জীবনে প্রথম তাজমহল দেখা দু’জনে

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 25 June 2015, 06:36 PM
Updated : 25 June 2015, 06:36 PM


ক্যাপশন: যমুনাতীরে  সে  এক  তাজমহল !

ভ্রমণ পর্ব -১।
***********

তখন বয়স আমার চৌত্রিশের কোঠায়। স্বামী হঠাত পাসপোর্ট করিয়ে দিলেন আমার। প্লান ভারত ভ্রমণের। জীবনে প্রথম পাসপোর্টটি পাওয়া আমার। অভূত সে এক রোমাঞ্চিত বিষয় বটে। তখন তিন ছেলেমেয়েই ইস্কুল পড়ুয়া। ভিসা পাওয়া হলো। ছেলেমেয়ের পরীক্ষার কারণে ওদেরকে ওদের চাচা-ফুপুর কাছে রেখেই আমাদের যাওয়া ঠিক করতে হলো। মনটা একটু খারাপ হলো। আহারে, আমাদের ছেলেমেয়েরা গেলে ভারত ভ্রমণ কত না আআনন্দযাত্রা লাগতো। তবু, বাড়ির সবাই এবঙ ছেলেমেয়েরাও আমাদেরকে উতসাহ দিলো – 'দশটা দিনের বিষয় মাত্র। কোনও সমস্যা হবেনা আমাদের ইনশাহআল্লাহ। তোমরা নিশ্চিন্তে বেড়াতে যাও।' তো, আমাদের ভারত ভ্রমণে যাওয়া – নভেম্বরের শেষভাগে ১৯৯২ সালে।

জীবনে প্রথমবার দেশের বাইরে যাওয়া। বিদেশ ভ্রমণ। মন একটু উচাটন ছেলেমেয়ের জন্য। তবুও দমদম বিমান বন্দরে নেমেই ভালোলাগা জড়িয়ে ধরলো বেজায় উতসাহময়তায়। হঠাৎ আকাশ ভ্রমণ শেষে মাটিতে খোলা হাওয়া পেয়ে গভীর ভালোলাগা সে এক। গমগমে বিমান বন্দরের চেকিং পর্ব, লাগেজ লাইনে দাঁড়ানো, মালপত্র ট্রলিতে উঠিয়ে একটা মারুতি ট্যাক্সি নেওয়া। উঠলাম নিউমার্কেটের পাশের এক হোটেলে। পুরনো হোটেল। জমিদার বাড়ির সেকেলে ধাঁচের। জানলায় কাঠের খড়খড়ি লাগানো। টান দিলেই ফাঁকফোঁকড় গলে বাতাস ঢোকে শ্যামলা ফুরফুরে। এবঙ বেশ সরগরম চারপাশের বিপনী হতে লোকজনের হাঁকডাকের আওয়াজও ঢোকে যেন বা পরিচিত কারও … অনেকটা আমাদের পুরান ঢাকার মতোন। আশ্চর্যের যা তা এই হোটেলের পাশের সড়কের নামটি সদর স্ট্রীট। তখন ঢাকার সদরঘাট মনে পড়লো। আলো, হাওয়া একইরকম। এমন কি পাখির ডাকও একই। তাই কি সে গান –

"একই আকাশ একই বাতাস
এক হৃদয়ের একইতো শ্বাস।
দোয়েল, কোয়েল শ্যামার ঠোঁটে একই মূর্ছনা।
ও আমার দুই চোখে দুই জলের ধারা মেঘনা যমুনা।"

