গুলি করুন বুক বরাবর!

পাগল মন
Published : 11 June 2012, 11:12 AM
Updated : 11 June 2012, 11:12 AM

১। ডাকসাইটে প্রাক্তন মন্ত্রী কুদ্দুস আলি ধানমণ্ডিতে এক আত্মীয়র বাসা থেকে মতিঝিল যাচ্ছিলেন। ড্রাইভার প্রাডো গাড়িটি নিয়ে ভুলে খামারবাড়ির রাস্তায় ঢুকে পড়লে মনেমনে বিরক্ত হন কুদ্দুস আলি। দুপুর বারোটা, রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম। আধা ঘনটায়ও পার হতে পারলেন না তিনি। এবার নিশ্চিত পার হবেন, ভাবতে লাগলেন কুদ্দুস আলি। আবার লাল বাতি, ঠিক সিগনালের কাছে এসেই থামতে হল তাঁকে, সামনে একটা রিক্সাভ্যান দাড়িয়ে আছে। পিছনে একটু ধাক্কা লাগাতে ফিরে তাকালেন, দেখলেন একটা ঠেলাগাড়ি তাঁর গাড়ির সাথে লেগে আছে। দামী গাড়ী দেখে ভিক্ষুকের দল দু'পাশ ছেঁকে ধরেছে। বুকের ভিতরটা খচখচ করে উঠল কুদ্দুস আলির। এক সময় ছিল… আর ভাবতে পারলেন না তিনি। বেশিক্ষন বসে থাকা যাচ্ছে না, পশ্চাৎদেশটা বেশ ব্যাথা করছে। বিগত হরতালে জোর করে মিছিল করতে গেলে, পুলিশ তার উপর পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে… একটু অন্যমনস্ক হলেন তিনি। কি ব্যাপার!! সবুজ বাতি জ্বলার পরও যেতে দিচ্ছে না কেন? এবার ভীষণ বিরক্ত হলেন জনাব কুদ্দুস আলি। একটু পরেই দেখলেন সাইরেন বাজিয়ে সামনে পিছে স্কট নিয়ে বর্তমান এক মন্ত্রী ছুটে চলে গেলেন। আহা!! সারা জীবন যদি ঐভাবে থাকা যেত!! বুকের ঠিক মাঝখানে গুলিটা খেলেন একসময়ের ক্ষমতাধর মন্ত্রী কুদ্দুস আলি।

২। বীর মুক্তিযোদ্ধা ঈমান আলি, আলিশান বাড়ির সুইমিং পুলে সাঁতার শেষে পানিতে দাঁড়িয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন । কফিতে চুমুক দিয়ে বরাবরের মত ভাবছেন, না এভাবে দেশ চলতে পারে না!! মেহনতি মানুষের জন্য কিছু একটা করতেই হবে তাঁকে। দেশের প্রতি তাঁর বড় ঋন, মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা তাকে অনেক কিছু দিয়েছে। বিত্ত, বৈভব, প্রতিপত্তি, অর্থ, কি দেয়নি? কিন্তু দেশকে সে কিছুই দিতে পারেনি। মরমে মরে যায় ঈমান আলি, মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। আর এক কাপ কফি দরকার তাঁর। অদূরেই তিনজন বেয়ারা নির্দেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। দ্বিতীয় কাপে চুমুক দিয়ে ভাবতে থাকেন ঈমান আলি, দেশ ও জনগনের জন্য কিছু করতে হলে তো আরও অনেক অর্থ প্রয়োজন। রেন্টাল, শেয়ার বাজার, কমিশন থেকে যে কয়েকশ কোটি টাকা কামিয়েছেন, এ সামান্য কটা টাকা তো ছেলে মেয়েদের দরকার। পানিতে সাঁতরাতে সাঁতরাতে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন ঈমান আলি। দেশের জন্য কিছু করতে হলে আরও কয়েকটি প্রজেক্ট হাতে নিতে হবে। চিন্তায় ছেদ ফেলল বেয়ারা, একজন আগন্তক দেখা করতে এসেছেন তাঁর সাথে। বিরক্ত হলেন ঈমান আলি, টাওয়েল পেঁচিয়ে ড্রইংরুমে দাঁড়াতেই, বোটকা একটা গন্ধ নাকে এসে লাগে ঈমান আলির।

