ইসলামী দলগুলো কর্তৃক জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির বিরোধিতাঃ মূলে ধর্ম নাকি পুরুষতন্ত্র?

শাহরিয়ার শফিক
Published : 21 March 2011, 04:21 AM
Updated : 21 March 2011, 04:21 AM

বহু আলোচনা-সমালোচনা আর কাঠ-খড় পোড়ানোর পর অবশেষে গত ৭ মার্চ মন্ত্রীসভা কর্তৃক জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ গৃহীত হয় । এরপরই 'উত্তরাধিকার সম্পদে নারীকে পুরুষের সমান অধিকার' দেয়া হয়েছে ধুয়া তুলে তাৎক্ষণিকভাবে হরতাল ডাকে ইসলামী ঐক্যজোটসহ অন্যান্য ইসলামী দলগুলো । এর পুর্বেও ১৯৯৭ ও ২০০৮ সালে সরকারের নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করলেও তার বাস্তবায়ন পিছিয়ে যায় ধর্মীয় দলগুলোর বাঁধার মুখে । নারী উন্নয়ন নীতির বিরোধিতার কারণ হিসেবে তারা বলেন এই নীতিতে উল্লেখিত 'সম্পদে নারীর সমান অধিকার' এবং 'সকল নারীর সম-সুযোগ ও সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করা' বিষয়গুলো ইসলামী আইনের পরিপন্থি । এ কারণেই তারা এই নীতির বিরোধিতা করছে (bdnews24.com, ১৮ মার্চ ২০১১) ।

অথচ একই সূত্রে উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী নীতিমালার কোথাও উত্তরাধিকার সম্পদে নারীকে পুরুষের সমানাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়নি । গত ৯ মার্চ মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শিরীন শারমিন চৌধুরী এক সংবাদ সম্মেলনে মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের সঙ্গে এ নারী নীতি সাংঘর্ষিক না হওয়ার যুক্তি তুলে ধরেন । তিনি বলেন, "এতে সম্পত্তিতে সমানাধিকার দেয়া নিয়ে কোনো কথা উল্লেখ করা হয়নি। মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী সম্পত্তি যেভাবে বণ্টন হওয়ার কথা, সেভাবেই হবে। এর সঙ্গে নারী নীতির কোন সংঘর্ষ নেই।" মূলত এই নীতিতে ভূমিতে নারীর অধিকার, সম্পদ অর্জন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, উত্তরাধিকার, ঋণ, তথ্য-প্রযুক্তি ও উপার্জনের সুযোগের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ অধিকারের কথা বলা হয়েছে । সেই সাথে এসব অধিকারের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য প্রযোজনীয় ক্ষেত্রে নতুন আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে । সুতরাং তাদের বিরোধিতার কারণ হিসেবে উল্লিখিত প্রথম যুক্তিটি ভ্রান্ত ও অসার ।

তাদের বিরোধিতার দ্বিতীয় কারণ নীতিতে সকল নারীর সম-সুযোগ ও সম-অধিকারের উল্লেখ, যা তাদের মতে ইসলামী আইনের পরিপন্থী । কিন্তু এটিও ভ্রান্ত যুক্তি । প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ড. জামাল আল বাদাবী তার 'Islamic Teaching Course' গ্রন্থে কুরান-সুন্নাহর সূত্র উল্লেখপূর্বক যুক্তি দিয়ে দেখান যে ইসলাম নারীকে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই সম-সুযোগ ও অধিকার প্রদান করেছে । এবং ইসলাম এসব ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের মতই পুর্ণ নিন্ত্রনের অধিকার দিয়েছে । সুতরাং জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি কোনভাবেই ইসলামে প্রদত্ত নারীর অধিকার বা আইনের পরিপন্থী নয় । বরং কিছু ক্ষেত্রে ইসলাম নারীকে যেসব অধিকার দিয়েছে তার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেনি বা নারীর অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে ।

ইসলামী ঐক্যজোট তাদের আপত্তির অপর যে কারণটি উল্লেখ করেছে তা হল এই নীতি 'নারীকে পুরুষ বানানোর তদবির ও কলাকৌশল মাত্র । আমার মনে হচ্ছে এটিই একমাত্র কারণ যার ফলে তারা জাতীয় নারী নীতির বিরোধিতা করছে । অর্থাৎ তাদের বিরোধিতার মূলে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার সযত্ন লালন । মূলত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বশবর্তী হয়েই তারা এই নীতির বিরোধিতা করছে এবং বিরোধিতার অস্ত্র হিসেবে তারা ধর্মকে ব্যবহার করছে । যেমনটি করে তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এবং রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য ।

ইসলামী ঐক্যজোটের মত কায়েমী স্বার্থবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী সবসময়ই উন্নয়ন ও প্রগতির শত্রু । তারা প্রাচীন ভাবধারা ও সুংস্ক্রৃতির বশবর্তী হয়ে জাতিকে টেনে ধরে পেছন থেকে । তারা তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে । প্রতারিত করে ধর্মপ্রাণ মানুষকে এবং তাদের আবেগকে পুঁজি করে বাধাগ্রস্ত করে প্রগতির সচল চাকা । আর তাদের ফাঁদে পা দিয়ে বিভিন্ন সময় গণরায়ে নির্বাচিত সরকারগুলো পিছিয়ে যায় জাতীয় উন্নয়নে গৃহীত বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ থেকে । সুতরাং এইসব কায়েমী স্বার্থবাদীদের ক্রীড়াণক না হয়ে গণরায়ে নির্বাচিত সরকারের প্রয়োজন এই নীতির পরিপূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন । যুগপৎভাবে নারীর সামগ্রিক উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন সম্পুরক নীতি ও আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন যা উন্নয়নের পথে বাধা সমূহ অপনোদনে সহায়ক ভুমিকা পালন করবে । পাশাপাশি নারীর পরিপূর্ন বিকাশের জন্য পুরুষের মতই আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রে নারীর সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা হোক ।