মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ ও এক বাঙালি মেজরের অভিশপ্ত মৃত্যু

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 22 Feb 2015, 07:40 AM
Updated : 22 Feb 2015, 07:40 AM

পড়ে শেষ করলাম মেজর জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ বীর উত্তম এর লেখা মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ ২৩৬ পৃষ্ঠার এ বইটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন সিদ্দিকুর রহমান। বাংলা অনুবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়কের লেখা মূল বইটি আমার হাতে এখনও আসেনি। হয়তো অনুবাদের চেয়ে মূল বইটি আরো বেশি প্রাণবন্ত হবে।

মেজর কেএম সফিউল্লাহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের অন্যতম কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন। তার ব্যাটালিয়ান ছিল জয়দেবপুরে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সপ্তাহেই তিনি তার ব্যাটালিয়নের কয়েকটি কোম্পানি নিয়ে টাঙ্গাইল হয়ে ময়মনসিংহ পৌঁছেন। সেখান থেকে ঢাকা আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু মেজর খালেদ মোশারফের অনুরোধ ঢাকা আক্রমণের পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে ভৈরব বাজার এলাকায় চলে যান। সেখান থেকে চলে যান তেলিয়াপাড়া। তার পর ভারতে।

বইটিতে লেখক শুধু তার ব্যাটালিন, সেক্টর বা ডিভিশনই নয়, গোটা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে লিখেছেন। বইটি পড়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের বিদ্রোহ এবং সাথে সাথে কতিপয় উচ্চ পদস্থ বাঙালি অফিসারদের সিদ্ধান্তহীনতার চকপ্রদ কাহিনী জানা গেল।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি রেজিমেনেন্টগুলোতে বেশ কয়েকজন লে.কর্নেল পদের অফিসার ছিলেন কমান্ডের দায়িত্বে। কিন্তু এদের কাউকেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাইনি। দেশের ভিতরে যারা ছিলেন, তারা তাদের পাক আনুগত্য ও অদূরদর্শীতায় শুধু যে মুক্তিযুদ্ধ করা থেকে বঞ্জিত হয়েছেন তাই নয়, তারা নিজেদের জীবন পর্যন্ত খুইয়েছেন। কেউ কেউ পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী হয়ে নিহত হয়েছেন। কেউ কেউ আবার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তো যোগ দেনই, বরং মুক্তিযুদ্ধের জন্য অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।

প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের সাধারণ সৈনিকগণ যখন মুক্তির নেশা ও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পাকিস্তানিদের সাথে রীতিমত যুদ্ধ করছেন, তরুণ অফিসাগণ যখন সৈনিকদের সাথে যোগ দিয়ে নেতৃত্বের শূন্যতায় ভুগছেন, তখন এর  কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল রেজাউল জলিল রীতিমত সিদ্ধান্তহীনতার ভুগছেন।  তিনি এক পর্যায়ে পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী হয়ে প্রাণ হারান।

দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের বাঙালি কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল রকিব প্রতিশ্রুতি দিয়েও তার ব্যাটালিয়নের বিদ্রোহী কোম্পানিগুলোর সাথে যোগ দেননি। পরবর্তীতে শোনা গিয়েছিল তিনি আসলে পাক বাহিনীর স্বার্থই সিদ্ধ করছিলেন।

সবচেয়ে দুভার্গ জনক মৃত্যু হয়েছিল তৃতীয় বেঙ্গলের কোম্পানি কমান্ডার মেজর নিজামুদ্দিনের। তার ব্যাটালিয়ন ছিল সৈয়দপুরে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলোকে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া হিসেবে এর কোম্পানিগুলোকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এমনি এক সময় মার্চের শেষ দিকে মেজর নিজামুদ্দিন ঘোড়াঘাট এলাকায় দুইটি কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন। ২৬ মার্চের পরে তার কোম্পানির অফিসার ও সৈন্যগণ মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন না। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ধারণাকে মেনেই নিতে পারেননি। ফুলবাড়িতে তার অধীন সৈন্যরা তাকে এক প্রকার বন্দী করেই রেখেছিলেন।  তিনি বাঙালি সৈন্যদের কাছ থেকে পালিয়ে পাকিস্তান শিবিরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। প্রথম চেষ্টার পর সৈনিকগণ তাকে কঠিন পর্যবেক্ষণে রাখেন। কিন্তু তার কোম্পানিগুলো যখন হিলি সীমান্তের দিকে যাত্রা শুরু করে তখন কমান্ডার মেজর নিজামুদ্দিন দ্বিতীয়বারের মতো পালিয়ে  পাকিস্তান শিবিরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এবার তার অধীন সৈন্যগণ বুঝতে পারলেন, তাদের কমান্ডার আসলে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধী এক পাকিস্তান-প্রেমিক বাঙালি। তাই তাকে আর পর্যবেক্ষণ বা গ্রেফতারে না রেখে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সৈনিকরা তাকে ঘটনাস্থলেই হত্যা করে।

কী আশ্চর্য! একই ব্যাটালিয়নের অন্য এক তরুণ বাঙালি অফিসার মেজর নিজামুদ্দিনের ঠিক উল্টো আচরণ করেন। তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন আশরাফকে ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর ওয়াহিদ আখতার সৈয়দপুর থেকে ঠাকুরগাঁতে পাঠান সেখানকার বিদ্রোহী ইপিআর সদস্যদের সায়েস্তা করতে। ক্যাপ্টেন আশরাফ সামান্য কিছু সৈন্য নিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে যান। কিন্তু বিদ্রোহী ইপিআর সদস্যদের তিনি দমন না করে তাদের সাথে যোগ দিতে মনস্থির করেন। তার এ মনোভাবে বিদ্রোহী ইপিআর সৈনিকগণ অনেকটাই সন্দেহ পোষণ করেন। তারা ক্যাপ্টেন আশরাফকে প্রস্তাব দেন, তিনি যদি সৈয়দপুরে গিয়ে তার গোটা কোম্পানি নিয়ে তাদের সাথে যোগ দেন তাহলে তারা তার সদিচ্ছার মূল্যায়ন করবেন।

ক্যাপ্টেন আশরাফ সৈয়দপুর ক্যান্টমেন্টে  ফিরে এসে তার পাকিস্তানি সেকেন্ড-ইন কমান্ডকে বোঝাতে সক্ষম হন যে তাকে পুরো কোম্পানি সাথে দিলে তিনি ঠাকুরগাঁয়ে পুনরায় গিয়ে বিদ্রোহীদের সায়েস্তা করতে পারবেন। এরপর তিনি ঠাকুরগাঁ গিয়ে পুরো কোম্পানিসহ ইপিআর সদস্যদের সাথে যোগ দিয়ে তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন।

কী আশ্চর্য মানসিকতা মানুষের! যেখানে মুক্তিপাগল বাঙালি সেনা অফিসার ও সৈনিকগণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানিদের হাত থেকে পালিয়ে এবং কেউ কেউ পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন, সেখানে অনেক সিনিয়র বাঙালি সেনা অফিসার মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দিয়ে পাক বাহিনীর সহায়তা শুরু করেন।
এসব উদাহরণ থেকে আরও একটি বিষয় পরিষ্কার হয় যে সিনিয়র কর্মকর্তাগণ সরকারের অপেক্ষাকৃত বেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন, তেমনি তাদের পিছুটানও বেশি। তবে সবচেয়ে দুর্ভাগা ঐসব সেনা সদস্য যারা সুযোগ ও চাপ থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি এবং এজন্য পাকিস্তানিদের হাতে নয়, তাদের বাঙালি ভাইদের হাতেই নিহত হয়েছেন।