পরাগ উদ্ধারে মুক্তিপণ ও সরকারী গোপন আইন

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 27 Nov 2012, 05:50 PM
Updated : 27 Nov 2012, 05:50 PM

সম্প্রতি ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ থানা এলাকার বিমল মণ্ডলের নাবালক পুত্র পরাগ অপহরণ ও উদ্ধার নিয়ে সারা দেশে একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। অক্ষত অবস্থায় পরাগ উদ্ধার এবং পরবর্তীতে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ(ডিবি) কর্তৃক আহত অবস্থায় অপহরণকারী আমীরের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে সে পরিস্থিতির অবসান ঘটেছে। কিন্তু যে বিষয়টিতে এসে এই ঘটনাটির উপর থেকে আগুনের শিখার প্রজ্জ্বলন থামছে না, বরং বাড়ছে, তা হল, পরাগকে ৫০ লাখ টাকা মুক্তি পণের বিনিময়ে ছাড়িয়ে আনা হয়েছিল, না হোস্টেস নিগোশিয়েষণ কৌশলের মাধ্যমে তাকে বিনা মুক্তিপণেই ছাড়িয়ে আনা হয়েছিল।

মুক্তিপণের টাকা দেওয়া-নেওয়া বিতর্কে প্রবেশ করা নয়, বরং আমার বর্তমান লেখনির মূল হচ্ছে কোন ব্যক্তির টেলিফোনিক কথাবর্তা জরুরী প্রয়োজনে রেকর্ড করে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করার যৌক্তিতা নিয়ে।

সম্প্রতি পরাগের বাবার সাথে অপহরণকারীদের টেলিফোনিক কথাবার্তার একটি লিখিত রূপ প্রকাশ করা হয়েছে দৈনিক পত্রিকায়( দেখুন আমাদের সময় ২৬ নভেম্বর,২০১২
http://www.amadershomoy2.com/content/2012/11/26/news0840.htm
দৈনিক প্রথম আলো, ২৬ নভেম্বর, ২০১২ http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-11-25/news/308426)। হয়তো শিঘ্রই এই কথোপকথনের এমপি-৩ ভার্সনও বিভিন্ন ওযেব সাইটে পাওয়া যাবে। এই টেলিফোনিক কথোপকথন জনসম্মুখে তুলে দেওয়ার বিষয়টিকে অন্তত দুইটি কারণে আমি তীব্র বিরোধীতা করি।

১। কোন ব্যক্তির টেলিফোনে আঁড়ি পাতা অনৈতিক। একমাত্র জরুরী প্রয়োজন ভিন্ন এই ধরণের আঁড়ি পাতা কোনভাবেই সমর্থন করা যায় না।দেশ ও জাতির স্বার্থে আইনের মধ্য থেকে গোয়েন্দারা ফোনে আঁড়ি পাততে পারেন। পরাগকে অপহরণকারীদের হাত থেকে উদ্ধারের জন্য আলোচ্য ঘটনায় ফোনে আঁড়ি পাতা বৈধ ও প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু টেলিফোনের সংলাপ বাইরে প্রকাশ করা ছিল অন্যায়, অনৈতিক ও রীতিমত বেআইনী।

বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য আমরা কোন শল্যচিকিৎসক কর্তৃক কোন ব্যক্তির গোপন অংগে অস্ত্রপচারের উদাহরণটি টেনে আনতে পারি। কোন ডাক্তার যদি কোন ব্যক্তির গোপন অংগে অস্ত্রপচার করেন, তবে গোপন অংগের যাবতীয় বিষয় অবলোকন করা তার জন্য বৈধ। কিন্তু সেই ডাক্তার যদি বাইরে এসে সেই গোপন অংগের বর্ণনা দিতে শুরু করেন, কিংবা অস্ত্রপচারকালীন সকল কর্মকাণ্ড ভিডিও করে তা জনসম্মুখে ছেড়ে দেন, তবে তা হবে চরম অন্যায়, অবৈধ। এটা শুধু রোগীর জন্যই নয়, ডাক্তারের জন্যও অমর্যাদাকর হবে।

২। গোয়েন্দাদের কর্মকাণ্ড সব সময় গোপন থাকবে। গোপনে কোন বিষয়ে খবর সংগ্রহ করা হলে তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের দলিল হয়ে যায়। এই দলিল যত তুচ্ছই হোক তা বাইরে প্রকাশ করার আইনগত অধিকার কোন গোয়েন্দা কর্মকর্তার নেই। পরাগের বাবার সাথে অপহরণকারীদের টেলিফোনিক কথোপকথন অতি সাধারণ বিষয় হতে পারে। কিন্তু এই সাধারণ কথোপকথন সরকার ও জাতির জন্য যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, তা অন্তত সরকারি কর্মচারিদের বুঝতে হবে। সরকারকে যদি একজন অতিমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি মনে করি( বিভিন্ন সমাজ ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের মতে রাষ্ট্র এক সমষ্টিগত ব্যক্তিই বটে), রাষ্ট্রের গোপন দলিল জনসম্মুখে প্রকাশ করা ব্যক্তিরূপী রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক বৈকি।

অভিজ্ঞ মহল নিশ্চয় স্বীকার করবেন, মুক্তিপণ দিয়ে পরাগকে মুক্ত করা হয়েছিল কিনা, সেই প্রশ্নের চেয়েও বর্তমানে যে প্রশ্নটি জাতির সামনে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে তাহল, এই বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার একাধীক কর্মকর্তা পরষ্পর বিরোধী বক্তব্য দেওয়ার বিষয়টি। এই সম্পর্কে অর্বাচীন বক্তব্যগুলো সরকারের জন্য ভীষণ নাজুক। সরকার যা বলছে বা বিশ্বাস করছে, তাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছেন সরকারেরই কতিপয় কর্মচারি!

আমি মনে করি, সরকারী দলিলপত্রাদির গোপনীয়তা রক্ষার পদ্ধতিটি সরকারের নতুন করে ভেবে দেখা উচিত। কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের পূর্বে সরকারী গোপন আইন সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঠিকমাত্রার জ্ঞানদান করা কিংবা ইতোপূর্বে অর্জিত জ্ঞানের পুনঃপরীক্ষার প্রয়োজন।