কাসান্ড্রা সমস্যা

মেহেদী মাহমুদ চৌধুরী
Published : 25 Nov 2020, 01:52 PM
Updated : 25 Nov 2020, 01:52 PM


কাসান্ড্রা গ্রিক পৌরাণিক কাহিনির এক অবিস্মরণীয় চরিত্র। কাসান্ড্রা হলেন ট্রয় নগরীর রাজকন্যা। এই ট্রয় আক্রমণ করতে এসেছিলো রাজা আগামেমননের নেতৃত্বে গ্রিক বাহিনী। দশ বছর যুদ্ধের পরে ট্রয় নগরীর পতন ঘটে। গ্রিস ও ট্রয়ের যুদ্ধের কাহিনি নিয়ে রচিত হয়েছে হোমারের ইলিয়াড, অডিসির মতো মহাকাব্য ও প্রাচীন গ্রিসের কিছু নাটক। কাসান্ড্রা নিয়ে কাহিনির উৎস সে মহাকাব্য ও নাটকগুলো।
গ্রিক পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে কাসান্ড্রা ছিলেন দেবতা অ্যাপোলোর প্রেমিকা। অ্যাপোলো তাকে বর দিয়েছিলেন ভবিষ্যৎ দর্শনের মানে পরে কি হবে তা আগেই দেখে ফেলার। পরবর্তীতে কোন কারণে অসন্তুষ্ট হয়ে অ্যাপোলো সেই বর ফিরিয়ে নিতে চান। কিন্তু প্রতিশোধের মাত্রা বাড়ানোর জন্য দ্বিতীয় বর বা অর্থান্তরে অভিশাপ দেন যে কাসান্ড্রার ভবিষ্যৎ বাণী করার ক্ষমতা থাকবে কিন্তু সেই বাণী কেউ বিশ্বাস করবে না। গ্রিক ও ট্রয়ের যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণে এই বর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। গ্রিকদের ট্রয় জয়ে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ট্রয়ের অভেদ্য নগর প্রাচীর। গ্রিকদের সব আক্রমণ এই প্রাচীরের কাছে প্রতিহত হয়ে ব্যর্থ হচ্ছিলো। যুদ্ধের দশম বছরে এসে গ্রিকরা ট্রয় জয়ের এক অভিনব বুদ্ধি বের করে। তারা এক বিশাল কাঠের ঘোড়া তৈরি করে তাতে সেরা কয়েকজন সৈন্যকে লুকিয়ে রাখে। ট্রয় বাসী সেই ঘোড়াকে নিজেরাই নগরীর ভিতরে টেনে নিয়ে যায়। রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে তখন ঘোড়ার ভিতরে লুকিয়ে থাকা সৈন্যরা বের হয়ে নগরের প্রাচীরের দরজা খুলে দেয়। গ্রিক বাহিনী ঢুকে পড়ে নগরে। পতন ঘটে এরকম আক্রমণের জন্য অপ্রস্তুত ট্রয়ের। কাসান্ড্রা তার ভবিষ্যৎ দর্শন ক্ষমতা বলে এ ঘটনা আগেই দিব্য চক্ষু দিয়ে দেখতে পেরেছিলেন। তিনি সতর্ক করেছিলেন ট্রয়বাসীকে। কিন্তু অ্যাপোলোর দ্বিতীয় বরের কারণে কেউ তাকে বিশ্বাস করে নি। কাসান্ড্রার এই ঘটনা নিয়ে বাংলাতে কিছু কবিতাও লেখা হয়েছে। কবি বিষ্ণু দের একটি কবিতা আছে কাসান্ড্রা নামে যেখানে তিনি বলছেন 'বলো কাসান্ড্রা, এত দুর্যোগ ছিলো কোথায়'। কবি শামসুর রাহমানের 'ইলেক্ট্রার গান' নামে যে দুর্দান্ত কবিতা আছে সেখানেও পরোক্ষ চরিত্র হিসাবে আছেন কাসান্ড্রা। রাজা আগামেমননের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটা যে ঘটবে তা কাসান্ড্রা দেখতে পেয়েছিলেন যদিও কবিতাটাতে তার নাম আসেনি।

কাসান্ড্রা সমস্যা তাই আমার কাছে এমন একটা পরিস্থিতি যেখানে ভবিষ্যতে কি ঘটবে তা আগেই জানা যাচ্ছে কিন্তু সেই তথ্য কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। এটা এমন পরিস্থিতিও দেখায় যে যুক্তি থাকা সত্ত্বেও সেই যুক্তি মানুষের কাছে গ্রহণীয় হচ্ছে না। যদিও অ্যাপোলোর বরকে আপাতত মনে হয় শুধু মাত্র কাসান্ড্রাকেই নিয়ে বর কিন্তু আসলে এই দ্বিতীয় বর কাসান্ড্রাকে দেয়া হয়নি বরং দেয়া হয়েছে যারা গ্রহণ করবে তাদেরকে। দ্বিতীয় বরের মাধ্যমে কাসান্ড্রার বাণী যাদের কাজে লাগবে তাদের সেই বাণী গ্রহণের ক্ষমতা সরিয়ে নিয়ে হয়েছে।

যুক্তি অস্বীকারের ব্যাপারটা বোঝার জন্য ট্রয় বাসীদের ঘোড়া নগরের ভিতরে টেনে নেবার ঘটনাটা একটু ভেবে দেখা যাক। বিস্ময়কর এই ঘটনাটা। ট্রয় বাসী মনে করেছিলো যে গ্রিকরা ট্রয় দখলে নিজেদের ব্যর্থতা মেনে নিয়ে ট্রয় ছেড়ে চলে গেছে। যাবার আগে তারা দেবতাদের উৎসর্গ করে তৈরি করেছিলো ঘোড়াটাকে। এ পর্যন্ত ঠিক আছে মানে পুরোপুরি অযৌক্তিক ঠেকছে না। কিন্তু সেই ঘোড়ার ভিতরে অস্ত্রশস্ত্র বসে ছিল তিরিশ জনের মতো সৈন্য সামন্ত। কাঠের ঘোড়া নগরের ভিতরে টেনে নিয়ে যাবার সময়ই তো অস্বাভাবিক ওজনটা টের পাবার কথা। এবার দৃশ্যটা চিন্তা করে দেখুন। কাসান্ড্রা একদিকে চিৎকার করে সবাইকে তার ভবিষ্যৎ দর্শনের কথা বলে যাচ্ছে। অপরদিকে ট্রয় বাসী সৈন্য সামন্ত ভর্তি এক বিশাল কাঠের ঘোড়াকে নির্বিকার ভাবে নগরের ভিতরে হেঁইয়ো হেঁইয়ো বলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কাঠের ঘোড়ার অস্বাভাবিক ওজনের কথা তারা একবারেই মাথায় আনছে না। ভিতরে লুকিয়ে থাকা সৈন্যরা হয়তো মাঝে মাঝে টানাটানির হেলাদুলাতে দুই একটা শব্দ করে ফেলছেন। কিন্তু সব কিছুই উপেক্ষা করছে নির্বিকার ট্রয়বাসী।

ট্রয়ের এই ঘোড়া নগরের ভিতরে টেনে নিয়ে যাওয়া ঘটনা তাই সহজ প্রমাণকে উপেক্ষা করার ঘটনা। বিপরীত মত ও মতের পক্ষে প্রমাণ যেখানে উপস্থিত,অর্থাৎ কাসান্ড্রা ও ঘোড়ার অস্বাভাবিক ওজন, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সেই মত ও মতের পক্ষে প্রমাণকে উপেক্ষা করেছে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে গ্রিস ও ট্রয় নগরীর মধ্যে প্রাচীন কালে আসলেই কোন এক যুদ্ধ ঘটেছিলো। প্রত্নতত্ত্ববিদরা ট্রয় নগরীর ধ্বংসাবশেষও খুঁজে পেয়েছেন বলে কিছু তত্ত্ব চালু আছে। কিন্তু ট্রয়ের এই ঘোড়ার কাহিনির কতটুকু ঐতিহাসিক সত্যতা আছে কে জানে? আমি সেই সত্যতা এখানে খুঁজতে যাবো না। বরং কাসান্ড্রা সমস্যা বলে যে সমস্যা পূর্বে চিহ্নিত করেছি তা নিয়েই বেশী মাথা ঘামাবো।

