বাংলাদেশের গণমাধ্যম: ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা, ৫০ বছরের পূর্বাভাস

পাগলা হাওয়া
Published : 4 March 2011, 11:15 AM
Updated : 4 March 2011, 11:15 AM

পৃথিবীর নানা দেশের মতো বাংলাদেশেরও সাংবাদিকতার তিনটি পর্যায় রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে সাংবাদিকতা প্রবর্তিত হয়েছে রাজনীতিবিদদের হাতে, রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে গণমাধ্যম ব্যবহৃত হয়েছে। এরপরে সাংবাদিকতার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক সাংবাদিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে এবং এথিকাল ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পক্ষে কথা বলা হয়েছে। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা প্রবর্তনের পেছনে বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকতা বিভাগগুলোর অবদান রয়েছে। এরপর এখন চলছে কর্পোরেট মালিকানার সাংবাদিকতা। এই বাস্তবতা যেমন বৈশ্বিক, তেমনি স্থানীয়। এই তিন পর্যায়ে সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য ও রীতিতে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে।

২০১১ সালে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ৪০ বছর পূর্তি হচ্ছে। এই ৪০ বছরে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার বিভিন্ন ঘটনাক্রমের যেমন একটি পর্যালোচনা করার সুযোগ রয়েছে, তেমনি আগামী এক দশকে বা ৫০ বছর পূর্তি হতে হতে সাংবাদিকতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার একটি পূর্বাভাস দেয়ারও প্রয়োজন রয়েছে।

পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ইত্তেফাক এবং দৈনিক সংবাদ এখনও প্রথম পর্যায়ের সাংবাদিকতার শেষ প্রতিনিধি হিসেবে টিকে আছে, যদিও তারা বর্তমানে মূলত বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা বা দ্বিতীয় পর্যায়ের সাংবাদিকতার প্রতিনিধিত্ব করছে। পাকিস্তান আমলের স্বাধীকার আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে এই দুটি পত্রিকার ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার ছাড়াও বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন ঐতিহাসিক নানা ঘটনাক্রমের সঙ্গে অবশ্যম্ভাবীরূপে জড়িয়ে পড়েছে। বাকি প্রায় সব মুদ্রণ ও সম্প্রচার মাধ্যমের জন্ম হয়েছে বিগত দুই দশকে। লক্ষ করার বিষয়, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের পর, এই দুই দশক হলো মুক্তবাজার অর্থনীতিনির্ভর বিশ্বায়নের কাল। ফলে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার একটা প্রভাব এই সময়ের গণমাধ্যমের ওপরে পড়েছে, উল্টো দিক থেকে সম্প্রসারণশীল বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াসৃষ্ট পুঁজিতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম অংশীদার হিসেবে থেকেছে গণমাধ্যম। বিদ্যমান গণমাধ্যম পরিস্থিতি তাই, একইসঙ্গে, পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বায়নের কারণ ও ফলাফল।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় পর্যায়ের সাংবাদিকতার (বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা) বিস্তৃতি ছিল স্বল্পকালের, অন্য দেশের সঙ্গে পার্থক্যটা এইখানে। দেশ স্বাধীন হবার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক সাংবাদিকতার প্রয়োজন একরকম ফুরালেও, আশির দশক পর্যন্ত আমরা রাজনৈতিক সাংবাদিকতাকেই দেখেছি। দ্বিতীয় পর্যায়ের সাংবাদিকতার (বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা) প্রতিনিধি হিসেবে আমরা নব্বই দশকের প্রথম দিকে পেয়েছি আজকের কাগজকে। সাংবাদিকতা বিভাগে অহরহ উচ্চারিত বস্তুনিষ্ঠতার বাণীর একরকম প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই ঐ পত্রিকায়। ঐ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন সাংবাদিকতা বিভাগের একজন গ্র্যাজুয়েট। আজকের কাগজ পত্রিকার মাধ্যমে বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। বস্তুনিষ্ঠ ও এথিকাল রিপোর্টিংয়ের পাশাপাশি রুচিশীলতা, সংস্কৃতিমনস্কতার পরিচয় দেয় পত্রিকাটি। কম্পিউটার ডেস্কটপ প্রকাশনা ও অফসেট মুদ্রণ প্রযুক্তি ইতোমধ্যে চলে আসায় মুদ্রণমানেও পরিবর্তন আনতে পারে পত্রিকাটি। গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিবর্তন আসে দৈনিক পত্রিকায় লেখক ও পাঠকের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। নির্ধারিত উপ-সম্পাদকীয় লেখকের বাইরে মধ্যপাতায় চিন্তক, বুদ্ধিজীবী মায় পাঠক পর্যন্ত লেখা শুরু করেন নিজ পরিচয় বিবৃত করার মাধ্যমে। এরা সবাই হয়ে ওঠেন কলামিস্ট, এবং দ্রুত মধ্যপাতানির্ভর একটি সিভিল সোসাইটি গড়ে উঠতে থাকে বাংলাদেশে। আজকের কাগজ-এর নতুনত্ব ভোরের কাগজ আবির্ভাবের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয় এবং প্রথম আলো পত্রিকার আবির্ভাবের পরে ক্ষণস্থায়ী দ্বিতীয় পর্যায়ের সাংবাদিকতার অবসান ঘটে।

