মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের শুভঙ্করের ফাঁকি

রাশেদুজ্জামান
Published : 2 Nov 2012, 04:41 AM
Updated : 2 Nov 2012, 04:41 AM

আমরা কোন না কোনভাবে এমএলএম শব্দটার মুখোমুখি। ইদানিং পত্রিকা, টিভিতে ডেসটিনি নিয়ে আলোচনা সংবাদে মোটামুটি সবারই জানা হয়ে গেছে এমএলএম শব্দটা। আসলে এই এমএলএম টা কী?-এর অর্থ হচ্ছে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা নেটওয়ার্ক মার্কেটিং যা বহুমাত্রিক পণ্য বিপণন ব্যবস্থা বলে পরিচিত। মূলত এই এমএলএম ব্যবস্থাটা চালু করেন আমেরিকার বিখ্যাত কেমিস্ট ড. কার্ল রেইনবোর্গ যা ১৯৪০-৪১ সালে আবিষ্কৃত হয়। এই ব্যবস্থাটা ১৯৫৮ সালে আমেরিকান পার্লামেন্টে ১০ ভোট বেশি পেয়ে জয়ী হয়।
তাত্ত্বিকভাবে বলা হয় যে, মাল্টিলেভেল মার্কেটিং পণ্য বিপণনে মধ্যস্বত্তভোগীদের কাজটুকু ক্রেতাকে দিয়ে করিয়ে নেয়। ফলে মধ্যস্বত্তভোগীদের বাড়তি খরচ ও লাভটুকু তারা ক্রেতাদের মাঝে বিলি করে। অর্থাৎ অনেকটা ক্রেতা সমবায়ের মত। ক্রেতা সমবায়ের সাথে এর পার্থক্য হলো এখানে ক্রেতাদের যুক্ত করা হয় হ্রাসকৃতমূল্য সুবিধা প্রদান বা গড় মুনাফা বণ্টনের ভিত্তিতে নয়, গ্রাহক সৃষ্টি ও তাদের ক্রয়কৃত পণ্যের মুনাফার উপর কমিশনের লোভ দেখিয়ে। এভাবে একে আইনগতভাবেও গ্রহণযোগ্য হিসাবে প্রমাণ করা সম্ভব হয়।
এখানে দেখানো হয় যে, ক্রেতারা যেহেতু তাদের সংগৃহীত ভোক্তাদের মোট পণ্য ক্রয়ের উপর কমিশন পাবেন, সুতরাং প্রত্যেক সদস্যই চেষ্টা করবেন ভোক্তা বা ক্রেতা বাড়ানোর। তারা দেখায় যে, ১ থেকে ২ এবং ২ থেকে ৪ এভাবে জ্যামিতিক হারে যদি ভোক্তা সংগ্রহ করা যায় অথবা এর মাত্র ১০ শতাংশ বাস্তবায়িত হয় তবে, একজন ভোক্তা মাত্র ১২ ধাপেই ৮ শতাধিক ভোক্তার নিয়মিত ক্রয়ের কমিশনভোগ করতে সক্ষম হবেন। ফলে বিতরণ নেটওয়ার্ক যত বাড়বে পণ্য বিক্রিও বাড়বে, বাড়বে মোট কমিশন। আর এভাবেই উপরের সারির সদস্যরা ঐ কমিশন থেকে বিপুল টাকার মালিক হতে পারেন। যেমন ডেসটিনি ২০০০ লিঃ নামের একটি এমএলএম কোম্পানি দেখাচ্ছে যে, এভাবে একজন ব্যক্তি ১ বছরের তৎপরতার পর প্রতি সপ্তাহে ৮০০০ টাকা কমিশন পেতে পারেন।
মাল্টিলেভেল মার্কেটিং এর তত্ত্ব ও বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন। এখানে তত্ত্ব কাজ করে আইন ও জনগণের চোখ ফাঁকি দেয়ার জন্য। এর বাস্তব মেকানিজম কাজ করে অন্যভাবে, যা প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। দেখা যায়, এ ধরণের কোম্পানি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বিপণন করে না। তাদের পণ্য হল নিম্ন মানের অপ্রচলিত পণ্য। বাস্তব দামের চেয়ে অনেক বেশি দাম নির্ধারণ করা হয়। তাহলে ক্রেতা বা নেটওয়ার্কের সদস্য এসব বাজে পণ্য বেশী দামে কেনে কেন? তারা এসব পণ্য কেনে নেটওয়ার্কের সদস্যভুক্তির খরচ হিসাবে এবং ভবিষ্যতে বিরাট কমিশনের আশায়। এরকম সদস্যভুক্তি বাবদ ক্রয় খরচ প্রতিষ্ঠানভেদে ৩ থেকে ১৫ হাজার টাকার মত হয়ে থাকে। বাস্তবে এমএলএম এর পণ্য প্রয়োজনীয় পণ্য নয়, অর্থ লেনদেনের একটা প্রতীক মাত্র। ফলে এক্ষেত্রে ক্রেতা সমবায়ের মত নেটওয়ার্কের সদস্যরা বারবার পণ্য ক্রয় করে না, তারা অন্যকে দিয়ে ক্রয় করায়। এভাবে প্রতিটি সদস্যভুক্তির ফলে কোম্পানি পণ্যের প্রকৃত দামের উপর বিরাট মুনাফা করে।
এতে সদস্যভুক্তি বাড়ানোর মেকানিজম দু'ভাবে কার্যকর হয়: একদিকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সেমিনার করে বিরাট লাভের মুলো ঝুলিয়ে ও ব্যক্তিগত মোটিভেশনের মাধ্যমে সদস্য করা হয়। অন্যদিকে যারাই একবার সদস্যভুক্ত হন, তারা কমিশন লাভের আশায় হোক অথবা গচ্চা যাওয়া অর্থ উদ্ধারের জন্যই হোক নতুন সদস্য করার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। কিন্তু কমিশন লাভের ক্ষেত্রে একটি শর্ত থাকে যে, সদস্যকে অবশ্যই দুই প্রস্থের নেটওয়ার্ক সমভাবে এগিয়ে নিতে হবে। কোন এক প্রস্থ নেটওয়ার্ক অনেক এগিয়ে গেল কিন্তু অপরটি থমকে রইল এ অবস্থায় সদস্য যতটুকু নেটওয়ার্ক সমভাবে এগিয়েছে তা থেকে কমিশন পাবেন, বাকী ক্রেতা ও বিক্রি থেকে কমিশন পাবেন না। বাস্তবে সদস্য হওয়ার মত লোকের সংখ্যা সীমিত, তা অসীম নয়। ফলে সদস্যকরণ ও ন্যূনতম নেটওয়ার্ক গড়তে সদস্যদের গলদঘর্ম হতে হয়। গায়ে পড়ে, সত্য-মিথ্যা বলে, প্রলোভন দেখিয়ে যদি কাউকে পণ্য গছিয়ে দিতেও পারেন, পরে তাকে এসব নতুন ক্রেতাদের ক্রোধের মুখে পড়তে হয়। তারা সামাজিকভাবে হন হেয়। এভাবে গুটি কয়েক বাদে সদস্যদের বড় অংশ গায়ে গতরে খেটে কোম্পানির ক্রেতা আর লাভ বাড়ান ঠিকই, সেই কমিশনের সোনার হরিণের দেখা পান না। এক হিসাবে দেখা যায়, এমএলএম নেটওয়ার্কভুক্ত সদস্যদের ৯০% নেটওয়ার্ক ছেড়ে চলে যান।
একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, এই নেটওয়ার্কিং বাস্তবে এক প্রকার জুয়া। কেননা এর মাধ্যমে কোন বাস্তব মুনাফা তৈরী হয় না। একটা পণ্যকে সামনে রেখে সবাই টাকা জমা দেয় আর সেই টাকা থেকেই উপরের সারির ব্যক্তিরা কমিশন পায় মাত্র। নীচের সারির ক্রেতারা টাকা জমা দেয় ভবিষ্যতে টাকা পাবার আশায়। এর সাথে বাস্তব পণ্য বিপণন ও তার লাভের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। বাস্তবে এমন কোন পণ্য নেই যার বিপণন খরচ বাঁচালে এত বিপুল অর্থ সাশ্রয় হয় যে, লক্ষ লক্ষ লোককে সপ্তাহে ৮০০০ টাকা কমিশন দেয়া সম্ভব।