কাসান্ড্রা সমস্যা আমি আগেই সংজ্ঞায়িত করেছি যুক্তি সিদ্ধ সত্য গ্রহণে অক্ষমতা হিসাবে। কাসান্ড্রা সত্য বলে কারণ সে ভবিষ্যৎ দেখে। তার সপক্ষে প্রমাণও আছে যা আমি আগেই বলেছি। কিন্তু যাদের কাজে লাগবে তারা তা গ্রহণ করতে অক্ষম। এরকম উদাহরণ কি বর্তমান পৃথিবীতে পাওয়া যাবে? নিশ্চিত ভাবেই এই উদাহরণগুলো নির্ভর করবে যে আলোচনা করছে তার উপরে। যে কোন কাহিনির বর্ণনা বাস্তব থেকে অনেক সরল হয়ে থাকে। এর উদাহরণ পাবার জন্য যেকোনো গল্প উপন্যাস বা চলচ্চিত্র দেখুন। দেখবেন, আমরা দৈনন্দিন জীবনে যা করি তার ক্ষুদ্রাংশই ওগুলোতে ধরা পড়ে। গল্প-কাহিনি তাই বাস্তব জীবন থেকে অনেক সরল। এই সরলতার কারণ এই যে, ঘটনা বর্ণনাকারীর পক্ষে সব কিছু পর্যবেক্ষণ ও তা লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। সে শুধু তার দেখাতে যা মূল ঘটনা তাই বলতে পারে ও সামাজিক ভাবে আমরা সে রকম ভাবেই গল্প শুনতে অভ্যস্ত।

আমি তাই একজন পর্যবেক্ষকের যে সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেছি তা মেনে নিয়েই কাসান্ড্রা সমস্যার উদাহরণ দেবো। ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সমাজ যে আচরণ করে বিপরীত চিন্তা যদি যুক্তিযুক্ত হয় তবে কাসান্ড্রা সমস্যার উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যাবে। এই লেখাটা আমি নানা বিষয় আলোচনা করেছি কিন্তু আগেই বলে রাখা ভালো যে কাসান্ড্রা সমস্যাতে যারা ভুগছেন তারা কিন্তু অসৎ নন। তারা সত্যি ভেবেই ভুলকে বিশ্বাস করছেন। যুক্তিকে উপেক্ষা করছেন। আমি পূর্বে `চারটি পুরানো গল্পঃ একটি নতুন বিবেচনা` শিরোনামের একটি লেখাতে হ্যান্স ক্রিস্টিয়ান এন্ডারসেনের রাজার নতুন পোশাক গল্পের একটা আলোচনা করেছিলাম। হ্যান্স ক্রিস্টিয়ান এন্ডারসেনের এ গল্পটা এখন মোটামুটি সবারই জানা। গল্পটা নিয়ে যে আলোচনা করেছিলাম তা নিচে আবার বিবৃত করছি।

`রাজার নতুন পোশাক` গল্পটাতে আছে যে এক রাজাকে দুই তাঁতি এমন পোশাক তৈরি করার কথা বলছে যা বোকা লোকেরা দেখতে পারে না। এই পোশাক রাজা সহ উজির নাজির কেউই দেখতে পারছে না। কিন্তু বোকা প্রমাণিত হবার ভয়ে সবাই পোশাকটা দেখার কথা বলছে। রাজা একদিন এই অদৃশ্য পোশাক নিয়ে শোভাযাত্রাতে বের হলেন। রাজ্যের লোকেরা কেউ পোশাকটা না দেখতে পেলেও মুখে তা বলছে না। এমন সময় এক শিশু বলে উঠলো রাজা নেংটা। শিশুর মুখের কথায় রাজাসহ সবার বোধোদয় হলো। তারা বুঝতে পারলেন যে তাঁতি দু'জন সবাইকে বোকা বানিয়েছে। এই অত্যন্ত শক্তিশালী গল্পটার নানা ব্যাখ্যা আছে। যার একটি হলো শিশুরা সত্য বলে।

আমার পূর্বের আলোচনাতে আমি সে ব্যাখ্যাতে না যেয়ে অন্য আরেক সম্ভাবনা বিবেচনা করেছিলাম। তা হলো তাঁতি দু'জন সত্যিই হয়তো সে পোশাক বানিয়ে ছিলো। শিশুটা সহ রাজ্যের সবাই বোকা বলে কেউই পোশাকটা দেখতে পারেনি। রাজা সহ প্রথমে সবাই তাই মিথ্যা বলছে বা অসৎ উচ্চারণ করেছে। কিন্তু শিশুটা যা বলেছে তা সৎ ভাবেই বলেছে অথচ সেই সৎ আচরণের উৎস নির্বুদ্ধিতা। শিশুর কথায় রাজ্যের সবাই যা দেখেছে তাই প্রকাশ শুরু করে মানে সত্য বলা শুরু করে। এই আচরণ সৎ হলেও তাতে পোশাক যে তৈরি হতে পারতো সে সম্ভাবনা মিথ্যা হয়ে যায়নি।
কাসান্ড্রা সমস্যাকে আমি এভাবেই সংজ্ঞায়িত করতে চাই। এটা এমন এক সমস্যা যেখানে মানুষ সৎ আচরণ করে কিন্তু সেই আচরণটা ভুল ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত।
পুরো জাতি বা জনগোষ্ঠী এমন আচরণ করে এরকম উদাহরণ পাওয়া দুষ্কর হবে। হয়তো কখনো পাওয়াও যাবে না। কারণ মানুষের বর্ণনাতে কখনো জীবনের সামগ্রিকতা ধরা পড়া সম্ভব না, যা আমি আগেই বলেছি। সেই বর্ণনা সব সময় খণ্ডিত হবে। কিছু প্রকৃত উদাহরণ খোঁজার জন্য তাই হয়তো ব্যক্তির আচরণের কাছে যেতে হবে। তবুও সেখান থেকেও তা পাওয়া কঠিন হবে। তাই আমাদের যেতে হবে মানুষের জীবনের খণ্ড খণ্ড চিত্রগুলোর কাছে যেগুলোকে উদাহরণ হিসাবে চিহ্নিত করা যাবে। সেগুলোর ভিত্তিতে আমরা পরে বৃহত্তর পরিসরে কিছু উদাহরণের খোঁজ করে দেখতে পারবো।
এখানে আরো বড় এক অসুবিধা আছে। তা হলো কিভাবে কার কি ভূমিকা তা চিহ্নিত করা হবে? কাসান্ড্রা সমস্যাটা দুই পক্ষের ডায়লগের মতো যেখানে এক পক্ষ আরেক পক্ষের কাছে নিজের মত ও যুক্তি প্রকাশ করছে। যেমনটা ঘটেছে ইস্কিলাসের আগামেমনন নাটকে কাসান্ড্রা ও কোরাসের কথোপকথনের সময়ে। কিন্তু বাস্তবে কে কাসান্ড্রা ও কে সত্য ও যুক্তি উপেক্ষাকারী তা নির্ণয় কঠিন।

