।

এমন এক দেশের অধিবাসী হয়েও অকুতোভয়ে লড়াই চালানোর সাহস দেখিয়েছে মালালা। এমন কি সর্বোচ্চ শান্তি পুরষ্কার পর্যন্ত ছিনিয়ে নিয়েছে। তালেবানরা তার-ই প্রতিশোধ নিয়েছে মালালা-র স্কুলের বাসে হামলা চালিয়ে। মালালা মারাত্মকভাবে মাথায় গুলিব্বিদ্ধ হয়েই মৃত্যুমুখে পতিত হয় ৯ অক্টোবর ২০১২ তে। হাসপাতালে ডাক্তার-সার্জনদের নিবিড় পরিচর্যায় সর্বশেষ সংবাদ যে মালালা-র জ্ঞান ফিরেছে। আজ সবার প্রত্যাশা মালালা তালেবান জঙ্গীদের সমস্ত রোষানল-হামলা থেকে বেঁচে ওঠা অদম্য সংগ্রামী সাহসী চেতনার অনন্য নাম। সে বেঁচে থাকবে সবার প্রত্যাশায় এবঙ নিজস্ব জোরেই। তালেবান জঙ্গীরা আবারও হুমকি দিয়েছে যে – মালালা কিছুতেই রেহাই পাবেনা তাদের শাস্তিদন্ড হতে, আবার মালালা-কে হত্যার চেষ্টা চলবে, মালালা-র হত্যা না হওয়া পর্যন্ত তারা হামলা চালিয়েই যাবে। আমরা বিশ্বাস করি যে – মালালা-কে তালেবানরা আর সহজে হামলা করতে পারবেনা। কেননা, মালালা-র পাশে এখন গোটা বিশ্বের প্রগতিশীল রাষ্ট্রের সমর্থনা। মালালা নিজস্ব স্বপ্নের কথা ব্লগেই লিখেছিলো –

"এমন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করব যেখানে প্রধানতঃ থাকবে শিক্ষার প্রসার।"

মালালা-র স্বপ্নপূরণে নিশ্চয় অংশী হবে অনেক শিক্ষা-বঞ্চিত বালিকারা। আমার হার্দিক ইচ্ছেরা আজ উড্ডীন সেই স্বপ্নের দিকেই যে – আরও হাজার মালালা জন্ম গ্রহণ করুক জগতে। যাদের সাহসী উচ্চারণে – সাহসী পদক্ষেপে – সকল ধর্মান্ধতা সকল কূপমন্ডুকতা উড়িয়ে জয়বার্তা ঘোষিত হবে জগতে ..
আহ, আমার দেশেও হাজার মালালা জন্ম গ্রহণ করুক .. নতুন জয়বার্তায় হৃদি ভরুক।

অভিনন্দন মালালা ! অভিনন্দন হে বীর কিশোরী মালালা !

( তথ্যসূত্র – অনলাইন নিউজ। )