কমিউনিটি পুলিশিং কোন কর্মসংস্থান সৃষ্টির কৌশল নয়

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 4 Nov 2014, 12:01 PM
Updated : 4 Nov 2014, 12:01 PM

ফেইসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে চোখ আটকে গেল গাজীপুর জেলা ট্রাফিক বিভাগের পাতাটিতে। মোতালেব, বাদশা ও সুরুজ নামের তিনজন হলুদ জ্যাকেট পরা ব্যক্তির ছবি দিয়ে একটা ক্যাপশন তৈরি করেছেন  জনাব সাখাওয়াত হোসেন, সহকারী পুলিশ সুপার, শহরও যানবাহন নিয়ন্ত্রণ শাখা, জেলা পুলিশ, গাজীপুর । সাথে তার বা তার অফিসের মোবাইল ফোনের নম্বরটিও দেয়া আছে। একজন তরুণ ও উদ্যোমী পুলিশ অফিসার হিসেবে আমি সাখাওয়াতের কাজকর্মে মুগ্ধ। তার সাথে কোন দিন চাকরি করিনি। জানিনা সেও আমাকে চিনে কি না। তবে তার সাথে আমার সামনাসামনি সাক্ষাত না হলেও কমিউনিটি পুলিশিং এর একজন মিশনারি হিসেবে সাখাওয়াত নিশ্চয়ই আমাকে জানে।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফেইসবুককে ব্যবহার করে জনগণের সাথে সেতু বন্ধন তৈরি ও জনগণের সাথে অনানুষ্ঠানিক সংলাপ তৈরিতে আধুনিক কালের পুলিশ অফিসারগণ ইতোমধ্যেই সুনাম কুড়িয়েছেন। উত্তরা জোনের এসি পেট্রোল মাসফি তার ফেইসবুকের মাধ্যমে উত্তরা এলাকার জনগণকে বিশেষ করে মধ্যবিত্য ও শিক্ষিত শ্রেণিটিকে এমন ভাবে প্রভাবিত করেছেন যে গত কয়েক দিন আগে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে একজন অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল মাসফির অকুণ্ঠ সুনাম করছে। যদিও মাসফি বর্তমানে পড়াশোনার জন্য জাপানে আছেন, তারপরও সে উত্তরার জনগণের সাথে ভার্সুয়াল জগতের মাধ্যমে বর্তমান রয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দিয়ে জনগণের কাছে যাওয়ার বিষয়টি কমিউনিটি পুলিশিং দর্শনের বাস্তব রূপ বলেই ধরে নিতে হবে। কারণ, পুলিশ জানে তাকে যে কোন প্রকারেই হোক জনগণের কাছে যেতে হবে। তাকে শুধু নৈর্ব্যক্তিকভাবে সেবাদানকারী সরকারি কর্মচারিটি হয়ে থাকলেই চলবে না। তাকে মানুষের সাথে সামনাসামনি ও ব্যক্তিগত যোগাযোগ বজায় রাখতে হবে। ফেইসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো পুলিশের সাথে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত ও সামনাসামনি যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি পূর্ব প্রস্তুতি স্বরূপ।

যাহোক, গাজীপুর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ এমনটিই করছেন বলে ফেইসবুকের পাতা থেকে বুঝতে পারলাম। তবে ফেইসবুকের পাতা দিয়ে কমিউনিটি পুলিশিং দর্শন ও নীতিও প্রচার ও প্রসার করা সম্ভব। নিবন্ধ, ক্ষুদ্র বার্তা, বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ছবি প্রকাশ, চ্যাটিং কিংবা ইনবক্স বার্তার মাধ্যমে বিদগ্ধ এলাকাবাসি তাদের ব্যবহারিক জীবনের প্রাত্যহিক পুলিশি চাহিদাগুলো পূরণের পাশাপাশি পুলিশিং বিষয়েও নতুন জ্ঞান অর্জন করতে পারে, ইতোমধ্যে অর্জিত জ্ঞানকে শানিত করতে পারে এবং কোন প্রকার ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হলে তা নিরসনও করতে পারে।

গাজীপুর জেলার ফেইসবুক পাতায় প্রকাশিত ছবিটি কমিউনিটি পুলিশিং এর মৌল দর্শন নিয়ে অনেক সময় ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে। তাই কোন ছবি প্রকাশ, কোন বার্তা প্রকাশ কোন আবেদন, নিবেদনের ক্ষেত্রে আমাদের  কমিউনিটি পুলিশিং এর দর্শন ও নীতিগত বিষয়টি দেখতে হবে।

এটা স্বীকার্য যে কমিউনিটি পুলিশিং একটি নতুন ধরনের পুলিশিং দর্শন। এ দর্শনের আওতায় পুলিশ জনগণের সাথে অপরাধ দমন ও বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধের জন্য অংশীদারিত্ব তৈরি করে। এ অংশীদারিত্ব শুধু উপদেশ, বা ব্যক্তিগত অংশগ্রহণের মধ্যেই সীমিত নয়। পুলিশ জনগণের সাথে অংশীদারিত্ব করে তাদের অধিকারে থাকা সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও সম্পদের বৃদ্ধি করে।

রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের সাথে কাজ করা লোকগুলোকে  ছবিতে রীতিমত পুলিশ বানিয়ে দেয়া হয়েছে। আর তার নাম  দেয়া হয়েছে 'কমিউনিটি পুলি'শ। তার মানে হল, এদের দিয়ে গাজীপুর ট্রাফিক বিভাগ একটি নতুন পুলিশ ফোর্স তৈরি করেছে যাকে বলা হতে পারে 'কমিউনিটি পুলিশ বাহিনী'।