ব্যাপারটাকে সহজ করে দেখার জন্য সবার আগে হয়তো বিজ্ঞানের দ্বারস্থ হতে পারা যেতে পারে। বর্তমানে কোভিড ১৯ জনিত কারণে সারা বিশ্বব্যাপী যে সংকট চলছে তার সম্ভাবনা বিজ্ঞানীরা বহু বছর আগেই উল্লেখ করে গেছেন। কিন্তু বিজ্ঞানীদের সেই সব বক্তব্য উপেক্ষিত হয়েছে। এই উপেক্ষার মধ্যে অনুমান করি কোন অসততা ছিলো না। সাধারণ মানুষের কাছে ভাইরাস জনিত মহামারীকে মনে হয়েছে অলিক কল্পনা। বিজ্ঞানীরা কি যুক্তি দিয়েছেন, কেন দিয়েছেন, তা সাধারণ মানুষের, মানে যাদের সবচেয়ে বেশী কাজে লাগবে তাদের শোনার আগ্রহ ছিলো না। এছাড়া বিজ্ঞানীদের এই ভবিষ্যৎ বাণীর ভিত্তি ছিলো বিবর্তন সম্পর্কিত ধারণাগুলো যাতে এখনো অনেকে অবিশ্বাস করেন। সাধারণ মানুষ এই সব নিয়ে মাথা না ঘামালেও বিদ্বান সমাজ এই ভবিষ্যৎ বাণীগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থ প্রবাহের লক্ষ্য মূলত সাধারণ মানুষকে খুশী করে তাদের ভোট ও সমর্থন জয় করা। তাই তারা যা সহজে চায় না সেগুলোতে প্রচার প্রচারণার অভাব দেখা যায়। সেজন্য কোভিডের জোর প্রচার দেখা যায় নি, যা হয়েছে তাও নজর এড়িয়ে গেছে। বিজ্ঞান এই উদাহরণে কাসান্ড্রা ও সাধারণ মানুষ ট্রয় বাসীর ভূমিকায়।

উপরের আলোচনা দেখায় যে বিজ্ঞানের সাহায্যে কাসান্ড্রা সমস্যার পরিচ্ছন্ন উদাহরণ পাওয়া তুলনামূলক ভাবে সহজ হবে। তবে সমাজ বিজ্ঞান ও চিন্তার মতো বিষয়গুলোতে এরকম পরিচ্ছন্ন প্রমাণ পাওয়া কঠিন। কারণ এই বিষয়গুলোতে চূড়ান্ত সত্যি মিথ্যা বলে কিছু নেই । তবু উদাহরণ খোঁজার জন্য মানুষের সামাজিক আচরণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে কিছু প্রচেষ্টা চালাবো।

আমার দেখায় বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দর্শকদের আচরণের মধ্যে কাসান্ড্রা সমস্যার লক্ষণ পাওয়া। বিশেষ করে যখন বর্তমান ফুটবলার, ক্রিকেটার ইত্যাদি খেলায় জড়িত ব্যক্তিরা সারাবিশ্বে জনপ্রিয় ও ব্যাপক ধনসম্পদের অধিকারী। এই খেলাগুলোর দর্শক প্রিয়তাকে কাসান্ড্রা সমস্যার উদাহরণ হিসাবে পেশ করা যায় বলে অনুধাবন করি। কেন তা নিচে বিশ্লেষণ করছি।

ফুটবল, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলা হলো মানুষের নির্মিত জগত। এই জগতগুলোতে যা ঘটে তা মানুষের বানানো নিয়ম অনুযায়ীই ঘটে। যেমন একটা ফুটবল একটা গোলপোস্টে জড়ালে আসলে বিশেষ কিছুই ঘটে না। এরকম জালে বল যেকোনো সময়েই জড়াতে পারে। কিন্তু মানুষের বানানো নিয়মে একে বলা হয় গোল করা ও এর মাধ্যমের ফুটবল খেলায় কে জিতেছে ও কে হেরেছে নির্ধারণ করা হয়। প্রতিযোগিতা ও শরীরচর্চা মানুষের স্বভাবজাত বলে মানুষে এই ধরণের খেলাগুলো উদ্ভাবন করেছে ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আনন্দ লাভ করার প্রক্রিয়া তৈরি করেছে। কিন্তু বর্তমানে মিডিয়ার কল্যাণে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অস্বাভাবিক সামাজিক মর্যাদার অধিকারী হয়েছে । সারা পৃথিবীব্যাপী অসংখ্য মানুষ এখন অপরের খেলা দেখার জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করে থাকে। এমন কি প্রিয় খেলোয়াড় ও প্রিয় দলের জন্য কিছু ভক্তকুল জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিতে প্রস্তুত। এখানে আপনি আমি যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারবো, কিন্তু ভক্তের মন টলাতে পারবো না। তাই প্রিয় দল ও খেলোয়াড়ের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ ও অকাতরে অর্থ ব্যয় কাসান্ড্রা সমস্যার লক্ষণ প্রকাশ করে।

আমি এখন এক ফুটবল ক্লাবের ভক্তের উদাহরণ দেবো। তিনি যে দলটির ভক্ত সে দলটি বিশ্বের একটি প্রথম সারীর ফুটবল দল কিন্তু গত তিরিশ বছর ধরে জাতীয় প্রতিযোগিতাতে শিরোপা পায়নি। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম যে তিনি কেন এই দলের সমর্থন করেন বা আদৌ কেন এই নিয়ে মাথা ঘামান। উত্তরে বলেছিলেন যে তিনি ছোট বেলা থাকেই এই দলের ভক্ত। তার সমর্থিত দল শিরোপা জিতুক বা না জিতুক তাতে তার কিছু আসে যায় না। ফুটবল ক্লাবের ভক্ত সুখে দুঃখে দলের পাশে থাকবে। দরকার হলে আরো তিরিশ বছর তিনি অপেক্ষা করবেন।

এই ছোট্ট উদাহরণ দেখায় যে মানুষের যুক্তি গ্রহণের সীমাবদ্ধতা আছে। এই বিশেষ ব্যক্তি কোন যুক্তিকেই এখন গ্রহণ প্রস্তুত নয়। দল হারুক বা জিতুক তাতে তার দলের প্রতি সমর্থনের কোন কমতি হয় না। সে নিজের অর্থ ও সময় ব্যয় করে দলের জন্য সৌধ গড়তে প্রস্তুত। এরকম আরো অনেক ভক্ত আছে যাদের আর্থিক অবদানের ভিত্তিতে ক্লাবের খেলোয়াড়রা নিজেদেরকে কীর্তিমান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে ও বিলাস বহুল জীবন যাপন করে।

এসব বিষয় যে বোঝেন না বা কখনো ভাবেন না এমন লোক নেই তা নয়। কিন্তু এ কথাগুলো শোনার বা প্রচারের লোক নেই। কারণ মানুষ এগুলো শুনতে চায় না। এই যুক্তি প্রচারও হবে না কারণ, না শুনার মধ্যে অর্থের লেনদেন নেই। এখানে কেউ কেউ বলতে পারেন, যে মানুষগুলো এই সব খেলাগুলো দেখছে, তারা যে আনন্দ পাচ্ছে তার তুলনাতে তাদের যে ব্যয় হচ্ছে তা বেশী নয়। অর্থাৎ এই ঘটনাগুলোতে ভোক্তারা লোকসানের চেয়ে লাভটাই বেশী করছে। এই যুক্তি বাতিল করার মতো নয় ও অনেক ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য মনে করি তবু নিচে খানিকটা খতিয়ে দেখবো।
সত্যি যে মানুষ ভোগ বা ব্যবহার করে এমন জিনিসের সংখ্যা গুণে শেষ করা যাবে না। এর অনেকগুলো আছে মূলত মধ্য বা অন্তর্বর্তী বস্তু যাকে ইংরেজিতে বা অর্থনীতিতে ইন্টারমিডিয়েট দ্রব্য বলা হয়। এছাড়া আছে নানা রকমের যন্ত্রপাতিও। মানুষের পক্ষে এগুলো ভোগ করা সম্ভব হয় না বরং এগুলো চূড়ান্ত দ্রব্য তৈরিতে কাজে লাগে। এই চূড়ান্ত দ্রব্যগুলোই মানুষ ভোগ করে থাকে। কিছু কিছু চূড়ান্ত দ্রব্য আবার মধ্য দ্রব্য হিসাবেও ব্যবহার করা হতে পারে। যেমন মানুষ দুধ ভোগ করতে পারে আবার দুধের তৈরি নানা রকম পণ্যও যেমন মিষ্টি, দই, পনির ইত্যাদি ভোগ করতে সক্ষম।
এই চূড়ান্ত ভোগ কৃত পণ্য গুলোর কিছু শরীর বৃত্তিও প্রয়োজন মেটায়। এর মধ্যে আছে খাদ্য, ঔষধ, পোশাক, ব্যায়ামের জিনিস ইত্যাদি। এগুলো মানুষের সরাসরি শারীরিক উপকারে লাগে। আবার কিছু পণ্য শরীর ও মনের দুইয়েরই জন্যও দরকার হয়। যারা শরীর ও মনকে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ মনে করেন তারা বলবেন সব পণ্যই একই সাথে শরীর ও মনের কাজে লাগে। এই জটিলতায় না গিয়ে বলবো যে সব ধরণের পণ্য ভোগেই মানুষ কিছু না কিছু ভাবে উপকৃত হয়। মানুষ খাদ্য পোশাক ইত্যাদির মতো পণ্য ছাড়াও এমন কিছু পণ্য ভোগ করে থাকে যা প্রত্যক্ষ পণ্য বলা যায় না। যেমন গান শোনা, আইনজীবীর পরামর্শ, যাদুঘর পরিদর্শন, শিক্ষা গ্রহণ, ফুটবল খেলা দেখা ইত্যাদি। এই পণ্যগুলোকে বলা হয় সেবামূলক পণ্য। এই পণ্যগুলোর ভোগও মানুষকে উপকৃত করে।
উপরের উদাহরণ অনুযায়ী ভোগের মাধ্যমে যে মানুষ উপকৃত হয় তাতে সন্দেহের সুযোগ নেই। কিন্তু উপকারের কারণ অভ্যস্ততাও হতে পারে মানে যে উপকার আসে তা মূলত অভ্যস্ততার জন্যই আসে। আরো বললে, কোন কারণে ব্যক্তি মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে পণ্য ভোগে এবং ভোগের সন্তুষ্টি সে কারণেই তৈরি হয়। তার মানে সবগুলোর না হলেও মানুষ ভোগ কৃত প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষ অনেক পণ্যই চাহিদার কোন প্রকৃত শারীরিক বা মানসিক কারণ নেই। বরং অভ্যস্ততাই মূল কারণ।

