অপরাধ, উন্নয়ন ও অপরাধ বিষয়ক প্রতিবেদন

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 6 June 2015, 05:28 AM
Updated : 6 June 2015, 05:28 AM

দেশের কয়েকটি পত্রিকায় সাম্প্রতিককালে অপরাধ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে মর্মে খবর প্রকাশিত হয়েছে। কোন কোন পত্রিকায় গত কয়েক বছরের অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে হত্যা, অপহরণ, ডাকাতি, দস্যুতা ইত্যাদি খাতে মামলা বা অপরাধ বৃদ্ধির বিষয়ে মতামত দেয়া হচ্ছে। অপরাধ বিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে পর্যালোচনা করে দেখেছি, এসব প্রতিবেদন আসলে অস্বচ্ছ চিন্তা ও অপরাধ বিষয়ক জ্ঞানের স্থুলতার প্রতিফলন। প্রতিবেদকগণ পূর্বসংস্কারজাত চিন্তার মাধ্যমে কেবল পাঠকের মনে ভীতি সঞ্চারের প্রয়াসই পেয়েছেন। তারা যদি অপরাধ বিজ্ঞানের মানদণ্ডে অপরাধ পরিসংখ্যানকে বিবেচনা করতেন বা করতে পারতেন, তাহলে তাদের প্রতিবেদনগুলো হয়তো অন্য রকম বা অন্য কোন শিরোনাম সম্পন্ন হত।

গত ২৬ জুন ২০১৪ তারিখে দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ছিল '১৬৯ দিনে খুন ১,৭৫৬'। খবরটিতে খুনের ঘটনাগুলোকে বেশি করে দেখানোর একটি প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। কেননা লেখক বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বিষয়টি একেবারেই আমলে নেননি। তাছাড়া, আধুনিক রাষ্ট্রেগুলোর অপরাধ পরিস্থিতি বা পরিসংখ্যানও তার পর্যালোচনায় আসেনি। তিনি মন্তব্য করেছেন, পুলিশের অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার আমলে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকারি সংস্থাগুলো ব্যর্থ হয়েছে। ২০০৮ সালে সারা দেশে খুনের ঘটনা ঘটেছিল ৪ হাজার ৯৯টি। অন্যদিকে ২০১৩ সালে ৪ হাজার ৩৯৩ জন খুন হয়।' প্রতিবেদক অপরাধ পরিসংখ্যানটি সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারলেও এর বিশ্লেষণ সঠিকভাবে করতে পারেন নি। তিনি মনে করেছিলেন, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ২০১৩ সালেও অপরাধ পরিসংখ্যান ২০০৮ সালের অনুরূপ হতে হবে।

বাংলাদেশের অপরাধ পরিসংখ্যানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, ইংরেজি মাসের শুরুতে দেশে অপরাধ কম সংঘটিত হয়। এর পর বছরের প্রথম তিন মাসের চেয়ে পরের তিন মাস এবং তার পরের তিন মাসের অপরাধ সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পায়। এর পর বছরের শেষের দিকে আবার অপরাধ কমে আসে। সে তুলনায় সাধারণত এপ্রিল মাসের চেয়ে মে মাসে অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তবে খুনের ঘটনার ক্ষেত্রে বিষয়টি তেমনটি হয় না। আমরা যদি ২০০৯ সালের সাথে তুলনা করি তাহলে দেখব ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে হত্যা মামলা ছিল ৪০৪টি। মে মাসে তা ছিল ৪০৩টি। আর ২০১৪ সালের হিসেব করলে দেখব, এপ্রিলে এ সংখ্যা ছিল ৪০১ এবং মে মাসে তার সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৭০টি। অর্থাৎ ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১৪ সালের এপ্রিল মে মাসে খুনের ঘটনা কম ঘটেছে।

অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করতে হলে দেশের ভৌগোলিক, জনসংখ্যাগত, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পর্যালোচনা করা একান্ত প্রয়োজন। ভৌগোলিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ ভারত দ্বারা পরিবেষ্ঠিত। আর ভারতের সাথে আমাদের সাংস্কৃতিক সাদৃশ্যও রয়েছে। আমাদের দেশের তিন দিকে অবস্থিত ভারত এখনও একটি অপরাধ কবলিত রাষ্ট্র। শুধু হত্যা নয়, ধর্ষণ থেকে শুরু করে সংঘবদ্ধ অপরাধেও ভারত সারা বিশ্বে প্রথম সারিতে অবস্থান করে। বাংলাদেশে কৃত অনেক অপরাধের মূল ভারত কিংবা আমাদের প্রতিবেশি মায়ানমারে। অবৈধ অস্ত্র, মাদক এমন কি চাঁদাবাজির অনেক ঘটনার উৎস ভারত কিংবা মায়ানমারে। তাই আমাদের দেশের অপরাধ প্রবণতা ভারতের অপরাধ প্রবণতার অনেকটাই অনুসরণ করবে।

সাংস্কৃতিক, সামাজিক ,অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আমরা এখন একটি উন্নয়নশীল জাতি। অপরাধ বৃদ্ধি উন্নয়ন প্রক্রিয়ার একটি স্বাভাবিক উপজাত। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইউরোপের শিল্প বিপ্লবকালীন সমগ্র ইউরোপে অপরাধের দ্রুত বৃদ্ধির বিষয়টি এখন ইতিহাসের বাস্তবতা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান দ্রুত উন্নয়নের সময় অপরাধ বৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক কোন ঘটনা বলা ইতিহাসকেই অস্বীকার করার সামিল। তবে একই সাথে এও বলা যায়, বাংলাদেশের বাৎসরিক অপরাধ বৃদ্ধির হার তার উন্নয়ন অগ্রগতির সাথে তুলনা করলে খুব বেশি মাথা ব্যথার কারণ নয়; বরং ইউরোপ আমেরিকার তুলনায় অতি সামান্যই।

২০০০ সালে বাংলাদেশের লোকসংখ্যা ছিল ১৩ কোটি ২৩ লাখ। বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ কোটি ৭২ লাখ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে অপরাধ বৃদ্ধি সরাসরি জড়িত। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে জনসংখ্যার ঘনত্বও বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে বর্তমানে জনসংখ্যা ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১,১৮৮ জন[1]। অন্য দিকে ২০০০ সালের তুলনায় ২০১৪ সালের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৮.৭৬%। একই সময়ে যদি অপরাধ চিত্র পর্যালোচনা করি তাহলে দেখব, ২০০১ সালের তুলনায় ২০১৩ সালের হত্যা মামলা বেড়েছে ১৯.৪৩%। আবার ২০০৯ সালকে যদি ভিত্তি ধরা হয়, এ বৃদ্ধির হার হবে মাত্র ৪.১২%। অপরাধ নিয়ে যারা কাজ করেন কিংবা অপরাধ বিষয়ে গবেষণা করেন, তারা এক বাক্যে স্বীকার করবেন জনসংখ্যার ঘনত্ব ও বৃদ্ধির হারের তুলনায় বাংলাদেশের অপরাধ বৃদ্ধির হার অতি নগণ্য। এক কথায়, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের প্রায় সমান হারে হত্যার মামলা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বাস্তবে উন্নয়নশীল দেখে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে অপরাধ বৃদ্ধির হার বেশি হয়ে থাকে।

গত ১৪ বছরের গড় অনুযায়ী বাংলাদেশের থানাগুলোতে প্রতিদিন প্রায় ১০টি করে হত্যা মামলা রুজু হয়েছে। যদি প্রতি বছরের গড় করি তাহলে এই হার সর্ব নিম্ন ২০০৩ সালে ছিল দৈনিক ৯.৫টি ও সর্ব সর্বোচ্চ ২০১৩ সালে দৈনিক ১২ টি। এমনকি বিগত প্রলম্বিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও ২০০৭ সালে এ হার ছিল প্রতিদিন গড়ে ১০.৫টি। আমরা যদি ২০০৭/৮ সালের দেশের সামগ্রিক অবস্থার সাথে ২০১৩ সালের উত্তপ্ত অবস্থাকে তুলনা করি, তাহলে বুঝব, এ ছয় বছরের ব্যবধানে সারা দেশে হত্যা মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি অতি স্বাভাবিক। বাংলাদেশের ইতিহাসে একই বছরে ১৫ জন পুলিশ সদস্য, ৪ জন বিজিবি সদস্যসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ রাজনৈতিক সহিংসতায় হত্যা বা মৃত্যুর ঘটনা আর কোন বছরে ঘটেনি যা ঘটেছে ২০১৩ সালে।

এবার আমরা দেশের বাইরে নজর দিব। এক্ষেত্রে আমরা পৃথিবীর একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধ পরিস্থিতি বিশ্লেষণপূর্বক আমাদের দেশের সাথে তার তুলনা করব। অপরাধ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে আমরা এখন বাংলাদেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুলনা করব। মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রায় ৬৬ গুণ বড়। বাংলাদেশের আয়তন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্যের অন্যতম নিউইয়র্ক রাজের চেয়ে সামান্য বড়। কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি যেখানে নিউইয়র্ক রাজ্যের জনসংখ্যা মাত্র এক কোটি ৯৫ লাখ মাত্র[2]। অর্থাৎ বাংলাদেশের জনসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের একটি রাষ্ট্রের জনসংখ্যার ছেয়ে  ৮ গুণ বেশি।

ইতোপূর্বে আমরা বলেছি, জনসংখ্যার ঘনত্ব অপরাধের আধিক্যের জন্য দায়ি। বাংলাদেশের প্রতি বর্গ কিলোমিটার স্থানে বসবাস করে ১,১৮৮ জন মানুষ। আর মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে মাত্র ৩৪ জন মানুষ। অর্থাৎ শুধু আয়তনেই নয় জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক দিকে বাংলাদেশ যুরাষ্ট্রের চেয়ে ৩৪ গুণ বেশি।[3] (সে অনুপাতে বাংলাদেশে প্রতিদিন যে হারে হত্যা মামলা রুজু হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সে হার হওয়ার কথা অতি নগণ্য। কিন্তু যুক্ত রাষ্ট্রের খোদ এফবিআই এর অপরাধ ঘড়ি অনুসারে সে দেশে প্রতি ৩৪.৫ মিনিটে একটি খুনের ঘটনা ঘটে[4]। অর্থাৎ দেনিক সেদেশে গড়ে প্রায় ৪২টি খুনের ঘটনা ঘটে।( জনসংখ্যার ঘনত্ব বাদ দিয়েও যদি মোট জন সংখ্যার কথা ধরি, তাহলেও বাংলাদেশের তুলনায় সেখানে প্রতি দিন ২২/২৩ টি খুনের ঘটনা ঘটতে পারত। কিন্তু এ সংখ্যা প্রায় বাংলাদেশের তিন গুণেরও বেশি।

সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের অপরাধ পরিস্থিতি সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কেননা সরকার এ বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন। গত পাঁচ বছরে আইন-শৃঙ্খলা ও অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ সরকার তার পুলিশের সক্ষমতা বিভিন্ন মাত্রায় বৃদ্ধি করেছে। এর মধ্যে রয়েছে পুলিশে প্রায় ৩২ হাজার নতুন জনবল নিয়োগ, বেশি কিছু নতুন নতুন পুলিশ ইউনিট তৈরি ও বিদ্যমান ইউনিটগুলোর জনবল বৃদ্ধি। হয়তো বা পুলিশ মানুষের বিপুল প্রত্যাশে পূরণ করার মতো এখনও উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। কিন্তু হাজারো সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দেশের অপরাধ পরিস্থিতির যে স্বাভাবিক অবস্থা তা এক কথায় অতুলনীয়।

[4]https://www2.fbi.gov/ucr/cius2009/about/crime_clock.html).