প্রথম আলোর মাধ্যমেই কর্পোরেট সাংবাদিকতার প্রবর্তন ঘটে, যদিও ভোরের কাগজ-এর সম্পাদক-সাংবাদিকরা মিলেই পত্রিকাটি চালু করেন। কিন্তু মালিকানার প্রকৃতির কারণেই একই সম্পাদক-সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা থেকে সরে এসে কর্পোরেট সাংবাদিকতা শুরু করেন। আমদানিকারক বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ট্রান্সকম গ্র"পের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান প্রথম আলোর পাশাপাশি, এস এম আলী প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি দৈনিক দি ডেইলি স্টারও ট্রান্সকম গ্র"পের অঙ্গীভূত হয়। নব্বই দশকের শেষের দিকে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার-এর যূথবদ্ধতার আগেও কর্পোরেট সাংবাদিকতার নিদর্শন নিয়ে জনকণ্ঠ বা মুক্তকণ্ঠ হাজির হয়েছিল, কিন্তু তারা প্রভাববিস্তারকারী হয়নি। প্রথম আলোর নির্দিষ্ট করে দেয়া সাংবাদিকতার ধরন-ধারণই বাকিরা এখন পর্যন্ত অনুসরণ করে চলেছে। প্রশ্ন হলো সেই ধরনটা কী?

সেই উত্তর দেবার আগে বিগত দুই দশকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পটভূমির একটা বর্ণনা দেয়া দরকার। সমাজতন্ত্র পতনপরবর্তী মুক্তবাজার অর্থনীতিনির্ভর বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া এবং বাংলাদেশে এরশাদ-সরকারের স্বৈরাচারী শাসনাবসানপরবর্তী গণতন্ত্রের আবির্ভাব একই সময়ে ঘটে। এখন বাংলাদেশের এই নির্বাচনকেন্দ্রিক, অবিকশিত গণতন্ত্র মুক্তবাজার অর্থনীতির জন্য কোনোভাবেই প্রতিকূল ছিলনা। বরং পশ্চিমা দ্বিদলীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির আদলে বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্র মার্কিনি সাম্রাজ্যবাদী প্রভাবযুক্ত মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারণাকে সাদরে গ্রহণ করেছে। বলাবাহুল্য এই মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাংলাদেশ আছে গ্রাহক-প্রান্তে। বিশ্বায়নের কালে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের প্রান্তিক পুঁজিবাদী দেশগুলো অক্রিয় ভোক্তার বাজারে রূপান্তরিত হয়েছে। সস্তাশ্রমনির্ভর তৈরীপোশাক শিল্প এবং বিদেশী বিনিয়োগনির্ভর টেলিকম খাত ব্যতীত বাংলাদেশে বিদেশের পণ্য দেশে এনে বিক্রিভিত্তিক একটি সওদাগর-শ্রেণীর উদ্ভব ঘটেছে, এবং এই তিন খাতই বিকাশমান কর্পোরেট শ্রেণীর অংশীদার। ফলে ১৫ কোটি মানুষের একটি দেশ মানে সম্ভাব্য ১৫ কোটি ভোক্তার বাজার। আমদানিকারকদের দিক থেকে তাই প্রয়োজন পড়ে মানুষকে ভোক্তায় রূপান্তরের এবং ভোক্তসংস্কৃতি চালু করা বিদ্যমান অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার অন্যতম জরুরি শর্ত হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়।

এই ভোক্তসংস্কৃতি চালু করার দায়িত্ব পড়ে গণমাধ্যমের ওপর। ফলে ট্রান্সকমের মতো আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানই প্রতিষ্ঠা করে প্রথম আলোর মতো সংবাদপত্রের যার মূল কর্মসূচি হলো নিজ কোম্পানির স্বার্থ সংরক্ষণ করা, সার্বিকভাবে প্রাইভেট সেক্টর বা ব্যবসায় শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করা এবং পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বিজ্ঞাপন প্রকাশ, বাজারের খবর, নতুন পণ্যের সংবাদ ইত্যাদি পরিবেশনের মাধ্যমে ক্রয়মনষ্কতার স্বভাব সৃষ্টি করা। বাজার সৃষ্টি ও ভোক্তাসংস্কৃতি চালু করার পাশাপাশি প্রথম আলোর মতো পত্রিকাগুলো ব্যবসা-বাণিজ্যের সবচেয়ে বড়ো বাধা হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর বিদ্যমান অপরিচ্ছন্ন কর্মকাণ্ডকে দায়ী করে। তাই পাল্টা শক্তি হিসেবে ব্যবসায়ীদের নেতৃত্বে সিভিল-সমাজ দাঁড় করিয়ে ব্যবসার স্বার্থ অক্ষুণœ রাখার মতো 'স্থিতিশীলতা', 'গণতন্ত্র' ও 'সুশাসন' প্রতিষ্ঠা করাই এই গণমাধ্যম-প্রতিষ্ঠানগুলোর লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। একই প্রয়োজনে এই প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পত্রিকা সেনা-সমর্থিত ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেও প্রকাশ্য সমর্থন দিয়েছে। কীরকম বাংলাদেশ তারা দেখতে চায় সেবিষয়ে সিভিলসমাজ-কর্পোরেট-মিডিয়া-মিলিটারির ঐক্য আছে। সব প্রতিষ্ঠানের বিরাজনীতিকরণের মাধ্যমে নির্বিবাদী ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারার একটা পরিবেশ চায় এই ঐক্যজোট। এই বিরাজনীতিকরণ ডিসকোর্সের প্রবর্তন ও নিয়মিত চর্চার মূল দায়িত্ব গণমাধ্যমের হাতেই।

