রুশ সিরিয়াল কিলার চিকাটিলোর অপরাধ জগৎ(২য় পর্ব-খুনের নৃশংসতা))

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 17 Dec 2014, 05:24 PM
Updated : 17 Dec 2014, 05:24 PM

ধারাবাহিক খুনের প্রথম ঘটনা ও ভয়ংকর ‍উপলব্ধি

রুশ ভূখণ্ডের  এ যাবৎকালের নিকৃষ্টতম খুনি বলে পরিচিত আন্দ্রে চিকাটিলো পরবর্তী সময়ে সর্বমোট ৭০টি খুনের কথা স্বীকার করেছিলেন। তবে চূড়ান্তভাবে তাকে ৫২টি হত্যাকাণ্ড ও পাঁচটি যৌন হয়রানির ঘটনার জন্য বিচার করা হয়। ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত একযুগ চলে চিকাটিলোর খুন ও যৌনবিকৃতির মরণলীলা।

১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর চিকাটিলো শিক্ষকতার সুবাদে রাশিয়ার রোস্টভ-অন-ডন শহরের কাছাকাছি একটি কয়লাখনি সম্মৃদ্ধ শহর শাকতিতে বসবাস শুরু করেন। এ সময় তার যৌন বাসনা পরিতৃপ্ত করার জন্য চিকাটিলো  অন্ধকার ও  নোংরা গালিতে গোপনে একটি পুরাতন বাড়ি ক্রয় করেন। পরবর্তীতে  চিকাটিলো স্বীকার করেছিলেন যে তার পরিবার শাকতিতে এসে পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত তিনি শিশুদের নিয়ে যৌন কল্পনায় অবসর সময় কাটাতেন। কোন বালিকাকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখলে কেমন লাগবে, কেমন হবে সে যৌনসুখানুভূতি — এ ধরনের ভাবনায় চিকাটিলো প্রায় সময় বুঁদ হয়ে থাকতেন।

 ১৯৭৮ সালের ২২ ডিসেম্বর ইয়েলনা জ্যাকোটনোভা নামের একটি নয় বছরের বালিকাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে চিকাটিলো তার গোপন বাড়িতে নিয়ে যান। তিনি মেয়েটিকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। মেয়েটি প্রাণপণে জোরাজুরি করেও নিজেকে সুরক্ষায়  ব্যর্থ হয়। কিন্তু চিকাটিলো নিজেও ছিলেন নপুংসক। শারীরিক চেষ্টায় বালিকাকে পরাস্ত করতে পারলেও তিনি তার আপন পুরুষাঙ্গকে ধর্ষণের জন্য উপযোগী করে তুলতে পারলেন না। তার পুরুষাঙ্গ বরাবরের মতোই থেকে গেল অনুত্থিত।

 জোরাজুরির এক পর্যায়ে চিকাটিলো জ্যাকোটনোভাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করতে থাকেন। তিনি তার গলাটিপে ধরেন ও তলপেটে তিন তিনটি ছুরিকাঘাত করেন। জোরাজুরি, মারামারি ও ছুরিকাহতকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যেই চিকাটিলো বালিকার শরীরের উপর বীর্জপাত ঘটান। হত্যার পর জ্যাকোটনোভার রক্তাক্ত দেহটি চিকাটিলো পাশের নদীতে ছুড়ে ফেলেন। হত্যাকাণ্ডের দুই দিন পর বালিকার লাশ ভেসে ওঠে চিকাটিলোর গোপন বাসার সামান্য দূরে।

