মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ-২

সুকান্ত কুমার সাহা
Published : 15 Oct 2014, 06:04 PM
Updated : 15 Oct 2014, 06:04 PM

মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হয়েছে লড়াইয়ের মধ্যে আর এক লড়াই। আর সেটা হল; পারফেকশনের। কে কার চেয়ে খাঁটি এটা প্রমাণ করাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য। মানুষ ভুলে যাচ্ছে আপন-পর, ভুলে যাচ্ছে সামাজিক ও আদর্শিক মূল্যবোধ। একই মতাদর্শের মধ্যে থেকেও ভাগ হয়ে যাচ্ছে মানুষ, যে যার মত করে নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবছে, ফলশ্রুতিতে অপরপক্ষকে ছোট ভাবতে হচ্ছে বাস্তবিক অর্থেই। আবার যাকে ছোট ভাবা হচ্ছে, সেও নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবছে, নিজেকে ভাবছে শতভাগ খাঁটি আর বাকি সবাই ছোট বা নির্মূল যোগ্য। এর ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে, অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে মানুষের মধ্যে। শুরু হয়েছে মারামারি, কাটাকাটি।  জীবন্ত কবর, শিশু হত্যা ও ধর্ষণকেও এখন কেউ কেউ আর অন্যায় ভাবছে না। ভাবছে এটাই তার পাথেয়। পারফেক্ট রাস্তা। এক পক্ষ যখন এটা ভাবতে থাকে তখন অপরপক্ষও বেঁচে থাকার তাগিদেই বিকল্প খোঁজে, যদি সে কোনভাবে সেই বিকল্পটা পেয়ে যায়, তাহলে সেও প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে হয়ে ওঠে আরও নির্মম। আত্মঘাতি।

এই প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আজ ছোট ছোট দেশ তৈরি হচ্ছে। মানুষ গোত্রে গোত্রে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, যারা যে এলাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ তারাই সেই এলাকার মালিক বলে নিজেদের দাবী করে বাকিদের বের করে দিচ্ছে, ক্ষেত্র বিশেষে সংখ্যালঘুরা হত্যা, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। যারা এটা করছে তারা সাময়িক উত্তেজনায় ভুলে যাচ্ছে তাদের মূল্যবোধের বানী।

আর তাই তো সিরিয়ার ভূমি আজ ভাগ হয়ে গেছে- যে জনগোষ্ঠী যে এলাকায় শক্তিশালী আর সংখ্যাগরিষ্ঠ তাদের মধ্যে। একপক্ষে আছে শিয়া-খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী যার নেতৃত্ব দিচ্ছে সিরিয়ার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আসাদ আর অপরপক্ষে আছে সুন্নি জনগোষ্ঠী, যার নেতৃত্ব আছে এখন মূলত নুসরা ফ্রন্ট ও আইএস। আবার এই নুসরা ফ্রন্ট আর আইএসের মধ্যেও আছে শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে মারামারি, কাড়াকাড়ি। অথচ এরা কিন্তু সবাই ভাই ভাই, মিল থাকার কথা ছিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা? ওই যে বললাম, একজন যখন নিজেকে শতভাগ খাঁটি বলবে, তখন অপরপক্ষকে এমনিতেই খুঁতযুক্ত বলে মনে হবে। আর অন্যের খুঁতকে যেখানে দেখা হয় পাপ হিসেবে, সেখানে খুনোখুনি অবধারিত! আর তাই তো নুসরা ফ্রন্ট আর আই এসের মধ্যেও মাঝে মধ্যেই লেগে যায়। এতে বিরক্ত হয়ে এদেরই মাতৃ সংগঠন- আল কায়েদা; বাধ্য হয়েই এদের সংগঠন থেকে বের করে দিয়েছিল কিছুদিন আগে। কিন্তু তাদের এই সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হয়েছে, হিতে বিপরীত হয়ে স্বয়ং আল কায়দা সংগঠনই আজ মধ্যপ্রাচ্যে নিজ অস্তিত্ব বজায় রাখা নিয়ে হুমকির সম্মুখীন। এখানেও আছে সেই পারফেকশনের লড়াই যা এক সময় তারাও চর্চা করতো। তাদেরও আগে করেছিল ব্রাদার হুড।

এছাড়াও আছে কুর্দিরা; যারা মূলত কুর্দি ভাষাভাষী। এদেরকে কিছুটা সহনশীল মানুষ হিসেবে ভাবা হয়- যাদের বেশীর ভাগই সুন্নি মতাদর্শী, অল্প কিছু আছে শিয়া, খ্রিস্টান আর আছে নামমাত্র ইহুদী মতাদর্শী। এরা যেহেতু নিজস্ব দেশ বিহীন জাতি এবং সংখ্যালঘু তাই বাচার তাগিদেই পক্ষ নিয়েছে আসাদের এবং শত্রু হয়েছে সুন্নিদের তথা আইএসের। ফলে বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়িয়ে আছে আজ পুড়ো জনগোষ্ঠী; বাইরে থেকে তৃতীয়পক্ষ কেউ তাদের না বাঁচালে এদের মৃত্যু নিশ্চিত। আর যারা আজ তাদের হত্যা করতে উদ্ধত হয়েছে, তারাও কিন্তু সেই সুন্নি মতাদর্শরই মানুষ; যারা নিজেদেরকে কুর্দিদের চেয়ে উন্নত ভাবে, ভাবে নির্ভুল। আর এখানেই সমস্যার শুরু। শুরু হয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। আর বেঁচে থাকার তাগিদেই সব মানুষই এই লড়াইয়ে জিততে চায়, যার ফলে বেধে যাচ্ছে ভয়াবহ যুদ্ধ।

এই সুযোগটাই চাই, গোপাল ভাঁড়ের সেই ভাগ্নের; যে গুদামের পোড়া আলু খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করেছিল, মামা আলুর গুদাম আবার কবে পুড়বে? সময় পাল্টেছে। ভাগ্নের সংখ্যা বেড়ে গেছে। বেড়েছে তাদের ক্ষুধা। তাই তো আজ ভাগ্নেরা আর আলুর গুদাম পুড়ে যাওয়ার অপেক্ষা না করে নিজেরাই জ্বালিয়ে দিচ্ছে; আর আকাশ থেকে পোড়া আলুর দিকে শকুনি নজর রাখছে দলবেঁধে। আর সাথে জুটেছে কিছু কাক, যারা কিছু না বুঝেই কা কা করে জানিয়ে দিচ্ছে নতুন নতুন আলুর গুদামের সন্ধান; শকুন রুপী ভাগ্নেদের।

(অসমাপ্ত)

১৫/১০/২০১৪ রাত ১০.৩৬