এমনই অনুভবের আতিশয্য ঘিরলো ধরে কোলকাতার গন্ধে। যাহোক, একটু জিরিয়ে কোলকাতা দেখতে বেরুলাম দুজনে। হেঁটেহেঁটে আশপাশের অনেক বিপনী দেখলাম । দারুণ লাগলো আমার চৌরঙ্গী। কত যে বইপত্রে পড়েছি চৌরঙ্গীর নামটি। রাজকীয় দোকানপাটগুলি। আমাদের দারুণ 'উইনডোশপিং' হলো। আমার স্বামী আমাকে কোলকাতার কলাপাতায় মোড়ানো অসাধারণ স্বাদ "চউমিন" খাইয়ে লোভ লাগিয়ে দিলেন। এবঙ কোলকাতার চা যে কাচের গেলাসে / মাটির ভাঁড়ে কতটা টেস্টি সে এক "মাশালা চা" যে পান করেনি, কোনওদিন বোঝানো যাবেনা তারে। গেলাম নিউমার্কেট ও এসি মার্কেটেও। ফেরার পথে তরতরিয়ে নামছিলাম – হোঁচট খেয়ে ধপাস পথে। তখন বুঝিনি তেমন। ঝটপট উঠেও গেছি। হোটেলে ফিরে পেলাম টের কোমরে, পায়ে ভালোই ব্যাথা পেয়েছি। ব্যাথার ওষুধ কিনে দিলেন স্বামী। গরম পানি ঢালা ও ওষুধ খেয়ে কমলো খানিকটা।

পরের দিন চড়েছি "রাজধানী এক্সপ্রেস" এ দিল্লীর পথে। বলতে গেলে বাংলাদেশের কোনও রেলযাত্রা এতটা আধুনিক আজও হতে পারেনি। হয়তো আরও বহুকাল লাগবে আন্তর্জাতিক মানের রেলপথ / রেলের সংযোজনা ঘটাতে বাংলাদেশের। মনেমনে ভাবি যে – হবে … হবেই একদিন বাংলাদেশেও এমন একখানা "বাংলা এক্সপ্রেস"! খানিক পরে গুছিয়ে বসতেই বাজলো হুইসেল রেলের। পরে টয়লেটও ঘুরে এলাম। ঝকঝকে টয়লেটের আধুনিক ব্যবস্থা। রেলও চলে … রেলের খাওয়ার পালাও চলে … দেখি যে চা-পানীয়-জলখাবার-লাঞ্চ-ডিনার – এক কথায় লোভনীয় আইটেমের সমাহার। খাবার পরের ডেজার্ট কুলফি – বাদাম-মালাই স্বাদে – আহাহা !

সে যাত্রায় রেলেই পরিচয় একটা বুড়ো গ্রুপের সনে। উনারা দিল্লীর একটা কনফারেন্সে যোগদানের আমন্ত্রিত অতিথি। পাঁচজন উনারা, পাঁচবন্ধু। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সাগরেদ ছিলেন। ঘনিষ্ঠ সহচরের মতোন। গল্পচ্ছলে উনারা গল্প করেন – কত সাহসী উনাদের তখনকার এক একটা পাহাড়সম অভিযাত্রার। যা শুনে আমাদের খুবই মনে ধরলো বুড়োদের।   উনাদের আশির কোঠার বয়েসী তারুণ্যকে বিষম ভালো লাগলো। ওমা, হঠাৎ পাঁচবন্ধু মিটিমিটানো হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে – একজন বলেন – "তুমিতো দেখতে অবিকল আমাদেরই রাজকুমারীর মতোন"! আমি কি আর বলি ! আমার স্বামী জবাব দেন – "হ্যাঁ দাদা, সে একটু দেখতে অমনই, তাইতো বিবাহ আমার সনে"। উনারা হাহাহাহাহা হাসেন প্রাণখোলা। আমার প্রথম কবিতাবই " শ্যাওলায় রেখেছি পা" কয়েকখানা ব্যাগে নিয়েছিলাম, পাঁচজনকে একটা কপি সালাম জানিয়ে নিজের হাতে দিলাম। খুশি হলেন খুব।