কেন কোন জিনিসে মানুষ অভ্যস্ত হয় তার কারণ নিশ্চয়ই থাকবে যদিও মানুষ তা ভুলে যেতে পারে। যেমন দুই দ্বীপ রাষ্ট্র জাপান ও যুক্তরাজ্যের খাদ্যাভ্যাস। এই লেখকের দুই দেশেই স্থায়ী ভাবে থাকার সুযোগ হয়েছে। এই দুই দেশের খাদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণ আলাদা। জাপানের মানুষ সব ধরণের সামুদ্রিক মাছ ও প্রাণী খেতে পছন্দ করে অথচ অন্য দেশটিতে অপছন্দই বেশী। তাই প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষ অনেক পণ্যের যে চাহিদা আছে তা ঘটছে সামাজিক আচরণের কারণে ও শিশু কাল থেকেই মানুষকে এইসব আচরণের সাথে পরিচিত করে অভ্যস্ত করে তোলা হয়। খাদ্যাভ্যাস ছাড়াও এর মধ্যে আছে নানা রকম দিবস পালন উপলক্ষে মানুষের কার্যক্রম। ক্রীড়া দলের সমর্থনও এদের মধ্যে আছে। আবার অনেকে কিছুটা বড় হয়ে বা কিশোর বয়সে এই আচরণগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। মানুষের স্বভাবের মধ্যেই এই সামাজিক আচরণের জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা আছে। ব্যক্তি এই সব সামাজিক আচরণের মাধ্যমে আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচয় তৈরি করতে চায়। কিন্তু যার ভিত্তিতে আত্মপরিচয় তৈরি করা হয় তার বিশেষ কোন যুক্তি থাকে না। বেশীর ভাগ মানুষের মনে প্রশ্নও থাকে না তাই এগুলো মানুষের কাসান্ড্রা সমস্যার উদাহরণ।
উপরে যে মত প্রকাশ করলাম তার বিপরীতে যুক্তি হতে পারে যে মানুষের এই সব সামাজিক আচরণের দরকার আছে। তাই কেন কিভাবে এই আচরণগুলো আসলো তা বেশী জরুরী নয়, এগুলো আছে তাই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন এক সপ্তাহে সাত দিন আছে। এর মধ্যে যেকোনো দিনই ছুটির দিন হতে পারতো। তাই কেন শনি-রবি না হয়ে সোম-মঙ্গল ছুটির দিন হলো না এই সব প্রশ্ন বাতুলতা মাত্র। কাজেই যারা এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না তারা ঠিকই করছে। এই যুক্তির সাথে মিল আছে অর্থনীতির ক্রীড়া তত্ত্বের বহুল আলোচিত ধারণা ব্যাটেল অফ সেক্সেস এর সাথে। এই ধারণাতে এক যুগল সন্ধ্যায় কি করবে তা ঠিক করছে। একজন বেশী পছন্দ করে অপেরা দেখতে আর অপরজনের পছন্দ বক্সিং দেখতে যাওয়া। তবে মূল কথা হলো তারা একসাথে যদি না যায় তবে দুজনেরই তৃপ্তির পরিমাণ শূন্য হবে। তাই যাই করা হোক এক সাথেই করতে হবে। বেশকিছু তুলনীয় বিষয়ের মধ্যে কোন কর্মটি সেরা তা বিবেচ্য না হয়ে বিবেচ্য হলো কাজটা যৌথ ভাবে করা হচ্ছে কিনা।
কিন্তু মানুষের মধ্যে এই বিকল্প আচরণের উপরে প্রিয়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব আরোপের প্রবণতা আছে। সে ভুলে যায় যে, যেকোনো একটা করলেই হয়,প্রিয়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব এখানে বিবেচ্য নয়। কিন্তু যারা এরকম চিন্তায় বাধা পড়েন তাদের কাছে এসব যুক্তির কোন গুরুত্ব নেই। তাদের অস্তিত্ব ও পরিচয় তারা মনে করেন নির্ধারিত হয় এই সব আচরণ তারা করছেন কিনা তার উপরে। নিজের সময় ও সম্পদ ব্যয় করে তারা এসব আচরণ করে যান বিকল্প বিবেচনা না করেই।
যারা সম্পদশালী তাদের জন্য এগুলো সমস্যা না। সম্পদ আছে তাই তাতো ব্যয় করতে হবে! কিন্তু যারা সম্পদশালী নয় তারা কি করবেন? তাদের দুই একজনের পক্ষে হয়তো ভবিষ্যতে সম্পদশালী হওয়া সম্ভব হতে পারে, কিন্তু বেশীরভাগের সেই সম্পদ অর্জন সম্ভব নয়। এখন সম্পদশালীদের সম্পদের সাথে একাত্মতা বোধ কি তাদের সম্পদশালী করে? না, বরং এতে তারা যে নিজেরা সম্পদশালী নন তাই আরো বেশী সুস্পষ্ট হয়। নিজেদের পরিচয়কে শক্তিশালী করার জন্য তাদের তাই সেই সম্পদের গুরুত্ব অস্বীকার করাই সমীচীন। মনে রাখতে হবে যে সম্পদের মূল্য সম্পদের নয় বরং মানুষের মন দ্বারাই নির্ধারিত। এর ছোট্ট কিন্তু বেশ সহজ উদাহরণ হলো হিরের আংটি। হিরে দুষ্প্রাপ্য কিন্তু মানুষের তা না হলেও চলে। কিন্তু নানা কারণে হিরা অত্যন্ত দামী পণ্য হিসাবে পরিগণিত হয়। যেহেতু জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজন নেই তাই হিরাকে সহজে উপেক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু সাধারণ মানুষ উপেক্ষা না করে বরং হিরাকে মহার্ঘ কামনীয় মনে করে। হিরা তাই দামি। কিন্তু হিরা পাবার আকাঙ্ক্ষা বরং ধনী দরিদ্রের ব্যবধানকে আরো বৃদ্ধি করে কারণ ধনী এখানে তার সম্পদ এমন ভাবে কাজে লাগাতে পারে যা দরিদ্রের পক্ষে সম্ভব হয় না।

