সকালে ফোন দিলেন এলাকার এক বড় ভাই। ছোট কালে আমাদের আদর্শ ছিলেন তিনি। আমার একই স্কুলের ছাত্র ছিলেন ।পড়তেন পলিটেকনিক্যাল কলেজে। গান-বাজনা, ছবি আঁকা ও পড়াশোনায় পারদর্শিতা — কোনটি ছিলনা এ বড় ভাইয়ের? বর্তমানে তিনি একটি রিয়াল স্টেট কোম্পানির উচ্চ পদস্থ অফিসার।
গত কাল বড় ভাইয়ের জীবনে একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। ধানমন্ডি ল্যাব এইডের কাছে বাস স্টান্ডে তিনি মিরপুরের বাস ধরার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। বাসে ছিল প্রচণ্ড ভীড়। তাই ভদ্রলোক বলে বাসে উঠতে পারছিলেন না। তার এ অসহায়ত্ব লক্ষ করেন পাশের এক প্রাইভেট কার চালক। এই সুযোগে কারচালক একটি ভাড়া মারতে চাইলেন। ভাইকে প্রস্তাব দিলেন, তার প্রাইভেট কারে যাওয়ার জন্য। ভাড়াটা একটু বেশি। তবে আরামে যাওয়া যাবে। সাথে আরো কয়েকজন জুটে গেল। বড় ভাই নিশ্চিত হলেন। প্রাইভেট কারে বাসের চেয়ে দ্রুততার সাথে তিনি মিরপুরে পৌঁছিতে পারবেন।
কিন্তু কিছুদূর গিয়েই কালো কাঁচের প্রাইভেট কারের চালক ও সহযাত্রীদের দেখা গেল ভিন্ন চেহারা। তারা দ্রুত ভাইয়ের হাত পা বেঁধে ফেল। চোখে কালো কাপড় দিয়ে পট্টি দিল। প্রথমে ইনিয়ে বিনিয়ে জানান দিল যে তারা প্রশাসনের লোক। মানে পুলিশের র্যাব, ডিবি, সিআইডি ইত্যাদি ইউনিটের কেউ। কিন্তু আমার বড় ভাই বুঝতে পারলেন, তিনি অপহৃত হয়েছেন। কিন্তু ততোক্ষণে তার অসহায়ত্ব চরমে। তার কিছুই করার নেই। এখন তিনি এ অপহরণকারীদের হাত থেকে শুধু জীবনটা বাঁচানোর চেষ্টাটুকু করতে পারেন।
অপহরণকারীগণ কঠিন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ভাইয়ের মোবাইল ফোন থেকে তার পরিবারের কাছে ফোন করাল। তাদের দাবি কয়েক লাখ টাকার। কিন্তু বড় ভাই তাদের দাবিকৃত সব টাকা সংগ্রহ করার মতো অবস্থায় ছিলেন না। তিনি তার পরিবারের কাছ থেকে বিষয়টি রীতিমত ছোট করে দেখিয়ে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা চাইলেন। সারা দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চল থেকে তিনি মুক্তি পনের টাকা সংগ্রহ করলেন।
টাকা পরিশোধের মাধ্যম ছিল বিকাশ। বিকাশ নম্বরের মাধ্যমেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এই মুক্তি পনের দেড় লাখ টাকা অপহরণকারীদের পরিশোধ করা হয়েছিল। অবশেষে সারা দিন অপহরণকারীদের প্রাইভেটকারে থেকে ভাই সন্ধ্যার দিকে মুক্তি পেলেন। তাকে মুক্তি দেয়া হল সাভারের ইপিজেড এলাকা থেকে। তিনি অতিকষ্টে প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।
আমার এ বড় ভাই পুলিশের কাছে যাননি। তার পরিবার তাকে পুলিশের আশ্রয় নিতে নিষেধ করছে। কারণ দ্বিবিধ। প্রথমত, অপহরণকারীগণ তাকে থানা-পুলিশ না করার হুমকি দিয়েছে। এতে তিনি অপহরণকারীদের নিরন্তর টার্গেটে পরিণত হতে পারেন। দ্বিতীয়বার একই অপহরণকারীদের অপহরণের শিকার হওয়ার পরিবর্তে তার পরিবার দেড়লাখ টাকার গচ্ছাকে বেশি উপকারী মনে করে।
দ্বিতীয় কারণটি অবশ্য চিরায়ত। থানা পুলিশ এ ঘটনার সঠিক তদন্ত তো দূরের কথা, এ জন্য মামলাই নিবেন কি না সে সম্পর্কে তার সন্দেহ রয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত রাজধানীর ধানমণ্ডী থানায় এর শেষ হয়তো ঢাকা জেলার আসুলিয়া থানায়। তাই থানা পুলিশ তাকে প্রথমেই ধানমণ্ডী ও আসুলিয়া থানার মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করতে পারে। অধিকন্তু একটি আন্তঃঅধিক্ষেত্রের মামলা নিয়ে স্বল্প এলাকার অধিক্ষেত্রসম্পন্ন থানাপুলিশ কতটা সুষ্ঠুতার সাথে এর কূল কিনারা করতে পারবে সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।
বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে অপরাধ জগতের মোডাস অপারেন্ডির সূক্ষ্নতাও বৃদ্ধি পায়। আমরা দ্রুতই প্রবেশ করছি একটি সাইবার জগতে। এ জগতের কোন সুনির্দিষ্ট সীমা নেই, পরিসীমা নেই। দিন-রাত-দেশ-বিদেশ এখানে একাকার হয়ে গেছে। একটি মাত্র অপরাধী দল এখানে সনাতনি অপরাধগুলোই ডিজিটাল সুবিধা কাজে লাগিয়ে সম্পন্ন করছে। কিন্তু আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এখনও সাইবার জগতের ছিঁচকে অপরাধীদের সাথেই পাল্লা দিয়ে উঠতে পারছে না।
বিকাশ বা মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে আমাদের সাধারণ জনগণ অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাপক সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু একই সাথে এ বিকাশ আমাদের চিরায়ত অপরাধগুলো, বিশেষ করে অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায়ের অপরাধের সংখ্যা ও মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। এ বড় ভাইয়ের মতো শত শত মানুষ এ ধরনের অপহরণ, প্রতারণ ও জালিয়াতির শিকার হচ্ছে। কিন্তু পুলিশের কাছে যাচ্ছেন না তাদের বেশির ভাগই। তাই এ জাতীয় অপরাধের প্রকৃত সংখ্যা ও মাত্রা নির্ণয় করা সম্ভব নয়।