শহীদ বনাম লিমন ও খৎনা নিষিদ্ধকরণ

সাইদুর রহমান চৌধুরী
Published : 12 July 2012, 07:31 PM
Updated : 12 July 2012, 07:31 PM

গত কয়েক দিনের মধ্যে র‌্যার সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ঘটনায় ব্লগের পাতায় সুযুক্তি ও 'ততটা সংযুক্তি নয়' সম্বলিত বেশ কয়েকটি লেখা দেখেছি, পড়েছি। ঘটনা প্রবাহে এ সপ্তাহেই র‌্যাব-এর গুলিতে ডাকাত শহীদ নিহত হয়েছে, পঙ্গু করে দেয়া নিরীহ কিশোর লিমনকেই আবার মামলার জড়িয়ে হযরানী করা হচ্ছে, ওদিকে একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে র‌্যাব-এর কঠোর সমালোচনা প্রকাশ পাবার পর পক্ষে বিপক্ষে দুই ধারার জনমত তৈরী হয়েছে ও তৈরীর চেষ্টা চলছে। ব্লগের পাতায় মানবাধিকার সমুন্নত রাখার পক্ষে যেমন লেখা এসেছে, মানবাধিকার বিষয়ে ধারণা ছাড়াই মানবাধিকার সংস্থার মুণ্ডপাত করে লেখাও এসেছে। আমার প্রশ্নটি হচ্ছে, র্যা ব কতটা হিরো ও আর কতটা দানব?

খুব সংক্ষেপে বললে বলতে হয়, র‌্যাবের হাতে যে পরিমান অপরাধী 'বন্দুকযুদ্ধে নিহত' হয়, এরকম প্রশিক্ষিত বাহিনীর হাতে এত অপরাধী মারা পড়ার কথা নয়, ধরা পড়ার কথা। র‌্যাবের চেয়ে কম প্রশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও এবং কম সুযোগ সুবিধা নিয়েও পুলিশের গুলিতে এত অপরাধী প্রেপ্তার প্রক্রিয়ায় মারা পড়ে না। কাজেই এটা বলার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হবার দরকার নেই যে র‌্যাব হাতে মারা পড়ার ঘটনাগুলো কোন কোনটা হলেও সবগুলো দুর্ঘটনাজনিত নয়, বরং সিস্টেমেটিক হত্যাকাণ্ড। দেশের কোন আইনে কোন বাহিনীরই সিস্টেমেটিক হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন চালাবার অধিকার নেই, এটা অপরাধ। যেখানে আমরা শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রকে শারীরিক শাস্তি প্রদান রহিত করার যুগে প্রবেশ করেছি, সেখানে সরকারী আইন রক্ষাকারী বাহিনী গুলি করে মানুষ মারবে এটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পরে না। কাজেই র‌্যাব আমাদের কাছে হিরো প্রতিপন্ন হলেও মানুষ মারার ও লিমনের মতো নিরীহ কিশোরকে গুলি করে পঙ্গু করে দেয়ার পর আবার তাকেই মামলার অত্যাচারে জর্জরিত করার বিষয়গুলো দানবীয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে আমাদের রাষ্ট্র স্বাক্ষর করেছে, তাই এ ধরণের হত্যাকাণ্ড ও নিবর্তন বন্ধ করা রাষ্ট্রের ও সরকারের জন্য অবলিগেশন বা ফরজ।