এই উদাহরণটা গ্রহণযোগ্য না মনে হলে বিকল্প আরেকটা পরিস্থিতি চিন্তা করুন। ধরা যাক এক ধু ধু মরুভূমিতে দিকহারা দুই জন পথিকের কথা। একজনের কাছে আছে হিরে জহরতে ভরা একটা বাক্স। আরেকজনের হাতে আছে পানির বোতল। জগতের দামের হিসাবে হিরা জহরতে সম্পদশালী ব্যক্তিটি অনেক বেশী ধনী, কিন্তু ওই মুহূর্তে তা মালিকের বেচে থাকায় সাহায্য করবে না। বরং দরকারি বস্তুটি আছে পানির মালিকের কাছে। পানির মালিক যদি ঐ মুহূর্তে হিরা জহরতকে মূল্যবান মনে করে পানির সাথে বিনিময় করে তবে বেচে থাকার সম্ভাবনা তার কাছ থেকে অপর জনে বদল হয়ে যাবে। পানির মালিক যদি ধু ধু সেই মরুভূমিতে হিরা জহরতে মালিকের সম্পদ দেখে ঈর্ষান্বিত হয় তবে তার মানে হলো সে জগতের তৈরি করা মূল্যের ফাঁদে বাধা পড়ছে। এর ফলে সে হয়তো হিরা জহরতের বিনিময়ে পানির বোতল বিনিময় করবে যা তার মৃত্যুর কারণ হবে। এরকম জগতের তৈরি মূল্যের ফাঁদে আমরা অনেকেই বাধা পড়ে আছি ও যুক্তি থাকা সত্ত্বেও বের হতে পারছি না। মানে আমরা ট্রয় বাসীর ভূমিকায়।

এখানে প্রশ্ন আসতে পারে যে উপরের উদাহরণের মধ্যে আমি পূর্বের যে ডায়ালগের উল্লেখ করেছি তা অনুপস্থিত। একজনের কথা প্রেক্ষিতে আরেকজনের নিরব থাকাও একধরণের ডায়ালগ। তবু ডায়ালগ হয়তো প্রত্যক্ষ না হতে পারে যখন মত বিনময় বা প্রকাশের কোন সুযোগ থাকে না। এই প্রসঙ্গে হয়তো গায়ত্রী স্পিভাকের ` ক্যান সাব অল্টার্ন স্পিক` নামক প্রবন্ধের কথা এখানে কেউ কেউ স্মরণ করতে পারেন। আমি এই নামটা অস্বস্তি নিয়েই উল্লেখ করছি কারণ প্রবন্ধটা আমি কয়েকবার পড়ার চেষ্টা করেও দাঁত বসাতে পারিনি। তাই অন্যদের সাথে কথা বলা ও কিছু ইউ টিউব ভিডিও দেখার সুবাদে জানতে পেরেছি যে সাব অল্টার্ন বলতে বুঝানো হচ্ছে সেই নিপীড়িত গোষ্ঠীদের যাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নেই। এই ব্যাখ্যাতে আমি কিছু পরেই আবার ফিরে আসবো, কিন্তু বলতেই হবে যে প্রবন্ধের নামটা আমাকে প্রবল ভাবে আকর্ষণ করেছে। কথা আসলে সবাই বলতে পারে, কিন্তু নিজের কথা অপরকে সবাই শোনাতে সক্ষম নয় বা শোনাতে পারলেও তা ফলপ্রসূ ভাবে তা ঘটে না। নিপীড়িত সাথে সাব অল্টার্নকে মেলানোর চেয়ে, সবার কথা শোনাবার অধিকার থাকে না- এই বাস্তবতাই আমাকে বেশী আকর্ষণ করেছে। কাসান্ড্রা সাব অল্টার্ন হতেও পারেন আবার নাও হতে পারেন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো যে তার কথা অপরের কাছে পৌঁছে দিতে পারে না।


এরকম একটি দুর্দান্ত ঘটনা পাওয়া যাবে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহের লালসালু উপন্যাসে। লালসালুর বিষয় ও মজিদ সম্পর্কে সবাই মোটামুটি জানেন তাই উপন্যাসের বিষয়ের দিকে না গিয়ে সরাসরি ঘটনাতে যাওয়া যাক। উপন্যাসের এক চরিত্র আক্কাস গ্রামে ইস্কুল খুলতে চায়। কিন্তু মজিদ এমন কৌশল করে যে গ্রামের লোকের কাছে আক্কাস সে কথা পাড়তে পারে না। আক্কাস যখন মজিদের কাছে ইস্কুলের কথা বলতে আসে, মজিদ বলে ওঠে `তোমার দাড়ি কই মিঞা?` এই এক কথাতেই মজিদ আক্কাসকে গ্রামের লোকদের কাছে ভিন্ন হিসাবে প্রমাণ করে ফেলে। যেখানে গ্রামের সবার দাড়ি আছে, সেখানে আক্কাসের তা নেই। আক্কাসের ইস্কুল তৈরির কথা বোঝানোর আর সুযোগ হয় না। আক্কাস এই ঘটনাতে কাসান্ড্রার অবস্থানে।

এই উদাহরণ দেখায় যে গ্রাম-শহর, অর্থ-সম্পদ, কে নিপীড়িত বা নিপীড়নকারী তা নয়, এই সমস্যার মূল বিবেচ্য হলো বক্তব্য প্রকাশের সুযোগ ঘটছে কিনা এবং তা গ্রহণের ঘটনা ঘটছে কিনা।
আমাদের মাঝে শহর ও গ্রাম এবং ধনী-দরিদ্র সম্পর্কে যে রোমান্টিক ধারণাগুলো আছে তাতে ইংরেজি শিক্ষিত আক্কাসের বিপরীতে গ্রামবাসীদেরই কাসান্ড্রার ভূমিকাতে থাকার কথা। অথচ ঘটছে তার বিপরীত। আসলে সম্পর্কের ক্ষমতার কাঠামোকে যেভাবে সহজ সরল ভাবে দেখার প্রবণতা আছে তা মোটেই সঠিক নয়। দমনকারী ও দমন কৃতের ভূমিকা স্থিতিশীল কোন ভূমিকা নয় ও তা সময় ও স্থানের প্রেক্ষিতে পরিবর্তিত হয়। যে গ্রামবাসী রাজধানীর ক্ষমতা কাঠামোতে দমনের স্বীকার, সেই গ্রামবাসীই গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে, রাজধানীর কোন প্রতিনিধিকে দমিত রাখতে পারে। এমনকি সবচেয়ে দলিত পরিবারও নিজের পরিবারের মধ্যে একে অপরকে সুযোগ সুবিধা মত দমিত করতে পারে। নিপীড়িত ও নিপীড়নকারীকে কথা বলার সাথে সমার্থক না করে ফেলাই বাঞ্ছনীয়। গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে যারা নিপীড়িত ও নিপীড়নকারী, উভয়েরই হয়তো জাতীয় ক্ষমতা কাঠামোতে বক্তব্য প্রকাশের সুযোগ নেই। তার মানে এই না যে তারা গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে ক্ষমতা ব্যবহার করেন না।

এই প্রসঙ্গে আমার কান্টিয় কিছু ধারণার কথা মনে পড়ছে। আমার ক্ষুদ্র পাঠে দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টকে বুঝে ওঠা অসম্ভব। তাই পূর্বের মতোই যথারীতি ইউ টিউবের সাহায্য নিয়েছি। কিছু ভিডিও দেখার সুবাদে জানতে পেরেছি, সময় সম্পর্কে কান্ট জানাচ্ছেন যে, সময় অন্যান্য বস্তুর মতো নয়। দুইটা পাথর আলাদা বস্তু এবং তাদের মধ্যে কোন প্রকার সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। কিন্তু সময়ের ক্ষেত্রে তা সত্য নয়। ক্ষুদ্র সময় বৃহতের অন্তর্গত, যেমন, এক মিনিট এক ঘণ্টার অংশ। এছাড়া দুইটা ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যে সম্পর্ক থাকতে বাধ্য। যেমন সকালের এক মিনিট আর বিকালের এক মিনিট আলাদা হলেও তাদের মধ্যে এই সম্পর্ক আছে যে একটা আরেকটার আগে ঘটেছে।
আধুনিক পদার্থ বিদ্যা অনুসারে বস্তু ও সময়ের এই বৈশিষ্ট্য কতটুকু সঠিক বলতে পারছি না। তবু মানুষকে এই দুইয়ের এক বিচিত্র সমন্বয় বলে অনুধাবন করি। দুইজন মানুষকে দুই বস্তু হিসাবে ধরা যায়, যাদের পরস্পরের কোন সম্পর্কে নেই। আবার তারা সম্পর্কিত সমাজের মাধ্যমে। মানুষ যেখানেই থাকুক সে একই সাথে তার শারীরিক সীমাবদ্ধতা ও সামাজিক পরিচয়ের অধীন। সে খাদ্য গ্রহণ করে তার শারীরিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য আবার সেই খাদ্য গ্রহণের তৃপ্তিতে তার সামাজিক পরিচয় নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন কাসান্ড্রা সমস্যার সাথে এই আলোচনার সম্পর্ক কোথায়? তা নিচে ব্যাখ্যা করছি।