 জ্যাকোটনোভা  হত্যাকাণ্ডটি চিকাটিলোর অপরাধ জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ইতোপূর্বে তার অপরাধ নাবালিকাদের যৌনহয়রানির মধ্যে সীমিত ছিল। যৌন হয়রানির কিংবা যৌনক্রিয়ার কোন এক সময় তার অজান্তেই তার বীর্জপাত ঘটত। এবার চিকাটিলো লক্ষ করলেন, তিনি সহিংসার মাধ্যমে তার পুরুষাঙ্গকে যৌনসুখের জন্য উত্থিত রাখতে সক্ষম হন। ভিকটিমকে আহত করা, তাদের একটার পর একটা ছুরিকাঘাত করা এবং তাদের মৃতদেহ বিকৃত করার মধ্য দিয়ে তার যৌনক্রিয়ার সর্বাধিক সুখ লাভ ঘটে। পরবর্তীতে অন্যান্য খুনের মাধ্যমেও বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত হয়েছিলেন তিনি। এরপর থেকে যৌন তাড়নার দীর্ঘস্থায়ী সুখভোগের জন্য চিকাটিলো নাবালিকাদের হত্যা করে তাদের দেহ বিকৃত করার তীব্র আকর্ষণবোধ করতেন। অনেকক্ষেত্রে তিনি এ তাড়না নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হত।

প্রথম খুনের ঘটনায় অন্যজনের ফাঁসি

ঘটনার এক যুগ পর চিকাটিলোর স্বীকার করা প্রথম হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে পুলিশের তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত। কেননা এ হত্যাকাণ্ডের জন্য একজন মজুর শ্রেণির নিরীহ  মানুষকে শুধু অভিযুক্তই  করা হয়নি, তাকে শেষ পর্যন্ত ফাঁসিতেও ঝুলান হয়েছিল।  এ হত্যাকাণ্ড প্রথম দিকে চিকাটিলোকে সন্দেহ করা হয়েছিল। চিকাটিলোর ক্রয় করা গোপন বাসাটির কাছে রক্তের দাগ পাওয়া গিয়েছিল। যদিও চিকাটিলো তার সে গোপন বাসায় বসবাস করতেন না, প্রতিবেশীদের ভাষ্যমতে, খুনের দিন তাকে সে বাসায় দেখা গিয়েছিল। জ্যাকোটনোভার ব্যাগ এমন স্থানে পাওয়া গিয়েছিল, যাতে ধারণা করা সম্ভব ছিল যে তার মৃতদেহ চিকাটিলোর বাসার কাছাকাছি কোন এক স্থান থেকেই নদীতে ছুঁড়ে মারা হয়েছিল। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী চিকাটিলোর মতো বর্ণনার এক ব্যক্তিকে ঘটনার দিন ভিকটিম জ্যাকোটনোভার সাথে বাসস্ট্যান্ডে কথা বলতেও দেখেছিলেন মর্মে পুলিশের কাছে জবানবন্দী দিয়েছিলেন।

 কিন্তু তারপরও পুলিশ আলেকজান্ডার ক্রাভচিনকো নামে এক দিনমজুরকে এ ঘটনার জন্য প্রবলভাবে সন্দেহ করতে থাকে। ক্র্যাভচিনকো ঘটনার দিন সারাক্ষণ তার পরিবারের সাথে সময় কাটিয়েছিল। কিন্তু পুলিশের তদন্তে ক্রাভচিনকোর  পোশাকে রক্তের দাগ পাওয়া যায় যার গ্রুপ ভিকটিমের রক্তের গ্রুপের সাথে মিলে গিয়েছিল। তবে সেই সাথে এটাও সঠিক ছিল যে ক্রাভচিনকোর স্ত্রীর রক্তের গ্রুপও ভিকটিমের গ্রুপের অনুরূপ ছিল। এ রক্তের গ্রুপের সাথে সাদৃশ্য করার মতো তৎকালীন অর্ধসত্য বিজ্ঞানই পুলিশকে ক্রাভচিনকোকে একমাত্র হত্যাকারি বলে সন্দেহ করতে উৎসাহ যুগিয়েছিল।