যাহোক, রেলের ঘুমের বন্দোবস্তটিও আন্তর্জাতিক মানের পরিচ্ছন্ন। বালিশ, ব্লাঙ্কেট সবই উষ্ণ। রেলের দ্রুততম গতির টানা চলার ফাঁকেফাঁকে চা-পানে, খাওয়া ও ঘুমের দুলুনিতে রাতও কাটে দে-দোল-দে-দোল … সকাল হলো। এবার ঝটপট আমরা ব্রেকফাস্ট করেই রেডি নামার জন্য। আমরা সহযাত্রী সাহসী বুড়োদের সালাম জানিয়ে রেলের দরোজার দিকে এগোই । উনারা একটা কার্ড দিয়েছিলেন ঠিকানা সমেত। যোগাযোগ রাখতে বলেছিলেন। আমার ব্যাগে রেখেছিলাম বহুদিন। যোগাযোগটা করা হয়নি আর। উনারা বেঁচে থাকলে এখন শতায়ু পেরিয়ে যাবার কথা। আজও উনাদের ভুলিনা। হ্যাঁ, বলছিলাম আমার দিল্লী শহরে পা রাখার রোমাঞ্চিত অভিজ্ঞা। অভাবিত দারুণ দিল্লী শহর। নয়াদিল্লী নতুনত্বের আভিজাত্যে মোড়ানো। এবঙ পুরনো দিল্লী চমক জাগানিয়া ঘোড়ায় টানা গাড়ির টগবগানো খুড়ের আওয়াজে বাদশাহির কাল স্মরণে আনার মতোন। ঘুরলাম ভালিকা মার্কেটে দুজনে। কিনলাম ছেলেমেয়ের জন্য, দেবর-ননদিনী ও পরিবারের প্রায় সবার জন্য কিছু না কিছু। পরের দিন  নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজার দেখতে গেলাম। জিয়ারত পড়েছি দুজনেই। অতঃপর রাতে আমরা আজমীর শরীফ রওয়ানা দিলাম এসি বাসের দুখানা টিকিট কেটে। ভোরের প্রথম প্রহরে পৌঁছে গেলাম। হোটেলটি পুরনো আমলের হলেও মন্দ না। ঢাকার একজন তরুণ ডাক্তারের সঙ্গে খাতির হলো ভালোই আমাদের। আমরা একসঙ্গে সড়কে হেঁটে আজমীর শরীফ জিয়ারতে গেলাম। পথেপথে অনেক পুরনো ধাঁচের বিল্ডিং। এবঙ অলিগলি পেরুতে গিয়ে প্রচুর দলবদ্ধ ঘোলাটে রঙের শূকর দেখলাম। এমন শূকর দেখার স্মৃতি আমার আর ঘটেনি। ভিক্ষুকও অনেক। নারী ভিখেরী খুবই নাছোড় টাইপের। পথচলতি নারী ভিখেরী রীতিমত পিঠের পরে ঠোকনা মেরে বলতে থাকে – 'দে দোনা দশ রুপিয়া' ! বাংলাদেশেও প্রচুর ভিখেরীরা সবখানেই, তবু অমন নাছোড় ভিখেরী পিঠে ঠোকনা মারে – এমন দেখিনি কোথাও আর। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞা বটে। যাহোক, আজমীর শরীফ জিয়ারত করার পরে আমাদেরকে লাল-হলুদ সূতা এবঙ তবারুক দেওয়া হলো। বিশাল উঁচু সিঁড়ির মাথায় ওঠা ও দেখা বিশাল হাঁড়ি – যে হাঁড়িটিতে প্রতি বছর ওরসে আগত লক্ষ-লক্ষ মানুষদের তবারুক হিসেবে তেহারী চড়ানো হয়। সে নাকি অফুরান খাওয়া। যত লোকই হোক – খাওয়া অফুরান আল্লাহতায়ালার কুদরত আর কি ! এদিকে, নামার সময় খাড়া সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মাথা ঘুরলো আমার বিষম , পড়ে যাবার ভয়ে। আমার স্বামী তরতরিয়ে নেমে গেছেন। তখন অনুজসম তরুণ ডক্তার বাড়ালো হাত, আমার তখন সে হাত ধরে নামতে হলো। আমার স্বামী তা দেখে আমার ভীরুতা নিয়ে এবঙ হোঁচট খাওয়া নিয়ে অনেক ঘটনা বলেন আর হাসেন। সেদিন অনেক ঘোরাঘুরি করেছি আমরা। তিনজনেই আজমীর শরীফে যত দোকান, বড় বিপনী সব ঘুরেছি। বড় একটা দোতলা বিপনী হতে কিনেছি শাড়ি, পাতলা সিল্ক কাপড় দিয়ে বানানো লেপ, পুতির মালা।


