একদিন ইতালি হতে ভেরোনা শহরে রোমিও জুলিয়েটের ঐতিহাসিক বাড়িতে

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 20 Nov 2015, 04:42 PM
Updated : 20 Nov 2015, 04:42 PM

সম্ভবতঃ ২০০৫ / ২০০৬ সালের শীতকালে আমার স্বামীর সনেই গেছি ইতালি। তখন শীতের তীব্রতা সেথায় হাড়ভেদী। মাইনাস দশ ও ঊনিশ-বিশের সংখ্যায় উঠানামা করছে। ফুলহাতা গেঞ্জি-স্ল্যাকসের উপর উলেন সুয়েটার, কোট / জ্যাকেট টুপিঅলা চাপিয়ে হাতমোজা ও পায়ে মোজা সমেত বুট পরেও হাড়ের ভিতর সূচ বেঁধানো শীত। বাইরে ঘুরে বেড়ানো তাই কঠিন। আমাদের বাঙালি তরুণ খায়ের সার্বক্ষণিক টেক কেয়ারে নিয়োজিত থাকায় তার গাড়িতে দুজনে ঘুরেছি রোম। বাংলাদেশী শতেক তরুণ রোমে অনেকে চাকুরী, নিজের বাণিজ্য করছে। মুখগুলি আমার বারবার বাংলাদেশের কথাই মনে পড়িয়ে দিচ্ছিলো। সবাই ওরা এমন আন্তরিক … যেন বা ভাইবেরাদর। আমরা ওদের কারও-কারও বাসায় খেতে গিয়েছি … আত্মীয়তা এবঙ আতিথেয়তা ভোলার না কোনওদিন।

সুপ্রাচীন কালের ঐতিহ্যবাহী নগরী রোম দারুণ সুন্দর। সেথায় সবই পুরনো কালের রাজারাজরাদের গড়া দালানকোঠাবাড়ি, স্থাপনা সমূহ বর্তমান কালেও ঐতিহ্য সমেত দাঁড়িয়ে আছে ঝকঝকে-তকতকে। রোমের ভ্যটিকান সিটির সৌন্দর্যে আমরা মুগ্ধচিত্ত। আমিতো যা কিছু দেখেছি তাতেই এতটাই অবাঙচিত্ত যে স্বামীর তাড়া না খেলে দাঁড়িয়ে থাকি হা করে তাকিয়ে। আফ্রিকান / নাইজেরিয়ান কিছু চোরও আছে সেথায়। যারা বেড়াতে আসা বিদেশি পর্যটকদের গাড়ির চাবি ঘুরিয়ে খুলে ফেলতে জানে। এবঙ গাড়ির ভিতরে রেখে যাওয়া ব্যাগ চুরিতে উস্তাদ ওরা। জানার কথা না আমার, যদি না নিজের ব্যাগটি খোয়াতাম গাড়িতে রেখে যাওয়াতেই। বেরিয়েছি সারাদিনের ঘোরাঘুরি করার জন্য। তাইতো গাড়ির ভিতরে রেখেছিলাম বেশতি কিছু উলেন শাল, লোশন, কেনাকাটার জিনিসপত্তর। সারাবেলা বেড়িয়ে কারপার্কিং এ গাড়িতে ওঠার সময় খায়েরের অাঁৎতে ওঠা – "ইশ্শ্ রে বদমায়েশ চোর গাড়ির লক খুলেছে ! আন্টি, কিছু কি রেখে নেমেছিলেন?" উঠে দেখি যে আমার ব্যাগটা গায়েব ! কি আর করি … ভালো যে কেউ টাকাপয়সা রেখে যাইনি।

রোম বেড়িয়ে ট্রেনে ভেরোনা যাবার সময় স্টেশনে খায়ের বলে – "চলেন আন্টি, আপনাদের জিলাতো খাওয়াই। আমিতো মহাখুশি। ইতালি মানেই জিলাতো, পিৎজা, কাপুচিনোর নগরী। তাই জিলাতো না খেলে মনের মাঝে রয়েই যাবে আফসোসের একটা খচখচানি। ট্রেন আসতে দেরী, আমরা ঢুকলাম জিলাতো শপে। দারুণ স্বাদের জিলাতো দুইহাতে দুইটা তুলে নিলাম। দুইটাই তারিয়ে-তারিয়ে খেলাম চেটেপুটে। ছবিও তুলেছিলাম। হাতের কাছে এ্যালবামটি না থাকায় দেওয়া সম্ভব হলো না। ট্রেন আসতে খায়ের কে বিদায় দিয়ে আমরা পাড়ি দিলাম ভেরোনা।