পুলিশের নির্যাতন ও ভয়ের মুখে ক্রাভচিনকোর স্ত্রী মিথ্যা জবানবন্দী দিতে বাধ্য হয়। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে জবানবন্দী দেন যে ঘটনার দিন তার স্বামী দিনভর বাসার বাইরে ছিলেন। ক্রাভচিনকো আদালতে মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিয়ে পুলিশের নির্যাতন থেকে বাঁচার চেষ্টা করে।  কিন্তু আদালত এ মিথ্যা স্বীকারোক্তির ভিত্তিতেই ১৯৭৯ সালে ক্রাভচিনকোকে  ১৫ বছরের সাজা দেয়। এ সাজা সেই সময়ের জন্য ছিল সর্বোচ্চ। কিন্তু জঘন্য এই হত্যাকাণ্ডের সাজার পরিমাণ জ্যাকোটনোভার আত্মীয় স্বজনদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। আন্দোলন ও চাপের মুখে ক্রাভচিনকোকে দ্বিতীয়বার বিচারের সম্মুখিন করা হয় যার অবশ্যম্ভাবী রায় ছিল মৃত্যুদণ্ড।

কিন্তু  এক যুগ পর চিকাটিলো যখন গ্রেফতার হয়ে তার অর্ধ শতাধিক খুনের বিবরণ দেয়া শুরু করেন, তখন তার স্বীকারোক্তির সর্বপ্রথমেই ছিল এই হত্যাকাণ্ডটি। চিকাটিলোর বিচারের পর জ্যাকোটনোভাকে ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে গ্রেফতার, বিচার ও ফাঁসিতে ঝোলানো আলেকজান্ডার ক্রাফচিনকোকে মরণোত্তর নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পুলিশের ভুল তদন্ত ও বিচারের হেঁয়ালীর মারপ্যাঁচে রাষ্ট্র ইতোমধ্যে যে জীবন হরণ করেছিল, তা ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব ছিল না। পৃথিবীর ইতিহাসের বিচার প্রক্রিয়ার কুহেলিকায় ইয়েলনা জ্যাকোটনোভার হত্যাকাণ্ডের তদন্ত, বিচার ও নির্দোষ ক্র্যাভচিনকোর মৃত্যুদণ্ড একটি দুঃখজনক উদারহণ হিসেবে রয়ে গেছে।

 দ্বিতীয় খুন, অধিকতর নৃশংসতা

১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে প্রথম খুন করার প্রায়  আড়াই বছর পরে ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চিকাটিলো দ্বিতীয় খুনটি করেন। এবার তার ভিকটিম ছিল রোস্টভ শহরের একটি বোর্ডিং স্কুলের ১৭ বছর বয়সী ছাত্রী লারিসা থাচেনকো। রোস্টভ সিটি সেন্টারের পাবরিক লাইব্রেরির বাস স্ট্যান্ডে চিকোটিলে  থাচেনকোর দেখা পায়। এখানে তাকে ভোডকা খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে কৌশলে তাকে নিকটবর্তী ডন নদীর তীরে নির্জন জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে তার সাথে যৌন মিলনের চেষ্টা চালান। থাচেনকোর বাধা সত্ত্বেও তার সাথে যৌন মিলনের চেষ্টা চালাতে গিয়ে চিকাটিলোর পূর্ববত অবস্থা হয়। সে বরাবরের মতো পুরুষাঙ্গ উত্থানে ব্যর্থ হয়।  প্রথম খুনের পর পুরুষাঙ্গ উত্থানের অভিজ্ঞতা অনুসারে এখন চিকাটিলোর কাছে থাচেনকোকে হত্যার মাধ্যমে যৌনসুভ উপভোগের অপশনটিই মূর্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু এবার চিকাটিলোর সাথে কোন ছুরি ছিল না। তাই তাকে অন্যভাবে হত্যার কাজটি সারতে হয়। তিনি ভিকটিমের মুখে কাদা ও মটির ঢিলা প্রবেশ করিয়ে তার চিৎকার করার শক্তি বন্ধ করে দেন। এর পর ঘাড় মটকিয়ে ও থেতলাথেতলি করে চিকাটিলো থাচেনকোর মৃত্যু নিশ্চিত করে। চাকুর অনুপস্থিতিতে চিকাটিলো কাঠ-খড়ি ও নিজের দাঁত দিয়ে ভিকটিমের মৃতদেহকে ছিন্নভিন্ন করে। দাঁত দিয়ে ভিকটিমের একটি স্তনবৃন্দ তিনি ছিঁড়ে ফেলে চিবুতে থাকেন।

