‘তিন পতাকার তলে’ আমি দ্বিতীয় বার পড়লাম; আপনিও পড়ুন

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 8 Nov 2014, 02:17 PM
Updated : 8 Nov 2014, 02:17 PM

২০০১ সালে সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে মৌলিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের সময় কাজী আনোয়ারুল হকের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ 'তিন পতাকার তলে' প্রথম বার পড়েছিলাম। তখন ছিলাম পুলিশ সার্ভিসে খুবই নতুন। অনেক বিষয় তেমন ভালভাবে জানতাম না, বুঝতামও না। তাই বইটির প্রতি ততো বেশি আকর্ষণও ছিল না। এক যুগ পর আবারো বইটি পড়লাম।

লেখক কাজী আনোয়ারুল হক ছিলেন মাত্র কয়েকজন বাঙালির মধ্যে অন্যতম যারা গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের দিকে ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের উচ্চতর পদে যোগ দিয়েছিলেন। তবে তার একটি অন্য পরিচয়ও রয়েছে। তিনি বিখ্যাত ঔপন্যাসিক কাজী ইমদাদুল হকের ছেলে। কাজী ইমদাদুল হক তার 'আব্দুল্লাহ' উপন্যাসে মধ্য ও আধুনিক যুগের সন্ধিক্ষণে বাঙালি মুসলমান সমাজের বাস্তব চিত্র এঁকে বাংলা সাহিত্যে অমরত্ব লাভ করেছেন।

লেখকের পিতৃনিবাস ছিল খুলনা জেলায়। তার জন্ম ১৯০৯ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে তিনি ১৯৩৩ সালে ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসে যোগদান করেন। তার সাথে বাংলা থেকে আর একজন মাত্র ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন। তার নাম ছিল হাফিজ উদ্দিন। জনাব হাফিজও তিন পতাকার তলে কাজ করেছিলেন। তবে জনাব আনোয়ারুল হকের মতো নাম ডাক করতে পারেন নি। অন্য দিকে তিনি আমাদের জন্য কিছু লিখেও যাননি। স্বাভাবিকভাবে তিনি এখন বিস্মৃতপ্রায়।

জনাব আনোয়ারুল হক ব্রিটিশ পতাকার তলে পুলিশ সুপার পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়েছিলেন। তবে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পরেই তিনি অন্যদের মতো তড়িৎ গতিতে অগ্রসর হতে থাকেন। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের প্রথম দিকে তিনি অতিরিক্ত উপ-সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পুলিশের আইজিপি নিযুক্ত হন ১৯৫৮ সালে।

পুলিশ সার্ভিস থেকে ক্রমশ তিনি সাচিবিক সার্ভিসে ঝুঁকতে থাকেন। ১৯৬১ সালে তিনি প্রাদেশিক সরকারের প্রধান সচিব নিযুক্ত হন। ১৯৬৩ সালে তিনি পাকিস্তান কেন্দ্রিয় সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।

এর পর তিনি স্বয়ং দেশ পরিচালনায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালে আইয়ুব খান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে তিনি আইয়ুব সরকারের কেবিনেট মন্ত্রী নিযুক্ত হন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ কালীন তিনি ঢাকায় অবসর জীবন যাপন শুরু করেন। ১৯৭৫ সালে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলে বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সময় রাষ্ট্রপতি একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন । সেনা প্রধান জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে এই উপদেষ্টা পরিষদে প্রথম দিকে মূলত তিন বাহিনীর প্রধানগণই ছিল। পরবর্তীতে এই পরিষদে বেসামরিক সদস্য অন্তর্ভূক্তির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই উপদেষ্টা পরিষদের বেসামরিক সদস্যদের মধ্যে জনাব আনোয়ারুল হক ছিলেন অন্যতম। ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হতে কাজী আনোয়ারুল হক জিয়া সরকারের কেবিনেট মন্ত্রী নিযুক্ত হন।

পুলিশ অফিসারদের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থগুলো আমাকে দারুণ আকর্ষণ করে। ভারতীয় উপমহাদেশে বিধিবদ্ধ পুলিশ সৃষ্টির পূর্ব থেকে শুরু করে বর্তমান কাল অবধি অনেক পুলিশ অফিসারের আত্মজীবনী আমি পড়েছি। তবে কাজী আনোয়রুল হকের 'তিন পতাকার তলে' বইটি বিভিন্ন দিক দিয়ে ভিন্নতর। এই বইয়ে লেখক তার নিজের সম্পর্কে সামান্যই বলেছেন। তার মতে, 'ব্যক্তিগত কৌতূহল নয়, সাধারণের কৌতূহল মেটায়' এমন ঘটনাগুলোই তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন। বইটি পড়ে, তাই, ব্রিটিশ সরকারের শেষকাল, পুরো পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশ সমযের প্রথম দশক সম্পর্কে ভিন্নতর কিছু তথ্য, কিছু ব্যাখ্যা ও কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতির সন্ধান লাভ করা যায়।

বর্ণাঢ্য চাকরি ও ব্যক্তি জীবনে লেখক স্বাভাবিকভাবেই তিনটি পৃথক পৃথক পতাকার তলে কাজ করেছেন। বৃটিশ পতাকার তলে পুলিশ অফিসার হিসেবে, পাকিস্তানী পতাকার তলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন অফিসার, সচিব ও মন্ত্রী এবং সর্বশেষ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার তলে উপদেষ্টা ও মন্ত্রীর কাজ তিনি করেছেন।

অন্যদিকে লেখব তার কর্মজীবনেও পৃথক তিনটি ক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাদ নিয়েছেন। পুলিশ সার্ভিসের সর্বোচ্চ পদ, কেন্দ্রিয় আমলা তন্ত্রের সবোর্চ্চ পদ ও রাজনীতির অঙ্গণেও তিনি শীর্ষের কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন।

'তিন পতাকার তলে' বইটির মূলত ইংরেজিতে লেখা যার নাম 'Under Three Flags'. কিন্তু মূল বইটি আমার পড়ার সুযোগ হয়নি। আমি পড়েছি ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলা অনুবাদখানা। বর্তমানে বইটি বাজারে পাওয়া যায় না। আমি বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি, সারদা ও বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের গ্রন্থাগার থেকে ধার করে এই বাংলা অনুবাদটি পড়েছি।

বইটির এক কপি সংগ্রহের জন্য আমি বাংলা একাডেমিতে গিয়েছি। কিন্তু সেখানেও বিক্রয় করার মতো কোন কপি নেই। আর মূল গ্রন্থখানা যে কোথায় আছে তাও বলা মুস্কিল। যদি কারো কাছে থেকে থাকে তাহলে তার একটি কপি/ফটোকপি আমার পুলিশ স্থাপনারগুলোর যে কোন লাইব্রেরিতে দেয়া গেলে হয়তো জ্ঞানপিপাসু পুলিশ অফিসারগণ তা পড়তে পারতো।September 14, 2013