ভেরোনা পৌঁচেছি রাতের কনকনে প্রবল সূচ ফোটানো শীতে। ৬ ফুট ৬-৭ ইঞ্চি লম্বা ফর্সা ৭০ ঊর্ধ্বের তরুণ ভদ্রলোক আমাদেরকে নিয়ে গেলেন প্রথমে হোটেলে। তারপর একটি রেঁস্তোরায় খাওয়ালেন। নিজেই ড্রাইভ করেন দারুণ। বেশ লাগলো আমাদের উনাকে। নাম – উইলিয়ম ফেডরিগা। পরদিনের ব্রেকফাস্ট সেরেই দেখি ফেডরিগা হাজির। নিয়ে গেলেন দেড়ঘন্টা ড্রাইভ করে একটি চকোলেট মেশিন ফ্যাক্টরি ভিজিটে – মিত্রা গ্রুপ কোম্পানি। সেথায় দেখলাম আমরা চকোলেট তৈরীর বিভিন্ন রকম মেশিন এবঙ প্রসেসিং। দুপুরে দারুণ খাওয়া ইতালিয়ান পাস্তা, পিৎজা এবঙ কাপুচিনো। ফেরার সময় গিফট করলেন আমাকে চমৎকার কেকের বক্স, অাপেল একঝুড়ি।

পরের দিন গেলাম আমরা ভেনিস। ভেনিসে কোনও ট্রান্সপোর্ট নেই। টিকিট কেটে ফেরীতে চড়ে যাওয়া। অপরূপা ভেনিস। দ্বীপঘেরা বিপনি আর শপিংমল। সেথায় গন্ডোলা যেন বা রূপকথার ময়ূরপঙ্খী নাও আর কি ! চোখ ফেরানো দায় এমন সুন্দর জীবনে দ্বিতীয়টি দেখিনি আর। অনেক ঘুরলাম। খেলাম। স্যুভেনির হিসেবে কিনলাম মোমের বানানো দারুণ সব হ্যান্ডিক্রাফটস, পশমী স্কার্ফ। জুলিয়েটের রাজবাড়ি দেখতে গিয়ে এতোকাল যা শুধু সিনেমা, বইতে পড়েছি – দেখলাম নিজের চোখে। বিশাল চত্তর নানান দেশের পর্যটকের ভিড়। কবুতরের মেলা। খাবার কিনে হাতের তালুতে ধরলে উড়ে বাকবাকুম করে মাথার 'পরে। বসেও কাঁধে বা হাতের 'পরে। স্বামীর হাতে, মাথায় চড়া কবুতরের ছবি তুলেছি। অতঃপর জুলিয়েটের বাড়ির উঠোনে। বেদী বানিয়ে রাখা জুলিয়েটের মূর্তি উঠোনে। পর্যটকরা জুলিয়েটের বুক স্পর্শ করছে … ছবি তুলছে। স্বামী কিছুতে ছবি তুলবেন না … আমি একাই জুলিয়েটের মূর্তির কাঁধে হাত রেখেছি – স্বামী উঠিয়েছেন ছবি। জুলিয়েটের বাড়িটি হুবহু সিনেমাতে যেমন তেমনই। দোতলা বাড়ি, রেলিংঅলা ঝুলবারান্দা। যেথায় জুলিয়েট ছুটে আসতো রোমিও ডকলে। নীচে এখন বৃক্ষতল ছাওয়া হাজার প্রেমিক-প্রমিকার মনের খায়েশমাখা পদচারণায়। তারা মনোবাসনারূপী চিরকুটে মনের ভাষা লিখেই ডালে বাঁধতে আসে সেথায়। ডালভর্তি হাজার-হাজার রঙিন চিরকুট বাতাসে দোলে … যেন বা চিরকুটগুলি রোমিও- জুলিয়েটের অজর প্রেমগাথা বলছে কানেকানে সেথায়।

এক জীবনে যত দেখেছি তার ভিতর ভেরোনা, ভেনিস দেখা আমার সেরা অদেখা দেখা। জীবনে আর কোনও অদেখা আমার না দেখলেও কোনও খেদ রবে না । স্বামীর কারণে দেখা আমার যত অদেখা। শুকরিয়া হাজারবার।

( *অবশেষে স্মৃতির এ্যালবাম পেলাম বলে কয়েকখানা ছবি দেওয়া গেলো । সবার ভালো লাগলে সার্থক এ লেখা এবঙ আমার ভ্রমণ ভেরোনা। ২০০৬ সালে। লিখিত ২০১৫ সাল।*)

অগ্রহায়ণ। ১৪২২ বঙ্গাব্দ।
ঢাকা। বাংলাদেশ।