মানুষ যেমন সব সময় একা তেমনি সে একই সাথে সমাজের অংশ। কিন্তু সামাজিক সম্পর্ক নির্ভর করে তার সমাজের গঠনের উপরে। এই গঠন নির্ভর করে অপর এককগুলোর একক এবং সামাজিক আচরণের উপরে। যেমন বন্ধুত্বের সামাজিক আচরণ নির্ভর করে বন্ধু সংখ্যার উপরে। যেমন দুই বন্ধু একসাথে যে আচরণ করবে তিন বন্ধু এক সাথে সেই আচরণ করবে না। আবার তিন বন্ধুর মধ্যে নুন্যতম ছয় প্রকার আচরণ দেখা যাবে। তিন বন্ধুকে যদি ক, খ ও গ হিসাবে চিহ্নিত করি তবে আচরণের একক ও যৌথতা মিলিয়ে আচরণগুলোর সেট হবে {ক, খ, গ, কখ, কগ, খগ, কখগ}। ক, খ ও গ প্রত্যেকেই এখানে চার রকম আচরণ করছে। এই সেটের বাইরেও মনে রাখতে হবে যে ক, খ, গ পরস্পর ছাড়াও অন্য অনেকের সাথেই সম্পর্কিত থাকতে পারে। সেই সম্পর্কগুলো তাদের পারস্পরিক ও একক আচরণ নির্ধারণ করতে পারে। যেমন ধরা যাক, ক ও খ এর সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে এই তথ্য উপস্থিত যে ক পারিবারিক শিক্ষা জনিত কারণে একটি বিশেষ খাদ্যগ্রহণ করে না যা খ গ্রহণ করে থাকে। সেক্ষেত্রে খ যদি ক কে খাদ্যগ্রহণে নিমন্ত্রণ করে তবে খ হয়তো সেই বিশেষ খাদ্য পরিবেশন থেকে বিরত থাকবে। আবার একই ঘটনা ঘটতে পারে যখন ক, খকে নিমন্ত্রণ করবে। খ যদি কোন বিশেষ খাদ্য না করতে চায় কোন পারিবারিক শিক্ষা জনিত কারণে, ক সেই খাদ্য খ'কে পরিবেশন করবে না। একই ঘটনা ঘটতে পারে পরস্পরের মধ্যে সংলাপের ক্ষেত্রেও। ক ও খ পরস্পরের সঙ্গে সংলাপ বিনিময়ে সতর্কে থাকতে পারে, যদি তারা জানে পরস্পরের কাছে কোন সংলাপ গ্রহণযোগ্য হবে না, তা যতই যুক্তিযুক্ত হোক না কেন। এই উদাহরণ দেখায় যে ক ও খ পরিস্থিতি সাপেক্ষে কাসান্ড্রা ও ট্রয় বাসীর ভূমিকা পরিগ্রহণ করতে পারে এবং এই পরিচয় পরিবর্তনশীল। এতদূর আমরা বন্ধুত্বের উদাহরণ দিয়েছি, কিন্তু পরিবারের মধ্যে এরকম হরহামেশাই ঘটছে। পিতা-মাতা ও ছেলে-মেয়ের মধ্যেও সম্পর্কের এরকম পরিবর্তন দেখা যায়। পরিবেশ পরিস্থিতি জনিত কারণে তারা নিজেদের সম্পর্কের প্রেক্ষিতে মাঝে মাঝে কাসান্ড্রা ও মাঝে মাঝে ট্রয় বাসীর ভূমিকা পালন করেন।
উপরে আলোচনা আমাদের জীবনের বাস্তবতা বোঝার জন্য খুব জরুরী। সংলাপ বিনিময়ের ঘটনাটাকে সব সময় ক্ষমতার সম্পর্ক দিয়ে বিবেচনা করা যাবে না। বরং দেখা উচিত একজনের মত অপরজন কতটুকু গ্রহণ করতে সক্ষম। ক্ষমতা মানুষকে বাধ্য করাতে পারে অপরের মত পালন করতে কিন্তু তার মানে এই না যে সে অপরের মত গ্রহণ করেছে। যেমন পিতা-মাতা তাদের ক্ষমতা বলে ছেলে-মেয়েকে বাধ্য করতে পারে তাদের পছন্দনীয় কাজ করতে। তার মানে এই না যে ছেলে-মেয়ে সেই সিদ্ধান্তকে গ্রহণযোগ্য মনে করছে। সবচেয়ে ক্ষমতাহীনও অপরের মত গ্রহণ না করে পালন করতে সক্ষম।

উপরের আলোচনা থেকে আমার মতে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে কাসান্ড্রা সমস্যার অগুনিত উদাহরণ পাওয়া যাবে। কিন্তু ব্যক্তিক, পারিবারিক ও গোষ্ঠীগত উদাহরণ যে রকম পাওয়া যাবে, জাতীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে হয়তো সেরকম পাওয়া সহজ হবে না। কিন্তু পাঠক একমত হবেন যে ব্যক্তিক, পারিবারিক ও গোষ্ঠীগত যে উদাহরণ আমরা পাচ্ছি তা কিছুটা নিরীহ গোছের। আমরা সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজেদের সংলাপ নিয়ন্ত্রণ করি, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আমাদের জীবনকে আনন্দময় করে, তাই এগুলোতে কাসান্ড্রা সমস্যা পাওয়া গেলেও তা আদৌ হয়তো সমস্যা হিসাবে বিবেচ্য নয়।
কিন্তু বৃহত্তর পরিসরে গেলে আমরা কাসান্ড্রা সমস্যার ভয়াবহ রূপ দেখতে পাবো। যেমন প্রথমেই আমরা কোভিডের উদাহরণ দিয়েছি ও দেখেছি কাসান্ড্রা সমস্যা বিপর্যয়কারী হতে পারে। আমার কাছে এরকম বিপর্যয়কারী মনে হয় বিশ্বব্যাপী আমরা মানুষে মানুষে মেরুকরণের যে ঘটনাগুলি দেখতে পাই সেগুলোকে। অনেকেই একমত হবেন যে বিশ্বব্যাপী মানুষ নানা উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই বিভক্তির আমরা সম্প্রতি এক চরম প্রকাশ দেখেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে (২০২০) যেখানে দেখা যাচ্ছে এক প্রার্থী মূলত শহুরে ভোটারদের ভোট পেয়েছে যেখানে অপর জন পেয়েছে গ্রামাঞ্চলের ভোট। পূর্বে যখন মিডিয়া অল্প কিছু গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত তখন কেন্দ্রের যারা কাছাকাছি নন তাদের জাতীয় ভাবে মত প্রকাশের সুযোগ হতো না। তাদের পক্ষে সুযোগ অনেক কম ছিলো সংগঠিত হবার। কিন্তু ইন্টারনেটের সুবাদের এখন কথা বলার বা যোগাযোগের অধিকার অনেক বিস্তারিত হয়েছে। সমমনা লোকেরা সুযোগ পেয়েছে কাছে আসার। এই কারণে বিস্তার সহজ হয়েছে নানা দল ও উপদলের। এখানে মনে রাখতে হবে যে, আগে মত প্রকাশের সুযোগ না পাওয়া মানে এই না যে সেই মতগুলো সুন্দর ও শান্তির পক্ষে ছিলো। যেমন আগে হয়তো জাতিগত বিদ্বেষ পোষণকারী তার মতের সপক্ষের লোক খুঁজে পেত না। কিন্তু ইন্টারনেটের সুবাদ সেরকম সমমনাকে তার পক্ষে খুঁজে পাওয়া সহজ হয়েছে।