 তৃতীয় খুন ও খুনের তাড়নার অপ্রতিরোদ্ধতা

থাচেনকো হত্যার নয় মাসের মাথায় চিকাটিলো ১৯৮১ সালের জুলাই মাসে  তার তৃতীয় খুনটি করেন। এবারের হত্যাকাণ্ডটি ছিল নানা দিক দিয়ে শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্যের । এটা ছিল তার বাস ভবন থেকে বেশ দূরে বাঘায়েভস্কি জেলায়। এখানে তিনি শব্জি কেনার জন্য গিয়েছিলেন। ডোনস্কোই গ্রামে বাস বদল করে চিকাটিলো কিছুদূর হেঁটে চলা শুরু করেন। এ সময় বাস স্ট্যান্ডের কাছেই তিনি ১৩ বছর বয়সী লিইউবভ বিরাইউক নামের এক বালিকাকে তারই মতো হাঁটতে দেখেন। মেয়েটি তার বাসা থেকে দোকানে সওদা করার জন্য বেরিয়েছিল। মেয়েটির সাথে কিছু দূর হাঁটতে হাঁটতে এক ঝোঁপের আড়ালে এসে চিকাটিলো অতর্কিতে তার উপর হামলা চালান। এর পর তাকে নিকটবর্তী বনে নিয়ে গিয়ে তার তাকে বিবস্ত্র করে তাকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নিহত করে। প্রায় পক্ষকাল পরে তার মৃত দেহ উদ্ধার হলে তার চোখ, মুখ, মাথা ও যৌন এলাকায় মোট ২২টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়।

 তৃতীয় খুনের পর চিকাটিলোর খুনের নেশা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। সে ১৯৮২ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সর্বমোট পাঁচজনকে হত্যা করে যাদের বয়স নয় থেকে ১৯ বছরের মধ্যে ছিল। ক্রমশ চিকাটিলোর খুনের একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্যাটার্ন তৈরি হয়। সে সাধারণ ভাবে নিঃসঙ্গ শিশু, বাড়ি থেকে পালানো বালক-বালিকা,  তরুণ ভবঘুরে ব্যক্তিদের বাসস্ট্যান্ড, বা রেলওয়ে স্টেশনের কাছে গিয়ে নানাভাবে ভুলিয়ে তাদের  চিকাটিলোর সাথে নিকটবর্তী বন বা নির্জন স্থানে যাবার জন্য রাজি করাত। এরপর তাদের ছুরিকাঘাতে হত্যা করে তাদের দেহগুলোর উপর উন্মত্যতা প্রদর্শন করত। সে ভিকটিমের শরীরের সামনের অংশ বিশেষ করে মুখ, মাথা ও চোখের স্থানে একের পর এক ছুরির আঘাত করতে থাকত। এর পর অনেক সময় তাদের ঘাড় মটকে হত্যা নিশ্চিত করত। মৃত্যু নিশ্চিত হলে সে মৃত দেহের পেটের নাড়িভুড়ি বের করে ফেলত। মেয়েদের যৌনাঙ্গ এলাকা কেটে, ছিদ্র করে যাবতীয় নরম অংশ বাইরে বের করে ফেলত। ছেলে শিশুদের পুরুষাঙ্গ কর্তন করত। অনেক সময় মেয়েদের জঠর কিংবা ছেলে শিশুদের কর্তিত পুরুষাঙ্গ চাবিয়ে খেত।

প্রথম দিকে চিকাটিলোর শিকারদের মধ্যে নাবালিকা মেয়েরাই ছিল। কিন্তু ক্রমশ তা নাবালকদের দিকে সম্প্রসারিত হয়। তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে সর্বমোট ৫৬ জন ভিকটিমের নাম উঠে আসলেও তার বিরুদ্ধে ৫৩ জনকে হত্যার অপরাধ প্রমাণিত হয়। এ ৫৩ জনের মধ্যে ছিল ৩১ জন বালিকা কিংবা মহিলা এবং ২২ জন ছিল বাালক। (অসমাপ্ত)