ফেইসবুকে দেয়া স্টাটাস অনুযায়ী  কমিউনিটি পুলিশের সদস্য এসব ব্যক্তিকে পূর্বে রীতিমত ভাতা দেয়া হলেও মাঝখানে তা বন্ধ ছিল। কিন্তু তাই বলে তারা তাদের ট্রাফিক ডিউটি বন্ধ রাখেননি। তারা নিয়মিত ভাতা ছাড়াই ট্রাফিক পুলিশকে সহায়তা করেছেন। তবে তারা গাড়ি/যানবাহন থেকে কোন না কোন ভাবে কিছু না কিছু অর্থ উত্তোলন করত। যান বাহন থেকে এভাবে রাস্তায় প্রকাশ্যে অর্থ গ্রহণ রীতিমত চাঁদাবাজির পর্যায়ে পড়ে। এর জন্য পুলিশ বিভাগের প্রভূত দুর্নাম হয়। অনেক সময় দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তারা এসব ব্যক্তিকে দিয়ে নিয়মিত বখরা তোলেন। শাস্তি বা গ্রেফতারের আওতায় না এলেও এগুলো কিন্তু ওপেন সিক্রেট হয়ে গেছে। তাই অর্থের জন্য রাস্তায় ডিউটি করা এসব তথাকথিত 'কমিউনিটি পুলিশ' সম্পর্কে পুলিশ কর্তাদের অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, কমিউনিটি পুলিশিং মানে অন্যকে দিয়ে আপনার সমস্যা সমাধান করা নয়। বরং আপনি নিজেই অন্যদের সহায়তা নিয়ে নিজ সমস্যার সমাধান করবেন।  তবে হ্যাঁ, আপনি কোন কাজের জন্য স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করতে পারেন। এই স্বেচ্ছাসেবকগণ কিছুটা পারিশ্রমিক বা সম্মানি পেতে পারে। তবে এটা কোন ক্রমেই তাদের পেশা হতে পারবে না। এদের সম্মানি ভাতা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের স্বেচ্ছাভিত্তিক চাঁদার মাধ্যমে সংগ্রহ করা যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হল তারাই কোন সমস্যা যাদের প্রভাবিত করে। কোন সমস্যা দ্বারা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে সমস্যার সাথে আমার কোন সংশ্রব নেই, যে সমস্যা আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, সেই সমস্যা সমাধানের জন্য আমাকে কেউ টানা হেঁছড়া করুক, আমি তা চাইব না।

হ্যাঁ, স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা কমিউনিটি পুলিশিং নীতির মধ্যে পড়ে। কিন্তু সেচ্ছাসেবা তো স্থায়ী কিছু নয়। এটা যেমন স্বেচ্ছায় হতে হবে, তেমনি এর জন্য নিয়মিত মাসোহারা, সম্মানী বা বেতনের বিধান করা সঙ্গত হবে না। এএসপি সাখাওয়াতের ভাষায়, 'দীর্ঘ ০৬ (ছয়) মাস পর এপ্রিল মাস থেকে নিয়মিতভাবে তারা তাদের সম্মানী ভাতাটা পাচ্ছেন । অবশেষে হাসি ফুটল ৩টি পরিবারের সদস্যদের'। কিন্তু এ হাসি ফোটানোর  ঘটনাটি কমিউনিটি পুলিশিং নীতির সাথে যায় না। কারণ কমিউনিটি পুলিশিং কোন সমাজ সেবা নয়। এটা মানুষের জন সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কাজ করে না। সমস্যার কারণ হিসেবে কর্মসংস্থানের বিষয়টি আসতে পারে। কিন্তু কমিউনিটি পুলিশিং এর স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করে কোন কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়টি কোনভাবেই কমিউনিটি পুলিশিং এর সাথে সম্পৃক্ত নয়। কারণ এটাকে যদি আপনি কমিউনিটি পুলিশিং বলেন, তাহলে বাংলাদেশের সিকিউরিটি গার্ডগুলোকে কমিউনিটি পুলিশিং বাহিনীর সদস্য বলতে হবে। স্বেচ্ছাসেবকদের গায়ে জ্যাকেট দেয়া যেতে পারে। তবে জ্যাকেটে সুস্পষ্টভাবে ভলান্টিয়ার বা স্বেচ্ছাসেবক কথাটি লেখা থাকতে হবে। কোন ক্রমেই কমিউনিটি পুলিশ বা পুলিশিং এ ধরনের লেখা লিখা যাবে না।

সবচেয়ে বড় কথা কমিউনিটি পুলিশিং এর মাঠ পর্যায়ের কৌশল পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের মাধ্যমে কোন নির্দেশনা বা সার্কুলার ইসু  করে নির্ধারণ করা সম্ভব হবে না। প্রত্যেকটি কমিউনিটিই পৃথক, প্রত্যেক কমিউনিটির নিজস্ব ও পৃথক মূল্যবোধ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও সম্পদ রয়েছে। স্থানীয় পুলিশ অফিসারদের তাই স্থানীয় কমিউনিটিকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করে নিজস্ব কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু যে কৌশলী আমরা স্থানীয়ভাবে নির্ধারণ করি তা যেন কমিউনিটি পুলিশিং মূলনীতি বা দর্শনের সাথে সংগতিপূর্ণ হয়। বিষয়টি পুলিশের  মাঠ পর্যায়ের তদারককারী অফিসার থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের অফিসারদের সর্বদাই মনে রাখতে হবে। বলাবাহুল্য এ বিষয়ে এ ব্লগে আমার বেশ কিছু পোস্ট রয়েছে। আগ্রহী পাঠক ও পুলিশ অফিসারগণ তা পড়ে নিতে পারেন।লিংকে ক্লিক করুন।