তবু এখানে পরস্পরের সাথে সংলাপের পরিবেশ তৈরির প্রয়োজন আছে। যেমন আন্তর্জাতিক অভিবাসন উন্নত বিশ্বের একটি বড় রাজনৈতিক সমস্যা। বিভিন্ন নির্বাচনের ফল থেকে দেখা যায় যে বিভিন্ন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিরোধী। এমনকি আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিরোধিতাতে উন্নয়নশীল দেশের জনগোষ্ঠীও পিছিয়ে নেই। তারা অন্য দেশে যেতে চায় কিন্তু নিজের দেশে আসতে দিতে চায় না। অপরদিকে অভিবাসনের পক্ষেও অনেকে আছেন। এই দুই পক্ষের দীর্ঘদিন কোন সংলাপ হয়নি। পক্ষের লোক পক্ষে থাকার যুক্তি দেন, যেমন তারা অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মানবাধিকার ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন, যা বিপক্ষের লোকের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। অপরদিকে বিপক্ষের লোক সমাজ পরিবর্তন, চাকুরীর অভাব, স্থানীয় অর্থনীতি শব্দ ইত্যাদি ব্যবহার করে যুক্তি দেন যা পক্ষের লোকেরা উপেক্ষা করেন। তাই দুই পক্ষই এখানে কাসান্ড্রা ও ট্রয় বাসীর ভূমিকায় পরিবেশ ও পরিস্থিতি সাপেক্ষে।

কিছু কিছু মহৎ কিন্তু অযৌক্তিক ধারণার ব্যাপক প্রসার দেখা যায় মিডিয়া মানব উন্নয়নের জন্য কাজ করা গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে। যেমন মানুষের নানা রকম অধিকারের কথা। এই অধিকারের ধারণাগুলো মহৎ কারণ এগুলো মানুষের জীবনকে সুন্দর করতে চায়। কিন্তু এগুলি যুক্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত নয়য়, বিশেষ করে যখন বলা হয় যে এগুলো জন্মসূত্রে প্রাপ্ত। আসলে মানুষের অধিকার, যেমন শিক্ষার অধিকার, কোন জন্মগত অধিকার নয় বরং তা অত্যন্ত দরকারি প্রায়োগিক কারণে। এই জায়গাতে আমি আবার হয়তো কিছুটা কান্টিয় কারণ জীবন যাপনের শুদ্ধ যুক্তির চেয়ে ,`করনীয় কি` তাই অনুসন্ধান করা পক্ষে বলছি। তবু পূর্বের মতোই বলে রাখছি যে নীতিশাস্ত্রের তত্ত্বগত বিষয়গুলোতে আমার পঠন পাঠন খুবই সীমিত। আমার এই চিন্তাতে অন্যদের প্রভাব আছে নিশ্চিত তবে তা কতদূর আছে তা আমার পক্ষে নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়।

আমার অবস্থান হলো যে বেচে থাকাকে সুন্দর করার জন্য নানা ধরণের মানব অধিকার চর্চার প্রয়োজন আছে। যেমন আগে উল্লেখিত শিক্ষার অধিকার। সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা প্রথা ও আইন কানুনের মাধ্যমে মানুষের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা হয়। উদাহরণ স্বরূপ আধুনিক রাষ্ট্রে বিনামূল্য শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা এবং সেই অনুযায়ী আইন কানুন ও নীতি নির্ধারণ। এই নিয়ম কানুনগুলো বলা যায় এক ধরণের সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও সরাসরি সেরকম চুক্তি দেখা যায় না তবে পরোক্ষ ভাবে সেরকম প্রক্রিয়ার উপস্থিতি আছে। আধুনিক বিশ্বে বেশীর ভাগ রাষ্ট্রে ভোটের মাধ্যমের একটি দল বা ব্যক্তি সরকার পরিচালনার সুযোগ পায়। সেই সরকার নাগরিকদের নানা অধিকার নিশ্চিত করা চেষ্টা করে। জনগণ যদি সে সরকারের কার্যক্রম অনুমোদন না করে তবে পরবর্তীতে নির্বাচনের মাধ্যমের সে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে।

সমস্যা হয় যখন এই অধিকারগুলোকে সামাজিক চুক্তির অধীন না মনে করে জন্মগত অধিকার মনে করা হয়। রাষ্ট্র, সমাজ ও জাতিভেদে সামাজিক চুক্তিতে ব্যবধান আছে। কিন্তু মানব প্রগতি ও উন্নয়নের জন্য কাজ করছেন এমনদের মাঝে কিছু সামাজিক চুক্তিকে অন্য সমাজের উপরে আরোপের প্রবণতা আছে। অথচ সে সমাজ হয়তো সেই অধিকারের ধারণাকে গ্রহণ করে না। এখন ধরা যাক সামাজিক চুক্তি করা সেই সমাজের আরেক গোষ্ঠী আছেন যারা এই সমস্যাটা খুব সহজেই বুঝতে পারেন। তারা এই মত দিতে চান যে অপর সমাজটির কাছে এই মহৎ ধারণাগুলোর কোন গুরুত্ব নেই। এই মত যুক্তিযুক্ত কিন্তু প্রগতি ও উন্নয়নের পক্ষের করা গোষ্ঠী এই যুক্তিগুলো যেকোনো কারণেই হোক মেনে নিতে পারেন না। এভাবে বিভক্তি ঘটতে পারে সমাজের ও মানব অধিকার বিষয়ক সামাজিক চুক্তিতে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোকে আমার মতে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। মানব প্রগতি ও উন্নয়নের পক্ষের আচরণ করা ব্যক্তিবর্গ এক্ষেত্রে দুঃখজনক ভাবে ট্রয় বাসীর ভূমিকায়।
আগেই বলেছি যে কাসান্ড্রা ও ট্রয় বাসীর ভূমিকা ভালো-মন্দের সমার্থক নয়। যেমন উপরে আমি বলেছি যে মানব অধিকারের পক্ষে যারা আছেন তারা ভালোর পক্ষের লোক। তারা যে সময়ে মানব অধিকারের ধারণাগুলো উদ্ভাবন করেছিলেন তা নিশ্চয়ই যুক্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত ছিলো। কিন্তু সময় পরিবর্তিত হয়ে গেলে সেই যুক্তিগুলো আগের মতো শক্তিশালী নাও ঠেকতে পারে। সেক্ষেত্রে যারা বিপরীতে আছেন যেমন, নানা রকম অধিকারের বিপক্ষে তাদেরকেই বেশী যুক্তিযুক্ত মনে হতে পারে। বিশ্বব্যাপী ভোটারদের কাছে ইদানীং বিপরীত যুক্তিগুলোকে শক্তিশালী মনে হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। এই প্রমাণ উপেক্ষা করে আগের যুক্তিগুলো পরিবর্তন না করে পুরানো যুক্তিগুলোর পুনরাবৃত্তি কাসান্ড্রা সমস্যার উপস্থিতির লক্ষণ দেখায়, যেখানে দুর্বল গতানুগতিক যুক্তির কারণের তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ।
দীর্ঘ দিন ধরে মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীরা ব্যক্তি বিশেষকে একধরণের ইমিউনিটি দিয়ে আসছে। ব্যক্তির বিভিন্ন ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ব্যক্তি নিজের অমঙ্গলের কারণ হয়। কিন্তু সে অমঙ্গলের জন্য দায়ী করা হয় সরকার, রাজনীতিবিদ ও নীতি নির্ধারকদের। এই আচরণের মধ্যে ভোটের ও জনপ্রিয়তার আকাঙ্ক্ষা আছে বলে অনুমান করি। সরকার ও রাজনীতিবিদরা মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারেন কিন্তু ব্যক্তিকে নির্দোষ ভাবার প্রবণতার ভুল। যেমন হিটলারকে যতই নৃশংসতার দায়ী করা হোক না কেন, জনগণের ভোটে হিটলার নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতাতে এসেছিলো ভুলে গেলে চলবে না। তাই জনগণ যে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে তা প্রমাণিত। বর্তমান বিশ্বে এরকম ভাবেই পরিবর্তন ঘটছে। জনগণের সমর্থন নিয়েই নানা দেশে চরমপন্থি দলগুলো ক্ষমতাতে আসছে। মানে সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও বিপর্যয়কারী সমস্যাগুলোর জন্য দায়ী। কিন্তু মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী সাধারণ মানুষকে এই ভুল সিদ্ধান্তগুলির জন্য দায়বদ্ধ করে না। তাদের সমালোচনার লক্ষ্য এখনও শুধু সরকার, রাজনৈতিক দলগুলো ও নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতা। সরকার, রাজনৈতিক দল ও নীতি নির্ধারকদের সমালোচনায় আওতায় রাখা দরকার, কিন্তু সেই সাথে দরকার সাধারণ মানুষকে তাদের ভুল সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবহিত করা। এই প্রয়োজন ক্রমাগত উপেক্ষিত হচ্ছে।

