বলি যে- জীবনভাই, দাঁড়াও, যমদূত পাঠিও পরে

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 3 Jan 2013, 06:16 PM
Updated : 3 Jan 2013, 06:16 PM

আমাদের চারপাশেই কিন্তু এখন ক্যামন অচেনা অজানিত জীবন-জগত-অন্তর্জালের চাপ। সে চাপ সয়েই জীবন-জগত-অন্তর্জালের ডাক – উপেক্ষা করা কঠিন। বলা যেতেই পারে – এ এক "কঠিনেরে ভালোবাসিলাম" যেন বা।

এইতো এই যে আমি ছাপ্পান্ন অতিক্রম করার পথে – এতোটা বয়স মানেই অনেকটা পথের শেষপ্রান্তে – ষাটের বয়স ছোঁয়ার মতো অবস্থা। আজকাল প্রায়ই তাই আমার আজন্মের বাংলাদেশ আর জীবন ছুঁয়ে মনেমনেই আ-সবুজ মাঠের ঝিলে গণ্ডোলা ভাসানোর চেষ্টায় মেতে উঠতে চেয়ে ধাক্কায় আবার ফেরত আসি নিজের বৃত্তবন্দী জীবনে ! চুপিচুপি বাতাস এসে জানান দেয় – "তুমি তো হদ্দবোকা ! দাঁড়িয়ে আছো জঞ্জালভর্তি বাঁধের কিনারে – বাংলাদেশ আজ তোমার সেই আদ্দিকালের খেরোখাতায় কাব্যিক হৃদিগাথাভর্তি সোনার তরী নাকি যে হৃদয় ভাসাবে!"

সত্যিই তো – নিজেকে হদ্দবোকার ধাড়িই লাগে তখন। নইলে কি আর এই বয়সে এসে এমন করে বাংলাদেশ বলতেই হৃদয় জাগে! বয়স যখন ষাটের কাছাকাছি – তখন হৃদয়ের রাসটি টেনে ধরাই ভালো। কখন কি আপদ-বালাই-এর ছলেই যমদূত দাঁড়ায় শিথানে ! হেঁচকা টানে অচিনপুরে পৌঁছিয়ে তবেই ছাড়ে ! বলাতো যায়না ঘাপটি মেরে অন্তর্জালেই বসে আছে কি নেই ! আমি তো জ্যোতিষ নই ! বাংলাদেশ বলতেই এতোটা উদ্বেলিত উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া মোটেও উচিত নয় আমার এই বয়সে – এই কথাটি ভেবে যতই রাস টানতে চাই – ততই কি এক আশ্চর্য বোধ আমায় প্রায় উড়িয়ে নেয় বোধের গন্ডোলায় ! ছাপ্পান্ন বয়সকে সবুজে ভাসিয়ে এপার-ওপারের কাঁটাতারের বাঁধ থোড়াই কেয়ার করেই হৃদি উড়ালপঙ্ক্ষী ! এই ওড়াউড়ির খেলায় ভেসেই কালিদাস রচেছিলেন "মেঘদূত।" পূর্বমেঘ-উত্তরমেঘ-এর সে এক কালোত্তীর্ণ অরূপ উপাখ্যান। কবিগুরুও দিব্যি "ভানু সিংহের পদাবলী" -তে ছদ্মনামেই –

"মরণরে তুহুঁ মম শ্যাম সমান"