ছবি ক্যাপশনঃ তাজমহলের  সামনে  আমরা  দুজনে  তখন  তরুণ  বয়সের। ১৯৯২ সাল।

পরের দিন আবার দিল্লী। সেখানে এবার আমার স্বামী সাইট ট্যুরের টিকিট কাটলেন। প্রথমে আগ্রার তাজমহল, ফতেহপুর সিক্রি ও জয়পুর সিটিতে সারাদিনের সাইট ট্যুর। দারুণ থ্রিল নিয়েই বাসে চড়েছি। পথে অনেকগুলো বাদশাহী মসজিদ, মন্দির, স্থাপনা দেখালো ট্যুর গাইড। কারুকাজ খচিত স্থাপনাগুলি পুরনো ইতিহাস ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে আজও। চা-পান করানো হলো সকল যাত্রীদের একটা রিসোর্টে। সেটিও দেখার মতোন বন-বনানী-হ্রদের ঘেরাটোপে সাজানো চেয়ার-টেবিলে বসে চা-পান – জলখাবার সমেত এনজয় করেছি বেশ। দুপুরে খেলাম আরেকটি কটেজে। বিকেল নামার ক্ষণে আমরা পৌঁছলাম তাজমহলে। শাদা তাজমহলের মার্বেল পাথরে গড়া অভূত সৌন্দর্যে তখন পিছলে-ঠিকরে পড়ছিলো সোনালি পড়ন্ত রোদের আভা। অবাঙ আমরা বিশালতার সেই ভুবনমোহনী হৃদয়হরন যমুনাতীরে মুঘল বাদশাহের কীর্তির সামনে। সেথায় ঢুকতে হয় জুতোবিহীন খালিপায়ে। শাহজাহান তাঁর মনের ইচ্ছে পূরণ করার খায়েশ চরিতার্থ করতে গিয়ে অমর হলেন তাজমহল গড়ে। যাদের শ্রমেঘামে তাজমহল তৈরী তাদের নাম দূরের কথা, সেসব মেধাবী করিগররা যাতে তাজমহল সদৃশ কোনও কীর্তি গড়তে না পারে জগতে – তাই তাদের আঙুল কাটার সিদ্ধান্ত নিলেন সম্রাট শাহজাহান ! গাইড যখন ইতিহাস বলছে – আমি তখন এসবই ভাবছিলাম। কি খেয়ালি ছিলেন সম্রাট শাহজাহান ! কি অকরুণ নিষ্ঠুরতা ! শাহজাহান নইলে কি আর অমরত্ব পেতেন? পেতেন না। এটিও ইতিহাস। শাহজাহান স্ত্রী কে কতটা ভালোবাসতেন তারই নমুনা তাজমহল – এমনই ইতিহাসের পাতায় লিখিত। প্রেমের মহান মনুমেন্ট তাজমহল নিয়ে কবিরা লিখছেন কবিতা, গান। জগত জুড়ে তাজমহল বলতেই – শাহজাহানের স্ত্রীকে ভালোবাসার কীর্তি। অথচ বইপত্র ঘেঁটেই আমি জেনেছি, মমতাজ মহল মাত্র তিরিশ / বত্রিশ বছর আয়ু পেয়েছিলেন। অই বয়সে জন্মেছে ১৪টি সন্তান যে নারীটির – তাঁর বাঁচার শক্তি কি আর থাকে শরীরে? সম্রাট শাহজাহান স্ত্রীর চিকিৎসা কি করিয়েছিলেন? এসবই আমার মনে তাজমহল দেখে কেন যে আসে ! আমার অই সময় গাইডের কথায় কান যায় না। যমুনাতীরে দুজনে দাঁড়িয়েছিলাম কতক্ষণ কে জানে ! ডাক পড়লো পাশাপাশি দুজন অমর ভালোবাসার রাজা- রাণীর কালো মখমলসদৃশ কবরে সোনালি কারুকাজ খচিত শিল্পকর্ম দেখার। দেখলাম। যথাসময়ে ফিরেও এলাম। মনে হাজারতর সুবিস্ময়ের জের মনের মাঝারে আলোকগতির বেগে তাড়িয়ে ফেরে।

***