সবশেষে আরেকটি উদাহরণ পেশের চেষ্টা করবো। এই উদাহরণ বামপন্থি চিন্তা সম্পর্কে। বিগত একশত বছরের ইতিহাস দেখায় যে বামপন্থি চিন্তা ও রাজনীতি, যা জনমানুষের মঙ্গলের চিন্তা করে, সে সরকারগুলো মানুষের জন্য তেমন মঙ্গলজনক হয়নি। দেখা গেছে পুঁজিবাদের পথ ধরেই মানুষের কল্যাণ বেশী এসেছে। দুঃখজনক ভাবে বামপন্থি চিন্তার পক্ষের লোকের এই প্রমাণগুলো উপেক্ষা করেছেন। পুঁজিবাদ নানা ভাবে পরিবর্তিত হয়ে এখন অনেক বেশী জনকল্যাণমুখী। তবু বামপন্থি চিন্তার পক্ষের লোকেরা তাদের সেই পুরানো চর্চিত ভাষায় কথা বলেন। তারা পুঁজি কর্তৃক মানুষকে বিশেষ করে কৃষক ও শ্রমিক শোষণের কথা বলেন। তারা পুঁজিবাদকে মানুষের কল্যাণের বিপরীতে দাড় করান। তারা যে সঠিক নন তা নয়। কিন্তু বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থার তুলনাতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রেই কৃষক ও শ্রমিকের উন্নতি অনেক বেশী হয়েছে। এই প্রসঙ্গে কবি জীবনানন্দ দাশের সুচেতনা কবিতার পঙক্তি মনে পড়ছে। তিনি সুচেতনা কবিতাতে বলছেন ' সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে— এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে।' পুঁজিবাদের সংশোধনের মাধ্যমেই মানুষের অনেক বেশী অর্থনৈতিক মুক্তি হয়েছে ও হবে বলে অনুমান করি। এছাড়া বুঝতে হবে যে ইন্টারনেটের সুবাদে এখন তথ্য-প্রযুক্তি ও যোগাযোগের যে অভূতপূর্ব বিকাশ হয়েছে তার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব গতানুগতিক ভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না। মানুষের সত্যিকারের কল্যাণ যারা চান তাদের নিজেদের চিন্তার ধরণ পরিবর্তন করতে হবে নতুন বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনাতে এনে। বিগত দশকগুলোতে বৈপ্লবিক রাজনীতি ও রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের মঙ্গল হয়েছে এমন কোন উদাহরণ নেই। এই বিষয়টাকেও বিবেচনাতে নেয়া দরকার। সারা বিশ্বে বাম চিন্তার কি পরিবর্তন ঘটছে তা আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশে তাদের সে প্রবণতা নেই বলেই আমার পর্যবেক্ষণ।
দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ারের বরাতে জানতে পারছি যে মানুষের যুক্তি গ্রহণে সীমাবদ্ধতা আছে। যুক্তি দিয়ে কাউকেই নাকি বোঝানো বা রাজি করা সম্ভব নয়। তাই কাসান্ড্রা সমস্যার যে উদাহরণগুলি আমি দিয়েছি, তা হয়তো মানব চরিত্রের সীমাবদ্ধতা থেকেই এসেছে। আমার তবুও মনে হয় যে যুক্তির শক্তি আছে পরিবর্তনের। কোন জ্ঞান যদি সত্যি হয় তবে সে জ্ঞান থেকে উদ্ভূত যুক্তি শক্তিশালী হবে। মানুষ তার মুখোমুখি হয়ে প্রথমে মেনে নিতে না চাইলেই এক সময়ে তাকে মেনে নিতে হয়, কারণ সত্য জ্ঞান ও তদনুযায়ী যুক্তি পরিবর্তিত হতে পারে না। এরকম শক্তিমত্তা দেখা যায় ধর্ম প্রচারকদের যুক্তিতে। মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী এই সত্যের উপর ভিত্তি করে ধর্মপ্রচারকরা তাদের প্রচারণা চালান, পাশাপাশি যদিও অন্য কিছু বিষয়ও থাকে। মানুষ মরণশীল এই সত্যি যেহেতু অপরিবর্তনীয়, তাই প্রথমে মেনে না নিলে বা বিরোধিতা করলেও, মানুষকে ধর্মপ্রচারকদের শেষমেশ মেনে নিতে হয়। তাই আমার মত যে, জগত ব্যাপী যে নানাবিধ সমস্যা দেখা যায় তার মোকাবেলাতে যুক্তির আশ্রয় নেয়াই সমীচীন। কিন্তু সেই যুক্তির ভিত্তি হতে হবে সত্য। এই সত্য বলতে আমি পরম সত্য বুঝচ্ছি না। বরং বলছি সেই সত্যকে যা মানুষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জন করে। যেমন আগের উদাহরণের মৃত্যু পরম সত্যের বিবেচনাতে সমাপ্তি নাও হতে পারে। কিন্তু পৃথিবীর জীবনযাপনের সমাপ্তি যে শারীরিক মৃত্যুতে ঘটে, তা সবাই অভিজ্ঞতা জনিত কারণে সত্য বলে মেনে নেয়। এরকম সত্যকে যুক্তির ভিত্তি করলে তা হয়তো সময়ের পরিক্রমাতে এক সময়ে গ্রহণযোগ্য হবে। মানুষের যুক্তি গ্রহণে সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, কাসান্ড্রা সমস্যার লক্ষণ হয়তো সর্বব্যাপী হতে পারে তবু, এ পথেই হয়তো সমস্যা থেকে ক্রমমুক্তি ঘটবে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ

এ লেখার রচনার সময় আমি ইউটিউবের বেশ কিছু দর্শন বিষয়ক ভিডিও দেখেছি যা থেকে বিভিন্ন দার্শনিক ও সমাজ চিন্তাবিদদের ধারণা সম্পর্কে জানতে পেরেছি। কোন বিশেষ একটি ভিডিও থেকে তথ্য নেয়া হয়নি তাই সে ভিডিওগুলোর লিঙ্ক দেয়া হলো না। শোপেনহাওয়ার বিষয়ক তথ্য নেয়া হয়েছে উইল ডুরান্টের `স্টোরি অফ ফিলিসফি` গ্রন্থ থেকে। কাসান্ড্রা বিষয়ক তথ্য এসেছে Encyclopedia Britannica ও এস্কিলাসের আগামেমনন নাটক থেকে। নিচের লিঙ্কগুলোতে তা পাওয়া যাবে।
https://www.britannica.com/topic/Cassandra-Greek-mythology
http://classics.mit.edu/Aeschylus/agamemnon.html

পরিশেষে এ লেখাটা তৈরি করার সময় আমি যাদের কাছ থেকে মতামত ও পরামর্শ পেয়েছি তাদের প্রতি জানাই কৃতজ্ঞতা।