লিখেই চিত্তজয় করতে পেরেছেন যোজন দূরের পাঠকদের। আমার তেমন বিদ্যে নেই যে ছদ্মনামে লিখেই চিত্তজয় করবো। লিখি নিজস্ব তাড়নায় কিছুটা, কিছুটা নিজস্ব দায়বোধ হতেই। আজকাল অনেকে ব্লগ লেখার বদৌলতে দুহাতে লিখছেন। আবার একহাত দেখাতে ছাড়ছেন না মন্তব্য করবার সুযোগে। সকলে না। জীবনানন্দের ভাষায় তাদের বলি – "কেউকেউ।" আমার মাঝেমাঝে এমন লাগে – যেন বা – ফেউ। আবার অনেকেই দারুণ সম্ভাবনাময় লেখনী চালাচ্ছেন – লেটেস্ট বিষয়াদি জোরালো ভাষায় উপস্থাপনা করছেন। পড়েই বেশ প্রাণিত হই। মন্তব্য করি। অথচ অই যে যাদের "কেউ-কেউ" বলেছি – তারা অযথা মন্তব্যের সুযোগে এমনই বক্রোক্তি-কটুক্তি-অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেই বসেন যা অত্যন্ত অনুচিত শুধু না, অন্যায়ও। তারপরেও আমরা জবাব দিই তাদের বোধোদয় হউক ভেবে। কিন্তু না, দলবাজির দাপট এমনই – সেখানে "কেহ কারে নাহি ছাড়ে" অবস্থা। এই অবস্থা সয়েই লিখছি। এইখানে আমরা প্রবীনরা নবীন-নবিসিদের সঙ্গেই একই কাতারে বসে লিখছি। বিশ্বময় রাজনৈতিক তাপ-উত্তাপ সকলের মধ্যেই অল্প-বিস্তর ছড়াবেই। এবঙ সেটি স্বাভাবিকও। অস্বাভাবিক যা – তা এই যে – রাজনৈতিক কারণটি যখন মাত্রাছাড়া আক্রমণাত্মক-হুমকি-ধমকির পর্যায়ে যায়। বাংলাদেশে আজ রাজনৈতিক অবস্থানগত দৃষ্টিভঙ্গিটি বড়ো অসহিষ্ণুতাময়। যেটি লেখালিখির বেলায় প্রয়োগ বড়ো অনাকাঙ্ক্ষিত। দলবাজ ব্লগার মতের বাইরে কেউ লিখলে সেইখানে অনাকাঙ্ক্ষিত-অযাচিত মন্তব্য না করলে কি হয় ! ছদ্মনামধারী অনেক অতথি কি সব অদ্ভুতুড়ে নামের অধিকারী – "যামিনী-কামিনী-জল্লাদ৭১-বাংলাভূত" ! এই বয়সে অদ্ভুতুড়েদের কিম্ভুত মন্তব্যের জবাব দিচ্ছি ! ভাবতে আমাকে আমার মতো লাগেনা কিছুতেই। যেন বা আমি ভূতপ্রেতের মাঝে একাকী যুদ্ধ করছি !

অন্যদিকে জগত জুড়ে এবঙ বাংলাদেশেও আমারই চারপাশের ঘটমান ব্যাধ ও ব্যাধির দাপট। মানুষ নামের অমানুষিক জান্তব-পাশবিক উতপীড়ন। যন্ত্রণায়-বিবমিষায় জীবনের যা কিছু সুন্দর নিমিষে বিষাদিত হয়েই জীবনকে থামিয়ে দেয়। তবুও যতক্ষণ মৃতের তালিকাভুক্ত না হচ্ছি – ততক্ষণ অমানুষিক পাশবিকতার বিরুদ্ধে আওয়াজ না তুলে পারি ! যদিও জানি, আমার বিন্দুমাত্র ক্ষমতা নাই পশুত্ব থামাই, তবুও আমি আমার এই মধ্যবয়স অতিক্রান্ত করেই বলি যে – জীবনভাই, দাঁড়াও, যমদূত পাঠিও পরে – আমার আরও লিখার বাকী – আমায় লিখতে দাও – শাস্ত্রীয় বাণী মন্ত্রোচ্চারণ-এর মতোই জপি –

"রে ব্যাধ, তোর বিস্তার হবেনা দেখিস" –

জপছি, জপছি, জপেই যাচ্ছি – জানিনা, জগতের মানুষ নামের পশুরা এ জীবনে নরকে নিক্ষিপ্ত হয়েই জ্বল্বপুড়ে নরকভোগ করবে কি না – জানিনা, পৃথিবীর আদালতেই তাদের দোজখ নির্ধারিত হবে কি না – তবুও চাই পিশাচ অসুরিক মানুষ নামের মানুষগুলোর যাবজ্জীবন দোজখবাস দেখুক সবাই। আজ আমার এরচে' অধিক বলবার নাই।

৪ জানুয়ারী ২০১৩ ইং