চৈত্রশেষের বাজনা শেষে পহেলা বৈশাখের ধুমতানানা

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 13 April 2015, 05:14 PM
Updated : 13 April 2015, 05:14 PM

চৈত্র শেষের দিন মানেই নতুন বছর এলো দুয়ারে আবারও। এবঙ নতুন ভোরের সূর্যালোক জানান দেয় এসেছে বৈশাখ আবারও। পহেলা বৈশাখ মানেই মেলা। সে এক প্রাণের মেলার গন্ধে বাতাস জুড়ে আবহমান বাংলার প্রাচীন ডাক। কবিগুরুর – "এসো হে বৈশাখ এসো, এসো"-র ডাক। বতসরের আবর্জনা, বেদনা দূর হবার, ধুয়ে দেবার মনোবাঞ্ছা সবার প্রাণে জাগিয়ে দিয়ে যাবার বাঙালির এ যেন একটাই গানের ভাষা। দেশে-বিদেশে যে যেখানে সেখান হতে জানায় শুভকামনা প্রিয়জনের তরে, সবার তরে। এ যেন এই দেশের অন্তর্গত একটি সুপ্রাচীন বাঙালি বোধ। জগতে আর কোথাও নেই এমন বোধ।

এদেশে শত বিরোধ-বিরোধীতার বিভাজনের মধ্য দিয়েই আজ ১৪২১ বঙ্গাব্দ শেষের বার্তা এসেছে নতুন বছর বরণের পহেলা বৈশাখ পালন করবার প্রাচীন রেওয়াজের মতোন। এই বঙ্গদেশে বাঙালিরা বাংলা বছর বরণে কোনও জাতপাতের ধার ধারেনা। চৈত্র সংক্রান্তিতেও যেমন অনেক সুপ্রাচীন রীতির চল মেনেই বাঙালিরা রোগবালাই মুক্তির আশায় বহুবিধ নিরামিষ ও তেতো শাকের ব্যাঞ্জন সপরিবারে খায়, তেমন নতুন বছরে বহুবিধ আমিষ, মিষ্টান্ন, ইলিশ, পান্তা, মোয়ামুড়কি, কাচাআম, কাঁঠালে সাধ্যমতো আপ্যায়নের আয়োজন করতে ভালোবাসে। দেশের সর্বত্র মেলার আয়োজনে সর্বস্তরের মানুষ লাল-শাদায় সেজে বর্ষবরণ করে। বিদেশিরাও বাংলার মেলার এই প্রাণের সন্মিলনে সতঃস্ফূর্ত যোগদান করছে – এরকম ছবিতো বাস্তব এখন। তরুণীরা, কিশোরী, শিশুকন্যাটিও এমন দিনে দারুণ লাল-শাদা শাড়িতে সেজেগুজে যখন বিনুনীতে, খোঁপায় গুঁজে গোলাপ-গাঁদা-যূথিকা-জবা অথবা বেলী – কি অপরূপা – বাংলা ছাড়া কোথায় আছে এমন ! ছেলেরাও কম না কিন্তু । এমন দিনে বাঙালি ছেলেরাও বাঙালিয়ানায় পিছিয়ে নেই। পহেলা বৈশাখে এদেশ যেন নতুন করে শাদায়, লালে শোভিত হয়ে সকল দহন ভুলতে নতুনের অবগাহনে, আবাহনীতে হৃদয় হতে হৃদয়ে বাঙালি ঐতিহ্যকেই চারিয়ে, ছড়িয়ে দেয়। জাগিয়ে দেয় সকল ধর্মাধর্মের ঊর্ধ্বের জাতিগত, শিকড়গত গর্বিত বাঙালি বোধ। এ বোধ, এ ঐতিহ্য অহংকার আমাদের। আমরা নতুন বছর এলে আমাদেরই বাঙালি বোধনে শুচিশুদ্ধ হবার আয়োজনে জগতে সাড়া জাগানো বাংলা নববর্ষ বরণে কার্পণ্য করিনা কেউ। যদি না বিজাতীয় কোনও অধর্মের আদেশে অন্ধ ধর্মান্ধ মানুষ নামের অমানুষ হই। আদতে বাঙালি মায়ের গর্ভজাত বাঙালি কিছুতেই নিজের বাঙালিত্ব ভোলেনা। ভুলতে পারেনা। পৃথিবীর যেখানে যত বাঙালি অন্তর্গত তাড়না হতে পহেলা বৈশাখ বরণ করে – "এসো হে বৈশাখ এসো, এসো"-র সার্বজনীন বাংলা নববর্ষ বরণ-এর গানটি গেয়ে মেলায় যাবার বাসনা রেখে হৃদয়ে জ্বালে আলোকবাতি। এভাবেই বাঙালি জাতিসত্তা আলোর যাত্রী হয়েছে যুগেযুগে। আগামী দিনেও হবেই হবে। এদেশে আজ শিকড় গেড়ে যেসব ধর্মান্ধ ফতোয়াবাজ মহা মুসলমান হয়ে ওয়াজ-নসিহতরত, অযথা অযাচিত হামলে পড়ে বাঙালি দাবাতে খায়েশ রাখে আজও – আজ তাদের উচিত জবাবদিহিতার মুখোমুখি হবার। কারণ পহেলা বৈশাখ পালন মানে মুসলমান পৌত্তলিকতার পূজারী হওয়া নয়। পহেলা বৈশাখের মেলায় গেলে, "এসো হে বৈশাখ এসো, এসো"-র সুরে নিজের গলা মেলালে জাত যায় না মুসলমানের। এই সহজ সত্য একাত্তুরেও ওরা বোঝেনি। বুঝবে না কোনওদিন। সুতরাং ওদের কাছে বাংলা খাবার হারাম হবে সে আর আশ্চর্য কি !!!

ওরা যে যে কোনও ছুতানাতায় বৈশাখী মেলায় অংশীদের আক্রমণও করে বসতে পিছ পা হবে না – এই ধারণা মিথ্যা বলতে পারা যাবেনা। অনেক আলামত ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান এদেশে। সেই রমনা বটমূলে ধারণাতীত বোমা হামলা এদেশের বাঙালি ভোলেনা আজও । এরপর উদিচী বোমা। সবই বাঙালিয়ানা বিদ্বষজাত চিত্র। ভাবতে গিয়ে আমার তাই হৃদয় বৈশাখী ঢাকের বাদ্যে কিছুটা শঙ্কা তাড়িত। তবু নতুন বছর ১৪২২ বঙ্গাব্দ সবার শুভ বোধের, সুন্দরের
পরিচর্যা ও পরিশীলন জাগিয়ে দিয়ে দেশের প্রতি, দশের প্রতি ভালোবাসাকে নতুন করেই উজ্জীবিত করুক – এই চাওয়া আজ।

এই যে আবার বাংলা ক্যালেন্ডারে সূচিত হলো নতুন বছর ১৪২২ বঙ্গাব্দ – বাংলাদেশ যেন নতুন বছরে সকল জরা, সকল জঙ্গীবাদমুক্ত বাংলাদেশ হয় – এমন চাওয়া নিয়েই আমাদের। ১৪২১ -এর সকল অনাকাঙ্ক্ষিত আগুনে পোড়া দহন-বেদন ১৪২২ বঙ্গাব্দে আমরা যেন এদেশ হতে হটাতে পারি চিরতরেই – আসন্ন নতুন বছরের নতুন ভোরের আলোয় স্নাত হবার তরে, সবার তরে শুভকামনা শুধু এইটুকুই।

৩০ শে চৈত্র। ১৪২১ বঙ্গাব্দ।
ঢাকা। বাংলাদেশ।