পানিতে ডুবে মরার আষাঢ়ে পরিসংখ্যান ও একটি রেডিও বিজ্ঞাপন

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 11 March 2015, 08:20 AM
Updated : 11 March 2015, 08:20 AM

এক সময় রেডিও শোনা আমার নেশার মতো ছিল। আমাদের গ্রামের সর্বপ্রথম রেডিওটি কিনেছিলেন আমার মরহুম বড় ভাই আবু তালেব। সেই সময় মুরব্বীগণ রেডিওকে 'মিছা কথার বাক্স' বলতেন। তবে সেটা বর্তমান কালের সরকারি ভাষ্যের অতিরঞ্জনের জন্য নয়, অতি সারল্য দোষে দুষ্ট গ্রামবাসিদের কুপমণ্ডুকতার জন্যই। কারণ তৎকালে গ্রামের রোদেলা আবহাওয়ার বাইরেও দেশের অন্য কোথাও যে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে, এমন কথা অনেক মুরব্বীই বিশ্বাস করতেন না।

আমি রেডিও শুনতাম বড় ভাবীর কাছে বসে থেকে। যতক্ষণ রেডিওতে গান হত, ততোক্ষণ রেডিওর কাছে বসে থাকতাম। আমার রেডিও শোনা বন্ধ হতো, হয় রেডিও সেন্টারের সম্প্রচার সেই দিনের বা সেই সময়ের জন্য মুলতবি করা কিংবা আমি ঘুমিয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে। বাল্যকালে রেডিওর পোকা থাকলেও বর্তমানে  রেডিও শোনা হয়না বললেই চলে। তবে মাঝে মাঝে ক্রিকেট খেলা শোনার জন্য রেডিওতে কান রাখি।

বর্তমানে চলছে ক্রিকেটের বিশ্বকাপ। আমার গাড়ির রেডিওতে তাই খেলার ধারা বিবরণী প্রচারিত হলে যতক্ষণ গাড়িতে থাকি ততোক্ষণ কানটা রেডিওতেই রাখি। কিন্তু ধারা বিবরণীর মাঝে মাঝে যে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছিল, সে বিজ্ঞাপনের একটি ছিল বাচ্চাদের সাঁতার শেখানোর উপদেশ। আমাদের বাড়ির আশেপাশের ডোবানালা, খালবিলে পড়ে বাচ্চারা যাতে অকালে প্রাণ না হারায় তার জন্য বিজ্ঞাপনে সবােইকে সচেতন থাকার সাথে সাথে বাচ্চাকাচ্চাদের সাঁতার শেখানোর তাগিদ দেয়া হচ্ছিল।

অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য এ ধরনের সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন খুবই দরকারি ও কার্যকরী বলে আমি মনে করি। কিন্তু আমার একটি বিষয়ে খটকা লাগল ও বিরক্তিও উৎপাদিত হল বিজ্ঞাপনটিতে বাংলাদেশে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার বাৎসরিক মোট অপমৃত্যুর সংখ্যাটি নিয়ে। বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছিল, প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ২০ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। আর প্রতিদিনের হিসেবে এ সংখ্যাটি হল ৫০ জন।

খটকাটা অবশ্য অনেক আগের। ২০১৪ সালের ১২ নভেম্বর বিডিনিউজ২৪.কম ব্লগের প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় ব্লগার ও সাংবাদিক জাহেদ উর রহমানের লেখা, 'বছরে ২০ হাজার শিশুর লাশের ওপর গড়ে উঠুক 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' শিরোনামের নিবন্ধটি পড়ে আমি সেই সময়ই প্রশ্ন তুলেছিলাম। কিন্তু লেখক তার তথ্যের সপক্ষে যে যুক্তি-তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরেছিলেন তাতে তার লেখাকে অবিশ্বাস কিংবা চ্যালেঞ্জ করার কিছু ছিল না।

২০০৫ সালে জাতিসংঘ শিশু তহবিল(ইউনিসেফ) থেকে প্রকাশিত, Bangladesh Health and Injury Survey Report on Children'  এ বলা হয়েছে,

Drowning is the leading cause of death in children aged one year and over in Bangladesh. Based on the rate reported in the BHIS, in the year preceding the survey, almost 17,000 children drowned or about 46 per day.

A recent study estimated that at least 50 children drown every day in the country – more than 18,000 a year.

বিবিসির খবরে আবার ডুবে মরা সম্পর্কে  আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান International Drowning Research Centre এর  গবেষক Dr A K M Fazlur Rahman এর উদ্ধৃতিও দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ইউনিসেফের যে প্রতিবেদন তা বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগেই বের হয়েছিল। তাই এটাকে বাংলাদেশ সরকারের ভাষ্য  না হলেও এক ধরনের অনুমোদন বলে ধরে নেয়া যায়।