পুরো বিষয়টা একটু সহজ করে বলি। ধরুন একজন প্রতারক পলিথিন ব্যাগে ‌'বাতাস' ভরে একজন সরল লোককে বলল এর দাম ২০০০ টাকা। সরল লোকটি বলল এই বাতাস আমি কিনতে যাব কেন? প্রতারক বলল-এটা কিনে আপনি আমার নেটওয়ার্ক কোম্পানির সদস্য হবেন। তারপর ২ জনকে সদস্য করবেন। এই যে ২০০০ করে ৪০০০ টাকা বিক্রি হলো তা থেকে আপনি পাবেন নগদ ১০০০ টাকা কমিশন। আপনি যদি আরো বেশি লোককে গ্রাহক বানাতে পারেন তবে আপনি আরো বেশি কমিশন পাবেন। আর আপনার গ্রহকরা কমিশন পাওয়ার আকাঙ্খায় নতুন নতুন ২ থেকে ৪, ৪ থেকে ৮, ৮ থেকে ১৬ এভাবে ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। আর এভাবে যত গ্রাহক এ বাতাস কিনবে, তাদের প্রত্যেকের উপর আপনি একটা কমিশন পাবেন। এভাবে যত নীচের দিকে গ্রাহক বাড়বে তত কমিশন আসতে থাকবে। একসময় ঘরে বসেই হাজার হাজার টাকা কমিশন পাবেন। এভাবে সরল লোকটা বুঝল কেন তাকে বাতাস কিনতে হবে। পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এতে বিপণন-টিপণন আসল ব্যাপার নয়-এখানে কমিশনটা আসে গ্রাহকদের জমার অংশ থেকে। উপরের উদাহরণে দেখুন, প্রতারক বাতাস বিক্রি করল ৬০০০ টাকার আর ছাড় দিল ১০০০ টাকা। এ পর্যায়ে প্রতারক মাত্র ১৭% ছাড় দিয়ে বিরাট লাভ করে। এভাবে ধাপে ধাপে প্রতারক কোম্পানিগুলো ৭০% পর্যন্ত কমিশন ছাড় দিতে প্রস্তুত থাকে। কিন্তু গ্রাহক তৈরীতে ব্যর্থ হয়ে যারা ঝরে যায় তাদের আর নতুন করে কমিশন দিতে হয় না। তাদের পুরো টাকাটাই কোম্পানির পকেটস্থ হয়। জুয়ায় যেমন যে জেতে সে লাভটা পকেটস্থ করে অন্য জুয়াড়িদের জমা থেকে আর কাউকে না কাউকে টাকাটা হারাতে হয়, এখানেও তাই ঘটে। এখানে হারার দল হচ্ছে তারাই যারা বাতাসটা কেনে কিন্তু বিক্রির বা ঠকানোর মত আর লোক পায় না। এভাবে লক্ষ লক্ষ লোকের পকেট কাটছে এ জুয়াড়ি কোম্পানিগুলো।
বাংলাদেশে এর আবির্ভাব ঘটে ১৯৯৬ সালে। গ্লোবাল গার্ডিয়ান নেটওয়ির্কিং-জিজিএন নামে একটি প্রতিষ্ঠান এসময় কাজ শুরু করে। এখন তার কোন অস্তিত্ব নেই। পরে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে আবার ‌'নাই‌‌‍‍' হয়ে গেছে। তবে এদের মধ্যে ১৯৯৯ সালে ডেসটিনি ২০০০ লিঃ একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে যা বাংলাদেশে এক বিশাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে এবং অন্যান্য এমএলএম ব্যবসায়ীদের ছাড়িয়ে গেছে। আর বাংলাদেশে এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়্যারম্যান মুহাম্মদ হোসাইন এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহম্মদ রফিকুল আমিন। এই ডেসটিনির ৪৯৪তম ভাষ্য অনুযায়ী ৩১,৯৫,৫৬৮ বেশী ব্যক্তি কাজ করছে। যার মধ্যে ৭৫% ছাত্র সমাজ। যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ‌‌‌‌পড়া লেখা করছে। যার হেড অফিস জাতীয় স্কাউট ভবন।
উপরিউক্ত এমএলএম কোম্পানীর তথ্যের ভিত্তিতে শঙ্কিত না হয়ে উপায় থাকেনা। যেখানে একত্রিশ লক্ষ এর বেশী কর্মী আছে যার মধ্যে একজন ক্রাউন এক্সিকিউটিভ এবং ডায়মন্ড এক্সিকিউটিভ ৫৮ জন যারা আজ ভূঁইফোঁড়। আর বাকীরা ছাত্র।