শূন্য দশকে টেলিভিশন চ্যানেলের 'বুম' উল্লেখ করার মতো আরেকটি ঘটনা। ইটিভির মাধ্যমে টিভি চ্যানেলগুলোর একটি প্যাটার্ন দাঁড়িয়ে যায় — বিশেষত সংবাদপরিবেশনে, অনুষ্ঠাননির্বাচনে, এবং গ্রাফিকাল উপস্থাপনায়। বর্তমানে প্রায় ১২-১৩টি চ্যানেল সম্প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, সামনে আসবে আরও কয়েকটি চ্যানেল। এইসব চ্যানেলগুলো ইটিভির ফরম্যাটই অনুসরণ করে চলেছে। তবে চ্যানেল আই, এনটিভি, এটিএনসহ সব চ্যানেলই উল্লিখিত কর্পোরেট সাংবাদিকতার আওতায় রয়েছে। পুরোপুরি বিজ্ঞাপননির্ভর এই চ্যানেলগুলো কর্পোরেট ব্র্যান্ডিং করতে গিয়ে সংবাদের সব স্লট বিক্রি করে দিয়েছে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনদাতার কাছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ বিজ্ঞাপনের বাজার ধরতে প্রতিযোগিতারত চ্যানেলগুলো সংবাদের স্লটগুলোকে অতি সস্তা করে তুলেছে। প্রথম আলোর সৃষ্টি করা কর্পোরেট সাংবাদিকতা চ্যানেলগুলোকে সম্পূর্ণ গলাধঃকরণ করেছে। প্রথম আলো যদি 'বদলে যাও বদলে দাও' কর্মসূচির মাধ্যমে কর্পোরেট সাংবাদিকতার গ্লানি ঘোচাতে চায়, চ্যানেলগুলোর মধ্যে সেই চেষ্টাও নেই। তবে এটা ঠিক, টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদ দেখা অধুনা মধ্যবিত্তের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, যে-অভ্যাস তৈরী হয়েছে বিগত এক দশকে। বিটিভির সরকারনিয়ন্ত্রিত সংবাদ দীর্ঘদিন ধরে মধ্যবিত্তকে সংবাদ-বুভুক্ষু করে রেখেছিল। তবে সরকারগুলো মুদ্রণমাধ্যমকে স্বাধীন রেখে দিলেও, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে এখনও নজরদারির মধ্যে রেখেছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ইটিভি, সিএসবি ও চ্যানেল ওয়ানকে। যারা টিকে আছে, তাদের সংবাদপরিবেশনে তাই কোনো ধার বা বলিষ্ঠতা লক্ষ করা যায়না।

এফ এম চ্যানেল আরেকটি প্রপঞ্চ হিসেবে শূন্য দশকে হাজির হয়েছে। চারটি এফএম চ্যানেল এই মুহূর্তে চালু রয়েছে। এফ এম রেডিও মূলত পপ সঙ্গীতনির্ভর, এদের উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠী তরুণরা, এবং সেইসব তরুণ যারা ইতোমধ্যে কর্পোরেট সংস্কৃতির অধিভুক্ত বা ঐ সংস্কৃতিতে নিজেকে নিযুক্ত করতে উন্মুখ রয়েছে। ফলে খানিক ইংরেজির মিশেলে এবং ইংরেজি-ঘেঁষা বাংলা উচ্চারণে যে-চ্যানেলগুলো চলছে তাতে রয়েছে ঘণ্টাপ্রতি খবর, আছে ঢাকা শহরের ট্রাফিক আপডেট, আছে শেয়ার বাজারের আপডেট। অল্প কিছু টকশো বা সাক্ষাৎকার বাদে বাকিটা মিউজিক। এফএম চ্যানেলগুলোর জন্মই কর্পোরেট-সংস্কৃতির আওতায়। অন্য মাধ্যমগুলো এক দশক ধরে একটি কর্পোরেট-সংস্কৃতি সৃষ্টির যে-চেষ্টা চালিয়েছে, এফএম চ্যানেলগুলো সেই সংস্কৃতির ওপর দাঁড়িয়েই ২৪ ঘণ্টা অনুষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছে।

এই কর্পোরেটারয়ণের বিপরীতে চালু হতে যাচ্ছে কমিউনিটি রেডিও। কমিউনিটির মানুষদের উন্নয়নে, উন্নয়ন যোগাযোগের কাজ করবে এই কমিউনিটি রেডিও। তবে এর মালিকানা বা প্রচার স্বত্ব কেবল এনজিওগুলোই পেতে যাচ্ছে। ফলে সম্ভাবনাময় ও বিকল্প এই মাধ্যমটি বিদ্যমান উন্নয়ন ডিসকোর্সের বাইরে এসে কমিউনিটিতে কতটুকু অবদান রাখতে পারবে, সে-সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। এনজিও উদ্ভাবিত এবং প্রথম আলো-ডেইলি স্টার সমর্থিত তথ্য অধিকার আইনের প্রচলনও শূন্য দশকের শেষের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ভারতে তথ্য অধিকার আইন চেয়েছে কমিউনিটির মানুষ, কিন্তু বাংলাদেশে এটি চেয়েছে বিদেশি ফান্ডপ্রাপ্ত এনজিওগোষ্ঠী, যারা কমিউনিটির উন্নয়নকল্পে কাজ করে থাকে। এরপরও বলা যায় কমিউনিটি রেডিও ও তথ্য অধিকার আইন এই সময়ের দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

