অপরাধ, অপরাধী ও ফ্রয়োডিয় মনোদর্শন

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 19 April 2014, 07:52 AM
Updated : 19 April 2014, 07:52 AM

মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে পবিত্র কোরান থেকে শুরু করে বিতর্কিত ফ্রয়োডিয় দর্শনেও মূলত মানুষকে উন্নত পশুর সাথেই তুলনা করা হয়েছে৷ মানুষকে যদিও কোরানে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব বলে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু সেই সাথে কোরানের অনেক আয়াতে মানুষের পশু প্রবৃত্তিকে স্বীকার করে তাকে বসে রাখার বিভিন্ন কলাকৌশল বা ধর্মীয় অনশাসন ও অনুশীলনের কথাও বলা হয়েছে৷

ফ্রয়োডিয় মনোদর্শন অনুসারে, মনের তিনটি স্তর রয়েছে, যথা -অচেতন, অবচেতন ও চেতন৷ চেতন ও অবচেতন মনের সামান্য স্তর পেরিয়ে মানুষের মনের সুবৃহত্ স্তরটি হল অচেতন স্তর৷ মানুষের চিন্তা-চেতনা, চাওয়া-পাওয়া আর কামনা-বাসনার অজানা স্তর হল এই অচেতন স্তর৷ এই স্তর সম্পর্কে মানুষ ততোটা সচেতন নয়৷ এই অচেতন স্তর মানুষের কাছে শুধু দুর্জ্ঞেয়ই নয়, অজ্ঞেয়ও বটে৷ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অসীমতার অজানা তত্ত্ব আবিষ্কার ও গুঢ় হথ্য হস্তগত করলেও মানুষ তার দেহস্থিত মনকেই সঠিকভাবে জানতে পারে না৷
অন্যদিকে ব্যক্তিত্ব বিকাশের ৰেত্রে ফ্রয়োড মানুষের মনের কয়েকটি উপাদান বা উপাঙ্গের কথা উল্লেখ করেছেন৷ এগুলো হল ইড, ইগো ও সুপার ইগো৷ বাংলা ভাষায় ফ্রয়েডের এই জার্মান প্রত্যয়গুলোকে প্রকাশ করা বড়ই কঠিন৷ তবে ইগোকে অহং ও সুপার ইগোকে বিবেকবোধ নামে অনেকে অবিহিত করেছেন৷

মানুষের অচেতন মনের পুরোটাই জুড়ে ইডের অস্তিত্ব৷ মানব শিশু ইড নিয়েই জন্ম গ্রহণ করে৷ ইড হল মানুষের আদি কামনা-বাসনার অকৃত্রিম আকর৷ ইড পশুপ্রবৃত্তি বা সুখ-নীতির দ্বারা পরিচালিত৷ এটা ন্যায়-অন্যায় বোঝে না৷ এর একমাত্র চালিকা শক্তি হল আনন্দ প্রাপ্তি৷ যা আনন্দ দিতে পারে না, ইডের সাথে তার সম্পর্ক নেই৷ ইড দুঃখকে সচেতনে পরিহার করে শুধু সুখই কামনা করে৷ মানুষ ও পশুকুল যে সমগোত্রীয় তা এই ইডের অস্তিত্বের কারণেই৷

ক্রমেই মানব শিশুর মনে অহংবোধের জন্ম হয়৷ শিশু তখন রাগ করতে শেখে, ভালবাসতে শেখে ও ঘৃণা করতে শেখে তখন থেকেই শিশুর মনে অহংবোধের জন্ম হয়৷ তবে এই প্রেম-ভালবাসা-ঘৃণা-রাগ-বিরাগের চেয়েও বড় কথা হল, অহংবোধ মানব শিশুকে ইডের চাহিদা পূরণে বাস্তব অবস্থার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়৷ অহংবোধ প্রকৃত পক্ষে মানুষকে ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করতে নয়, তাকে ব্যাবহারিক জ্ঞান দিয়ে বাস্তবসম্মত উপায়ে আনন্দের বস্তু প্রাপ্তিতে সহায়তা করে৷ এই ৰেত্রেও অহংবোধ প্রকত পৰে ইডের তাড়না দ্বারাই পরিচালিত হয়৷ অতএব, ইড ও ইগোর সমন্বয়ে যে মানুষ তা মূলত পশুর উন্নত সংস্করণ৷

অতঃপর মানুষের মধ্যে সুপার ইগোর সৃষ্টি হয়৷ সুপার ইগো হল, বাংলা ভাষার বিবেক যা মানুষকে ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করতে শেখায় ও অন্যায়কে পরিহার করে ন্যায়কে গ্রহণ করতে সাহায্য করে৷ মানুষের মনে বিবেকবোধ তিন/চার বছর বয়সেই তৈরি হতে শুরম্ন করে ও পাঁচ বছর বয়সেই তা পূর্ণতা লাভ করে৷ ফ্রয়োডের মতে মানব শিশুর ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ পাঁচ বছর বয়সেই সম্পন্ন হয়৷ এর পর সারা জীবন আর তার কোন পরিবর্তন হয় না৷

মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশে যৌন তাড়নার শুধু আধিক্যই নয়, ফ্রয়োডের মতে মানুষের গোটা জীবনের প্রতিটি কাজই যৌনজাত৷ মানব শিশু জন্মের পর থেকে যৌবনে পদার্পন পর্যন্ত বেশ কিছু যৌনস্তর পার করে৷ এক স্তর থেকে অন্য স্তরে পৌঁছার জন্য মানুষের মনোজগতে অদৃশ্য পরিবর্তন সাধিত হয়৷ এইসব পরিবর্তন প্রক্রিয়ার কিছু স্বাভাবিক নিয়ম রয়েছে৷ এই স্বাভাবিক নিয়মের কোন ব্যতীক্রম হলেই ঘটে বিপত্তি৷ এই সব বিপত্তি মানুষকে পরিণত বয়সে শুধু মানসিক বিকারগ্রস্তই করে না, তাকে অপরাধী করেও তোলে৷ এমতাবস্থায়, কোন মানব সন্তানের অপরাধী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে তার ত্রুটিপূর্ণ মানসিক বিকাশই দায়ী৷ মানুষের মধ্যে বিবেকবোধ বা সুপার ইগো যদি সঠিকভাবে বিকশিত না হয় এবং সুপার ইগো যদি ইডের আদিম কামনা আর অহংএর বাস্তবসম্মত অথচ নীতিহীন সমস্যার সমাধান প্রক্রিয়াকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে সেই মানুষ আজীবন অপরাধকর্মে নিয়োজিত থাকবে৷