ছাত্র তরুণদেরকে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে এই দেশকে লুট করার স্বপ্ন আঁটছে। আর বড় হওয়ার আশায় এমনকি মেধাবী ছাত্ররা সারা দিনরাত খেটে যাচ্ছে। এতে যুক্ত ছাত্ররা পড়াশোনাকে গৌণ বিষয় আর ডেসটিনি কে মুখ্য বিষয় মনে করছে। যাদের অধিকাংশ শিক্ষা বছর বিসর্জন দিয়ে এই কোম্পানীতে কাজ করছে। আর এই কোম্পানীর কাজ হল মানুষকে কনভিন্স করে স্বপ্ন দেখিয়ে এখানে যুক্ত করা। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা-একবার আমাকে আমার এক চাচাত ভাই এই কোম্পানীর শাখা মালিবাগে হোছাফ টাওয়ারে নিয়ে গেলো। তারা আমাকে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করলো। আমাকে এই বলে স্বপ্ন দেখালো যে ভাইয়া আপনি যদি এই কোম্পানীতে ভর্তি হন তাহলে সপ্তাহে ৫৬ হাজার টাকা ইনকাম করতে পারবেন। আর আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনার বিয়ে হেলিকপ্টারে হবে। আর হানিমুন হবে সিঙ্গাপুরে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কথা না হয় বাদই দিলাম, যারা জ্ঞান আহরণে সবেমাত্র এইচ.এস.সি বা এস.এস.সি পাশ করেছে তারা এমএলএম কোম্পানীগুলোর সহজ টার্গেটে পরিণত হয়েছে। তাদেরকে তারা পড়াশোনার ব্যাপার গৌণ আর চাকরীর ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করে। উজ্জ্বলতর জীবনের স্বপ্ন দেখা তো পাপ নয়। কিন্তু হায়! কিছু লোক সেই স্বপ্নকে ঘিরে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে। এমনই এক উদাহরণ ময়মনসিংহ জেলার এক দরিদ্র কৃষকের ছেলে। সে সবেমাত্র এইচ.এস.সি পাশ করেছে। তার মনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাঙ্খা। ঠিক এই সময় তাকে ডেসটিনি আহবান জানায়। সেই ছেলেটি আজ বাবার গরু, ছাগল, জমি রেহান দিয়ে এখন এই ডেসটিনিতে কাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আশাকে গুড়েবালি করে নতুন স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছে!
ঠিক এমন লক্ষ লক্ষ ছেলে আজ এই ডেসটিনি, নাম না জানা আরও অনেক এমএলএম কোম্পানীতে কাজ করছে। যারা ফলাফলে পাচ্ছে শূন্য। তারা একদিন ভেঙ্গে পড়বে হতাশায়।
একদিন এমএলএম ব্যবসার সাথে জড়িতরাই দুঃখে, ক্ষোভে, লজ্জায় দেশকে গালাগাল দেবে। তারা একদিন দিশেহারা হয়ে পড়বে। আজ এই ৩০ লক্ষ যুবক এক বিপথগামীতার কবলে। সত্যতা নিরূপণ করে এর সঠিক ব্যবস্থা নেয়া সময়ের দাবী। এই ৩০ লক্ষ তরুণদের স্বপ্ন নিয়ে যারা নিজেদের আখের গোছাচ্ছে তাদেরকে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। যারা বেকারত্ব রোধের নামে বেকারত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে তাদেরকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।