আগামী দশ বছর পর রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বয়স অর্ধশত পূর্ণ হবে। বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশের মিডিয়া খাতে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। তাই আগামী দশ বছরে কী পরিবর্তন আসবে, তার পূর্বাভাস দেয়া বেশ কঠিন। তবে এটুকু বলা যায়, বিগত দশকের মতো নাটকীয় পরিবর্তন আসবে না। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিস্থিতি পৃথিবীর উন্নত অনেক দেশ থেকেই আলাদা। পৃথিবীর নানা প্রান্তে যেক্ষেত্রে সাইবারপরিসরের কারণে সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশে এখনও নতুন নতুন সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতিও এখন সম্প্রসারণশীল। আর উন্নত দেশগুলোর তুলনায় ইন্টারনেটের এদেশে ব্যবহার এখনও অনেক কম। ফলে শুধু টিভি চ্যানেল বা এফ এম চ্যানেলই নয়, এদেশে এমনকি মুদ্রণ মাধ্যমের পরিধি এখনও বিস্তৃত হয়ে চলেছে। বলা দরকার, এখনও এদেশে সবচেয়ে প্রভাবশালী মুদ্রণ মাধ্যমই।

তবুও আগামী এক দশকে যে পরিবর্তন আসবে, তা বিগত এক দশকের মতো পালাবদলের হবেনা। ইতোমধ্যে অনুমতিপ্রাপ্ত চ্যানেলগুলো যোগ দিলে বাংলাদেশে টিভি চ্যানেলের সংখ্যা হবে প্রায় ২০টি। যেহেতু বিজ্ঞাপনের বাজার এতগুলো চ্যানেলকে সমর্থন দিতে পারে না, তাই কিছু চ্যানেল হয় বন্ধ হয়ে যাবে বা আদৌ আত্মপ্রকাশ করবে না। তবে আরও কয়েকটি এফএম চ্যানেল হয়তো আগামী দশ বছরে চালু হবে। আগামী দশ বছরে নতুন আরও চার-পাঁচটি দৈনিক চালু হতে পারে। তবে আগামী এক দশকে গণমাধ্যম পরিস্থিতি বেশ সংহত অবস্থায় চলে আসবে। দশ বছরের মধ্যে সম্প্রসারণশীল গণমাধ্যম এক জায়গায় থিতু হবে এবং মুখোমুখি হবে নতুন চ্যালেঞ্জের। এই চ্যালেঞ্জ আসবে সাইবারপরিসর থেকে। অধিক পরিমাণ মানুষ ওয়েবে যুক্ত হবেন, এবং এরা হবেন সক্রিয় নেটিজেন। বিগত পাঁচ বছরে একটি বাংলা ব্লগ কমিউনিটি ইতোমধ্যেই গড়ে উঠেছে যারা সদস্য সংখ্যা প্রায় দুই লক্ষ। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ফেসবুকেও যুক্ত আছেন প্রায় দশ লক্ষ মানুষ। এদের হাত দিয়েই শুরু হতে যাচ্ছে অপেশাদার কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সিটিজেন জার্নালিজম। এরাই সনাতন ও মূলধারার সাংবাদিকতাকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। বাধ্য হয়ে সনাতন মাধ্যম ওয়েবে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করবে। কিন্তু যেহেতু তারা সমাজের অপরাপর ক্ষমতাধর শ্রেণীর সঙ্গে একটি মিথোজীবীমূলক সম্পর্কে লিপ্ত থাকে, তাই স্বাধীন সিটিজেন সাংবাদিকদের স্বতঃস্ফূর্ততা তাদের মধ্যে অনুপস্থিত থাকবে। ফলে ওয়েবে পেশাদার ও অপেশাদার বা বিকল্প সাংবাদিকতার একটি দ্বন্দ্বের দেখা পেতে পারি আমরা, আগামী দশকে।