স্যার আমাকে চিনতে পারেন নি? আমি সেই কাশেম, আপনি আদর করে ডাকতেন কাশা বলে, বললেন আগুন্তক। ভ্রু কুচকালেন ঈমান আলি। স্যার মুক্তিযুদ্ধের সময়, কালিদহের গঙ্গাপুকুরের পাশে বড় বটগাছটির নীচে আমরা হানাদার বাহিনীর এ্যামবুশের মধ্যে পড়লে আমি আপনাকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে আপনার উপর শুয়ে পড়ি, যাতে আপনার গায়ে গুলি না লাগে। স্যার, আপনি তো জানেন, একটা গুলি আমার পায়ে লাগে, আরেকটি হাতে। পরে আমার পা' কেটে ফেলতে হয়েছে, এই যে দেখেন আমার কাঠের পা !! অনেক কষ্ট করে খুঁজে বের করেছি স্যার আপনাকে। আমি একজন দিনমজুর, আমার একমাত্র সন্তানের ব্লাড ক্যান্সার স্যার…। থামিয়ে দিলেন ঈমান আলি তাকে। এই আপনাদের নিয়ে হয়েছে এক জ্বালা, মুক্তিযোদ্ধা বলে আর কত সুফল ভোগ করবেন? দেশ স্বাধীন হয়েছে কি শুধু আপনাদের সুযোগসুবিধা আর সাহায্য দেয়ার জন্য? ক্ষোভে ফেটে পড়লেন ঈমান আলি, বোটকা গন্ধে এমনিতেই তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কাশেম মিয়ার ঠিক বুক বরাবর লাগলো গুলিটা।

৩। ফিরোজ শাহ, জনগণের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে, বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য হয়েছেন। ভাল মানুষ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি তাঁর। ভোটের আগে, তাঁর পক্ষে গ্রামের মানুষগুলো স্ব-উদ্যোগী হয়ে একে অপরকে চা-নাস্তা খাইয়েছে। পরম ভালবাসায় নিরন্ন মানুষগুলোই তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। তাঁর পক্ষে মিটিং-মিছিল করেছে, কিন্তু বিনিময়ে কোন পয়সা নেয়নি। ফিরোজ শাহ সাহেবকে ভোটের দিন পোলিং এজেন্ট খুজতে হয়নি, এলাকার যুবকেরা নিজেরাই ভোটকেন্দ্রে এজেন্টের দায়িত্ব পালন করেছে। ভূমিধ্বস বিজয়ের পর জনগণ নিজের টাকা খরচ করে ওনাকে মিষ্টি খাইয়েছে। বিপুল ভোটে বিজয়ী মাননীয় সংসদ সদস্য, বর্তমানে এলাকায় খুব একটা যান না। ভোলা-ভালা জনতা আর তাঁর দেখা পায়না, কোন মোবাইল উনি সরাসরি ধরেন না, বিপদে আপদে ওনার কণ্ঠস্বর শোনার সৌভাগ্য জনতার হয়না ।

জনগণের গায়ে ইদানিং খুব গন্ধ হচ্ছে, তাই তাদের সুযোগ হয়না তাঁর সাথে কোলাকুলি করার। ভোট পরবর্তী এলাকার ভাইদের উনি যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন। সকল উন্নয়নমূলক কর্মসূচির সিংহভাগ ভাইদের পকেটস্থ হওয়ার পর ছিটেফোঁটা জনগণের কপালে জোটে। স্কুল,কলেজ,মসজিদ-মাদ্রাসা, এতিমখানা এমনকি কবরস্থানের মাটিও বাদ যায়নি, ভাইদের খাওয়া থেকে। এলাকায় মাননীয় সদস্যের গাড়ির বহরে সামনে ২০/২৫, পিছনেও তদ্রুপ মোটরসাইকেলে মোটা-চিকনা ভাইদের মহড়া চলে, ভয়ে কম্পিত প্রকৃতি তা তাকিয়ে দেখে। রহিমুদ্দিন দূরে মাননীয়র মোটর বহর দেখে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে পড়ে। যে রহিমুদ্দিন গত নির্বাচনের পরের দিন তার পোষা ছাগলটা বিক্রি করে ফিরোজ শাহ সাহেবকে মিষ্টি খাইয়েছিল। চেহারা দেখে মতো রাস্তার উপর একটু এগিয়ে রহিমুদ্দিন সালাম দিলো, রহিমুদ্দিন স্পষ্ট দেখল শাহ সাহেব সালামের উত্তর দিলেন না। ধুলায় ধূসরিত কৃষক রহিমুদ্দিনের বুক বরাবর গুলিটা চলে গেল।

৪। জনাব আশরাফ আলি, প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তা। সুখী পরিবার, স্ত্রী এবং দুই কন্যা সন্তানকে প্রানের চেয়েও বেশি ভালবাসেন। অভাব তাদেরকে স্পর্শ করতে পারেনি। বড় মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ে, মেয়ের উচ্ছল আর প্রানবন্ত জীবন দেখে তৃপ্ত হন আশরাফ আলি। তাঁকে নিয়ে গর্ব বোধ করেন স্ত্রী আর মেয়ে। সই আর টুকে রাখা নম্বর সহ ৫০০ টাকার একটি বান্ডেল পকেটে রাখা অবস্থায় অফিসে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হাতেনাতে ধরা পড়েন আশরাফ আলি। আলামত হিসেবে তাঁর প্যান্ট-শার্ট জব্দ করা হয়, প্রহরীর লুঙ্গি পড়িয়ে হ্যান্ডকাফ পরানো অবস্থায় গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সংবাদ চলে যায় পরিবারের কাছে, মেয়ে স্কুল থেকে এসে শুনতে পায় বাবার কাহিনী, বোবা এবং হতবাক হয়ে
যায় সে। স্ত্রী সায়রা খাতুন সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনবার মূর্ছা যান। রাতে মা-মেয়ে টিভিতে, লুঙ্গি পড়া অবস্থায় আশরাফ আলিকে তুলে নেয়ার দৃশ্য দেখে। আশরাফ আলি, মা-মেয়ের বুক বরাবর গুলিটা করলেন।

৫। একটি অজপাড়া গাঁয়ের স্কুল মাস্টার বশির মিয়া, নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তবু খেয়ে না খেয়ে মা মরা একমাত্র মেয়ে শান্তাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে বশির মিয়া। শান্তা মায়ের মতই শান্ত হয়েছে। ছয় মাস বয়সে মা হারিয়ে, বাবা তাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। বশির মিয়া অবসরে মাটি কাটা শ্রমিকের কাজ করে, কখনো হাটের সময় মিষ্টির দোকানে সন্ধ্যায় দু'ঘণ্টা কাজ করে বাড়ি ফিরে খাতা কলম নিয়ে শান্তাকে পড়া দেখিয়ে দেয়। বশির মিয়া প্রায় স্ত্রীর কবরের পাশে শান্তাকে নিয়ে বসে তাকে নিয়ে তার মায়ের স্বপ্নগুলোর কথা মনে করিয়ে দিত। স্কুলের কোচিং আর বাবার প্রেরণায় শান্তা মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করে। গ্রামের এক বুবু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, শান্তারও শখ তার মতই সে ঢাকায় পড়বে। মেধাবী শান্তা সুযোগ পেয়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। নিঃসঙ্গ বাবা আর ঘুমিয়ে থাকা মাকে পেছনে ফেলে শান্তা চলে যায় ঢাকা। বশির মিয়া মেয়ের ভবিষ্যৎ আর আর চোখের পানি নিয়ে দাড়িয়ে থাকে সখিনা বিবির কবরের পাশে।

শান্ত শান্তা প্রানবন্ত আর উচ্ছল হয়ে ওঠে হোস্টেল, ক্লাসরুম ক্যাফেটেরিয়া আর বন্ধুদের আড্ডায়। কারো চোখের ভাষায় একদিন হারিয়ে যায় শান্তা। হটাৎ এলোমেলো হয়ে যায় শান্তার জীবন। আজ ক্লাসে যায়নি সে, একাকি নির্বাক বসে থাকে রুমে, দু'চোখে পানি, দুনিয়ায় কেউ নেই তার!! গলায় প্যাঁচানো ওড়নার দু'প্রান্ত সিলিং ফ্যানের সাথে বেঁধে পায়ের নিচ থেকে চেয়ারটা ঠেলে ফেলে দেয় শান্তা। মায়ের কবরের পাশে দাড়িয়ে থাকা বাবার ঠিক বুক বরাবর গুলি করে শান্তা।

৬। জরিনা বিবি, যমুনা নদীর চরে বাস তার। নদীর ভাঙ্গনে বারবার ছনে পাতার ঘর দুটির জায়গা বদল করতে হয়। স্বামী রুস্তম আলি নদীর মাছ আর চরের ছন বিক্রি করে সংসার চালায়। জরিনা বিবির স্বামী আর তিন মেয়ের অভাবি সংসার। বড় মেয়ে ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করতে যেয়ে চার বছর ধরে আর বাড়ি ফেরেনি। শুনেছে দালালদের খপ্পরে পড়ে বিদেশে বিক্রি হয়ে গেছে। মেঝো মেয়ে বন্ধ্যা বলে স্বামী পরিত্যাক্তা হয়ে মায়ের ভিটায় এসে উঠেছে। কাশফুল মাথায় ছোট মেয়ের সময় কাটে প্রায় জেগে ওঠা চরের পানিতে। যমুনার চরে ছন কাটতে কাটতে নদীতে মাছ ধরতে মিলিয়ে যাওয়া স্বামীর ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকার দিকে তাকিয়ে থাকে জরিনা বিবি।

সুখের আশায় জরিনা বিবি যমুনার চর ফেলে স্বামি আর দুই মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় এসে ওঠে। আশ্রয় হয় কমলাপুর রেল লাইনের পাশে বস্তিতে। স্বামী রিকশা চালায়, মেঝো মেয়ে গার্মেন্টসে চাকরি নেয়, ছোট মেয়ে ট্রাফিক জ্যামে ফুল বিক্রি করে। প্রচণ্ড গরমে রাতে জেগে কল্পনার জাল বোনে জরিনা বিবি। ঘুম ধরে না জরিনা বিবির, লেগে থাকা অট্টালিকার ঠাণ্ডা করার মেশিনগুলো থেকে গুমগুম করে শব্দ কানে ভেসে আসে তার ।

জরিনা বিবির স্বামী রিকসা চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় একটা পা' হারিয়ে এখন ভিক্ষা করছে। মেঝো মেয়ে গার্মেন্টসে আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছে। ছোট মেয়ে ফুল বিক্রি করতে যেয়ে নিরুদ্দেশ। জরিনা বিবি এক সাহেবের বাসায় কাজ করে। টিভির বিশাল পর্দায়, বাংলাদেশের নারীদের এভারেস্ট পর্বতের চুড়া বিজয়ের সংবাদ দেখছেন আনন্দে উচ্ছ্বসিত খালাম্মা। মেঝেতে বসে নারীদের সেই বিজয় দেখল জরিনা বিবিও। বিজয়ী নারীদের ছবি দেখে তার তিন মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল জরিনা বিবির। তার মনে হল, বুকের কোন এক জায়গা দিয়ে খচ্ করে একটা গুলি চলে গেল।