কিন্তু সরকারি ভাষ্য হোক, আর বেসরকারি গবেষণাই হোক, অপমৃত্যুর সাথে পুলিশের সম্পর্কটিকে কোন ভাবেই অস্বীকার করা যায় না। প্রতিষ্ঠার আদি থেকেই বাংলাদেশ পুলিশ অন্যান্য ফৌজদারি বিষয়/অপরাধের পরিসংখ্যানের পাশাপাশি অপমৃত্যুর পরিসংখ্যানও সংগ্রহ করে। এজন্য বাংলাদেশ পুলিশের থানা তৃণমূল পর্যায়ের সংগ্রহ ও সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান হলেও জেলা, রেঞ্জ/বিভাগ ও পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স পর্যন্ত অপরাধ/অপমৃত্যুর পরিসংখ্যান সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণ করা হয়। তাই যে কোন অপমৃত্যু তা আত্মহত্যা, পানিতে ডোবা কিংবা উপর থেকে পড়ে যাওয়ার ঘটনা হোক পুলিশের রেজিস্ট্রারে তা লিপিবদ্ধ থাকবেই।

গত নভেম্বর/১৪ মাসেই ব্লগার জাহেদের লেখার উপর আমি মন্তব্য করি। জাহেদের প্রতি উত্তরে আমি পুলিশের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করি। কিন্তু পুলিশের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে প্রতি বছর পানিতে ডুবে ২০ হাজার শিশু/মানুষের অপমৃত্যু ঘটার ইউনিসেফ ও বিবিসির পরিসংখ্যানটি আমার কাছে শুধু ভ্রান্তই নয়, বালখিল্যপনার উৎকৃষ্ট উদাহরণ বলে মনে হয়েছে।

২০১১-২০১৪ পর্যন্ত পুলিশের খাতায় রুজুকৃত পানিতে ডুবে অপমৃত্যুর বাৎসরিক সংখ্যাটি নিম্নরূপ

বছর                      পানিতে ডুবে অপমৃত্যুর মামলার মোট সংখ্যা

২০১১                                  ৭১১

২০১২                                   ৫৮৪

২০১৩                                  ৬৭৪

২০১৪                                  ৭১২

২০১৩ সালে পুলিশের খাতায় মোট ১৬,৩২৫টি অপমৃত্যুর মামলা রুজু হয়েছিল। তার মধ্যে পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল মাত্র ৬৭৪টি। এ সংখ্যায় কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে। যেমন একই ঘটনায় ১০ জন ব্যক্তি মারা গেলে লাশের সুরুতহাল পৃথক পৃথক হবে। কিন্তু মামলা হবে একটিই। অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রেও বিষয়টি তেমন হতে পারে।

সব অপরাধের খবর পুলিশের কাছে আসে না। তবে হত্যা ও অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনাগুলো সাধারণত গোপন থাকে না। সেক্ষেত্রে ঘটনা ঘটলে তা পুলিশের কাছে না আসার হারও কম। যেমন পুলিশের খাতায় যে চুরির মামলার পরিসংখ্যান থাকে বাস্তবে তার চেয়ে ৪ গুণ বেশি চুরির ঘটনা ঘটতে পারে। এটা সব দেশেেই হয়। হয়তো আমাদের দেশে একটু বেশি। এখন আমি যদি ধরে নেই সারা বছর পানিতে ডুবে মরার ঘটনাগুলোতে যতজন মারা যায় তার চেয়ে কম মামলা থানায় রুজু হয়। সেটা বলা যায়। কিন্তু ৬৭৩ সংখ্যাটিকে কোন ভাবেই ১৮/২০ হাজারে উন্নীত করা যাবে না। এটা অসম্ভব! বাংলাদেশে বর্তমানে এমন কোন দুর্গম এলাকা নেই যে যেখান থেকে থানা পুলিশের নজর থেকে ১৮/১৯ হাজার লাশ গোপন করা যাবে।
এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে সরকারি সূত্রে লিপিবদ্ধ অপরাধের ঘটনাগুলোর বাইরেও সমাজে অনেক বেশি অপরাধ সংঘটিত হয়। কিন্তু তাই বলে দেশের একটি প্রতিষ্ঠিত ও আধুনিক পুলিশ বাহিনীর দুই শত বছর থেকে চলে আসা অপরাধ পরিসংখ্যানটিকে উপেক্ষা করা যাবে। কিন্তু ইউনিসেফের ২০০৫ সালের Bangladesh Health and Injury Survey Report on Children' প্রতিবেদনে পুলিশ পরিসংখ্যানকে সম্পূর্ণরূপে বাদ দেয়া হয়েছে। পুলিশের খাতায় সংগ্রহিত ও সুনির্দিষ্ট অপমৃত্যুর মামলার বিপরীতে যে পানিতে ডুবে মরার সংখ্যা দেয়া হয়েছে তা  রেকর্ডকৃত সংখ্যার চেয়ে ২৫গুণ বেশি। তিন, চার, পাঁচ এমনকি দশগুণ বেশি সংখ্যাকে মেনে নেয়া যায়। কিন্তু সরকারের স্বীকৃত পদ্ধতির মাধ্যমে সংগ্রহিত সংখ্যার ২৫গুণ কোন সংখ্যাকে আজগুবি বলা ছাড়া উপায় নেই। আমি মনে করি, ইউনিসেফের সেই প্রতিবেদন, বিবিসির সেই খবরকে অবশ্যই চ্যালেঞ্জ করা উচিৎ। একই সাথে এসব ভ্রান্ত তথ্যের পরিবেশনায় যে বিজ্ঞাপন সেগুলোও বন্ধ করে দেয়া উচিৎ।

সূত্রাবলীঃ

১. বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা