ব্যাংক ডাকাতিতে জঙ্গি সম্পৃক্ততাঃ নিশ্চিত না হয়ে বাঘ! বাঘ!! চিৎকার বুমেরাং হতে পারে

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 5 May 2015, 08:18 PM
Updated : 5 May 2015, 08:18 PM

গত ২১ এপ্রিল ঢাকা জেলার আসুলিয়া থানা এলাকার কাঠগড়া বাজারে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের একটি শাখায় দিনের বেলা ডাকাতি সংঘটিত হয়। ডাকাতগণ বোমা ফাটিয়ে, গুলি চালিয়ে ও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করে ব্যাংক কর্মকর্তাকর্মচারী ও কিছু গ্রাহককে আহত-নিহত করে। এতে ব্যাংকের ম্যানেজারসহ আট জন নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে একজন ডাকাতও রয়েছে ।[১]

দিনের বেলায় হাজার হাজার মানুষের সামনে এভাবে ত্রাসের রাজত্ব কায়েক করে ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা অবশ্যই চাঞ্চল্যকর। কারণ বাংলাদেশে ব্যাংক ডাকাতির মতো ঘটনা কদাচিৎ ঘটে। যদিও গত শতাব্দীর শেষ প্রান্তেও প্রতি বছর অন্তত অর্ধ ডজন ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ঘটত, কিন্তু ২০০০ সালের পর সেটা দ্রুত কমে আসে। ২০১১, ২০১২ ও ২০১৪ সালে বাংলা দেশে কোন ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি। ২০১৩ সালে একটিমাত্র ঘটনা ঘটেছিল। সে অনুসারে গত ছয় বছরে মাত্র একটি ব্যাংক ডাকাতির মতো ঘটনা ঘটেছিল। তাই আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এভাবে দিনে দুপুরে ডাকাতির ঘটনা সারা দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করাই স্বাভাবিক।

এ ঘটনার আরো একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ। স্থানীয় জনগণ এলাকার মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ডাকাতদের ঘেরাও করে। কিন্তু সশস্ত্র ডাকাতগণ জনগণের উপর যাচ্ছেতাই বল প্রয়োগ করে পালিয়ে যায়। আর পালিয়ে যাওয়ার সময় জনতার হাতে দুই ডাকাত গ্রেফতার হয়, এক জন অকুস্থলেই অক্কা পায়। জনতার হাতে ডাকাত গ্রেফতার হওয়ায় পুলিশের ঘটনাটি তদন্ত করতে দারুণ সুবিধা হয়। ঘটনার দুই দিনের মধ্যেই পুরো রহস্যের জট খুলে যায়।

ডাকাতি একটি চিরায়ত সহিংস অপরাধ। এ অপরাধে অপরাধীরা নয়, বরং অপরাধের শিকার ব্যক্তিগণই ভয়ের মধ্যে থাকে। সহিংস হওয়ার ফলে অপরাধীরা প্রায়সই খোলামেলা থাকে। ভিকটিমগণ কোন না কোনভাবে অপরাধীদের শনাক্ত করতে পারে। তাদের মুখমণ্ডল হয়তো সব সময় উন্মুক্ত থাকে না। কিন্তু তাদের শরীর, চলাফেরা, কথাবার্তা ইত্যাদির মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত ডাকাতদল শনাক্ত হয়। তবে এ সব মামলায় প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ করা ও তার ভিত্তিতে অপরাধীদের সাজা দেয়া প্রায়সই কঠিন হয়ে পড়ে।
আসুলিয়ার কাঠগড়ায় ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাটিতে প্রথম থেকেই সশস্ত্র জঙ্গিদের সম্পৃক্ততার কথা বলা হচ্ছে [২]। বিষয়টি সর্ব প্রথম উল্লেখ করেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি । ঘটনার দিনই তিনি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় এ ঘটনার সাথে জঙ্গিদের সম্পৃক্ততার কথা বলেছিলেন। গ্রেফতারকৃত ডাকাদের বাড়িতে একটি নির্দিষ্ট ইসলামী দলের প্রচারপত্র, বইপুস্তক ইত্যাদি উদ্ধার ও ডাকাতের পূর্বে মাদ্রাসায় পড়ার ইতিহাস পর্যালোচনা করেই তিনি এ সিদ্ধান্তে এসেছিলেন বলে জানা যায় [৩]। এর পর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে  সাংবাদিক সম্মেলনেও এ ঘটনার সাথে জঙ্গি সম্পৃক্তা দাবি করা হয়।
ঘটনার তদন্তে পুলিশের গ্রেফতার ও উদ্ধার অভিযান অব্যহত থাকে। গ্রেফতারকৃত ডাকাতদের পুলিশ হেফাজতে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী আসুলিয়া থানার অফিসার ইন চার্জ মোস্তফা কামাল নিশ্চিত করেছেন যে ২১ এপ্রিলের কাঠগড়ার ব্যাংক ডাকাতদল মূলত আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামের জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। আর ইন্সপেক্টর তদন্ত দীপক চন্দ্র সাহার মতে, এরা তাদের কারাবন্দী নেতা-কর্মীদের জেল থেকে ছাড়ানোর লক্ষে ব্যাপক অর্থ সংগ্রহ করতে চায়। আর অর্থ সংগ্রহের মাধ্যম হিসেবে তারা ব্যাংক ডাকাতি, বড় ধরনের চুরি, ও ছিনতাইয়ের অপরাধকে বেছে নিয়েছে। ইতোপূর্বে সাভার ও আসুলিয়া এলাকায় বড় ধরনের চুরি, ছিনতাই ও বিকাশ-কেন্দ্রের দস্যুতার ঘটনাগুলোও নাকি এ ডাকাতরূপি আনসরুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরাই ঘটিয়েছিল [৪]

সন্ত্রাসী-জঙ্গিদের চিরায়ত অপরাধে জড়িত হওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। একটি আদর্শকে প্রতিষ্ঠার জন্য এরা সম্পূর্ণ বিপরীত আদর্শের কর্মকা- পরিচালনা করতে পারে; একটি সম্পূর্ণ বিপরীত আদর্শের সংগঠন, গোষ্ঠী, জাতি এমনকি দেশের সাথেও তার সখ্য গড়াতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ আফগানিস্তান-পাকিস্তান অঞ্চলের আলকায়েদা নেটওয়ার্কের কথা বলা যায়। আলকায়দা নেটওয়ার্ক প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের জন্য গোল্ডেন ক্রিসেন্ট খ্যাত পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরান অঞ্চলের মাদক চোরাচালানকারীদের সাথে এক অদ্ভূত সখ্য গড়ে তুলেছে বলে জানা যায়। এ অঞ্চলে পপি চাষ, আফিম ও হিরোইন তৈরি এ সবের পাচার প্রভৃতি কাজে আলকায়েদা সশস্ত্র পাহারা দিয়ে থাকে। বিনিময়ে তারা মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থসহ অন্যান্য সহায়তা পেয়ে থাকে। আলকায়েদা নেটওয়ার্ক বর্তমানে ল্যাটিন আমেরিক, ইউরোপ, আফ্রিকাসহ প্রায় সকল মহাদেশেই তাদের অস্ত্র ও মাদক নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছে [৫]

স্পেনের মাদ্রিদের ২০০৪ সালে পরিচালিত বোমা হামলায় স্পেন ও ফ্রান্স সীমান্তের স্বাধীন বাস্কে রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলনরত ইটিএ সন্ত্রাসীদের সাথে আলকায়েদা জঙ্গিগোষ্ঠীর সহযোগিতা ছিল। ইউরোপের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই সন্ত্রাসী হামলায় অমুসলিম ইটিএ গোষ্ঠীর সাথে মুসলিক জঙ্গিগোষ্ঠী আলকায়েদার অদ্ভূত সমঝোতা হয়েছি [৬]। এখানে  আলকায়েদা ও ইটিএ সন্ত্রাসীরা স্থানীয় মাদক চোরাকারবারিদের কাছ থেকে নিষিদ্ধ মাদকের বিনিময়ে প্রয়োজনীয় বিষ্ফোরক সংগ্রহ করেছিল।
আদর্শবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মূল লক্ষ হচ্ছে তাদের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা। অন্যদিকে চিরায়ত সন্ত্রাসী বা অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর মূল লক্ষ হচ্ছে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে আর্থিক মুনাফা সংগ্রহ করা। কিন্তু উভয় গ্রুপ তাদের নিজ নিজ স্বার্থ সিদ্ধির জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সাময়িকভাবে একে অপরের অপারেশন কৌশল গ্রহণ করতে পারে। এভাবে একটি আদর্শিক জঙ্গিগোষ্ঠী অর্থলোভী সাধারণ অপরাধী গোষ্ঠী কিংবা একটি অপরাধী গোষ্ঠীর জঙ্গিগোষ্ঠীতে পরিণত হওয়ার (অন্তত কিছু সময়ের জন্য)অসংখ্য নজির রয়েছে।
বাংলাদেশের সাধারণ অপরাধী ও জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা এখনও দেখা যায়না। এদেশের জঙ্গিরা মূলত বহির্দেশ থেকে তাদের প্রয়োজনীয় অর্থ পেত কিংবা নিজেরাই কিছু অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করত। অর্থ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো সাধারণ মানুষের সমর্থন বা সহযোগিতা পেয়েছে বলে অনুমান করা যায় না। কেননা, জেমবিসহ অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সাধারণ জনসমর্থন খুবই সীমিত। অন্যদিকে সরকারে কঠোর নজরদারী ও জঙ্গিবিরোধী পররাষ্ট্র নীতির ফলে বহির্বিশ্ব থেকে জঙ্গিদের জন্য সাহায্য আসা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই চিরায়ত অপরাধ কর্মের মাধ্যমে সংগঠন টিকিয়ে রাখা ও অপরারেশন পরিচালনার অর্থ সংগ্রহ করার একটি ব্যবস্থা তারা অবলম্বন করতে পারে। আসুলিয়ার ব্যাংক ডাকাতিতে জঙ্গি সম্পৃক্ততা তারই প্রথম বহিঃপ্রকাশ কিনা তা তলিয়ে দেখা অবশ্যই জরুরি।

তবে এ বিষয়ে পুলিশকে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে। কোন প্রকার সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া কিংবা ভাসা ভাসা তদন্তের মাধ্যমে অদূরদর্শীভাবে একটি চিরায়ত অপরাধের সাথে জঙ্গি গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততার সনদ দেয়া পুলিশের জন্য আত্মঘাতী হয়ে দেখা দিতে পারে। এতে সাধারণ মানুষের মাঝে অহেতুক জঙ্গিভীতি প্রবেশ করতে পারে। জঙ্গিরা যেমন এ সুযোগে সাধারণ মানুষকে ভীতিপ্রদর্শন করে তাদের প্রয়োজনীয় অর্থ ভিন্ন ভাবে সংগ্রহ করতে পারে, তেমনি সাধারণ অপরাধী দলগুলো নিজেদের মেকি জঙ্গি পরিচয়ে সাধারণ মানুষকে আরো বেশি ভিতু করে তাদের ডাকাতি-ছিনতাই-দস্যুতামূলক অপরাধের মাত্রা ও সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে পারে। আমাদের দেশে তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে চাঁদা আদায়ের ইতিহাস বহু পুরাতন। কথিত সন্ত্রাসী দেশ ছাড়া। কিন্তু তার নামে অহরহ চাঁদাবাজি হচ্ছে, মানুষ ভয়ে এমনসব গোষ্ঠীকে চাঁদা দিয়ে যাচ্ছে যাদের সাথে কথিত শীর্ষ সন্ত্রাসীর কোন যোগসূত্রই নেই।

প্রকৃত অপরাধের চেয়েও ভয়ংকর হল মানুষের মনের অপরাধ-ভীতি। আমাদের দেশের জনমনে এমনিতেই অপরাধ-ভীতি প্রবল, এর উপর তাদের মধ্যে যদি জঙ্গিদের ডাকাত কিংবা ডাকাতদের জঙ্গি হওয়ার ভয় ঢুকে পড়ে, তাহলে আলোচিত কাঠগড়া ব্যাংক ডাকাতির প্রেক্ষিতে মানুষের মনে যে প্রতিরোধবোধ তৈরি হয়েছিল তা চিরতরেই হারিয়ে যাবে। ভেঙ্গে পড়বে অপরাধ নির্মূলে কমিউনিটির সহযোগিতা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা। এর ফলে আইন মান্যকারী জনগণ নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে আত্মরক্ষার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়বে। জনগণ সমষ্টিগতভাবে অকার্যকর হবে এবং সাথে সাথে অকার্যর হবে পুলিশিং ব্যবস্থাও। তাই সাবধান! প্রকৃত বাঘের অস্তিত্ব নিশ্চিত না হয়ে বাঘ! বাঘ!! বলে চিৎকার দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

সূত্রাবলীঃ

[1] http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/509566

[2]http://www.bbc.co.uk/bengali/news/2015/04/150424_mrk_savar_bank_robbery_militant_arrest

[3]http://www.bd-pratidin.com/first-page/2015/04/25/77069

[4]http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/518392/