এখন প্রশ্ন আসে, ডাকাত শহীদের মতো জঘন্য অপরাধীকেও ধরে আইনের আওতায় এনে আইনজীবি নিয়োগের সুযোগ দিয়ে সাজা দিতে হবে কেন, সরাসরি মেরে ফেললে অসুবিধা কী? প্রথম অসুবিধা হলো কে অপরাধী আর কে নয় সে রায় দেয়ার এখতিয়ার শুধুমাত্র আদালতের, অন্য কারো নয়। আদালতের দীর্ঘ বিচার প্রকৃয়ায় ভুল করার সম্ভাবনা অনেক কম বলেই এটাই বিশ্বস্বীকৃত পদ্ধতি অপরাধী বা নিরপরাধ সাব্যস্ত করার জন্য। দ্বিতীয় সমস্যা হলো, শহীদ ডাকাত যেমন অপরাধী, জনগনের জন্য অহিতকর, একই ভাবে যে ভদ্রলোক রাস্তায় গাড়ী পার্ক করে যানজট লাগিয়ে দেন তিনিও জনগণের জন্য অহিতকর। শহীদকে যদি প্রেপ্তার না করে গুলি করে ফেলে জায়েজ হয়, গাড়ীর মালিককে মামলা না দিয়ে সরাসরি গাড়িটিতে আগুন লাগিয়ে দিলে তা নাজায়েজ হবে কেন? আপনি যদি ফুটপাথ থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় হাঁটেন আপনাকে সতর্ক না করে পুলিশে এসে বুটের লাথি মেরে ফুটপাথে ওঠায় তাই বা নাজায়েজ হবে কেন? আপনার বাড়ির জেনারেটরের আওয়াজে আমার ঘুমের ব্যাঘাত হলে পুলিশ বা পরিবেশ অধিদপ্তর এসে আপনার জেনারেটরটি ভেঙ্গে দিলে কেমন হয়? গাড়ীর জানালা দিয়ে বাইরে থুথু ফেলার জন্য বা জনসমাগমের স্থানে ধূমপানের জন্য আপনার দুই গালে পুলিশ দুটো চড় দিলে কেমন হয়? আমার ধারনা আপনারাও একমত হবেন যে, এভাবে শাস্তি দিলে ব্যাপারটি খুবই তুঘলকি, অন্যায় ও মানবাধিকার পরিপন্থি হবে, সবচেয়ে বড় কথা দেশে আইন-শৃঙ্খলার পরিবর্তন মধ্যযুগিয় বর্বরতারই বিকাশ ঘটবে। আর সেজন্যই যে কোন বিচার বহির্ভুত সাজা অবৈধ, এটা চলতে দেয়া উচিত নয়, এর সপক্ষে কথা বলা (যত বড় ডাকাতের সাজাই হোক না কেন) সমাজকে অন্ধকারে টেনে নেবে শুধু, আজ একটা ছাড় দিলে কাল দশটা মানবাধিকার লঙ্ঘন ছাড় দিতে হবে।

তাই আসুন প্রথমত বোঝার চেষ্টা করি কোনটা অপরাধীর অপরাধ, কোনটা ক্ষমতাবানের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সিস্টেমেটিক নিয়ম লঙ্ঘন, বিচার কেন গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজের একমাত্র শাস্তিপ্রদান প্রকৃয়া; মানবাধিকার সংগঠনগুলো, সুশিল সমাজ, সংবাদমাধ্যম, ওয়াচডগ, ও হুইসেল ব্লোয়ার কেন একটি প্রগতিশীল সমাজের অত্যন্ত জরুরী প্রতিষ্ঠান।

ও ভালো কথা, খতনার বিষয়টি কী? এই তো গত দু'একদিনের মধ্যেই জার্মানীর একটি আদালত রায় দিয়েছে সেদেশে শিশুদের খৎনা করা যাবে না, কারণ এটা শিশু-মানবাধিকারের লঙ্ঘন। ইহুদি ও মুসলমানরা আবার ধরে বসেছে এটা তাদের ধর্মাধিকার চর্চার অধিকারের লঙ্ঘন – এ নিয়ে বিতর্ক হবে কিছুদিন, তারপর আবার হয়তো আদালতেই এর একটা সুরাহা হবে। প্রসঙ্গটি উল্লেখ করলাম এ জন্য যে মানবাধিকারের বিষয়গুলো কখনো কখনো গোলমেলে, তাই আলোচনা হওয়া উচিত। তবে সর্বস্বীকৃত কিছু বিষয় আছে সেসব নিয়ে উল্টো পথের লেখা দেখলে লেখকদের প্রতিই করুনার উদ্রেক হয় তাদের চিন্তার ও মানসিকতার দৈন্য দেখে – বিচার বহির্ভুত সিস্টেমেটিক হত্যাকাণ্ড ও অত্যাচার সেরকমই সর্বস্বীকৃত মানবাধিকার লঙ্ঘন।