ধর্ষকের জবানবন্দি আর এ সংক্রান্ত চাপান-উতোর

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 11 March 2015, 08:47 AM
Updated : 11 March 2015, 08:47 AM

দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে দুই মাসের বেশী হয়ে গেল। এমন বাজে রাজনৈতিক ডামাডোলের সবচাইতে বড় সমস্যা হল, আমাদের যাবতীয় মনযোগ ওই দিকে চলে যায়। আমাদের মধ্যে এক অংশ চায় সরকার শক্তি প্রয়োগ করে বিএনপিকে নির্মূল করে বর্তমান সহিংসতা বন্ধ করে দিক, আর আরেকদল চায় সরকার বিরোধী দলের সাথে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করুক। দুই পক্ষের নানা বাহাস দেখা যায় পত্রিকায়, টিভির টক শো তে, ব্লগে। সে বাহাস আজ থাকুক।

যে কথা বলছিলাম, ডামাডোলের ভীড়ে হারিয়ে যায় আমাদের জাতীয় জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমরা এখন আলোচনা করি না সুশাসন নিয়ে, কল্যানমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও আমাদের আলোচনা, যুদ্ধ সব কিছুই চলে গদি দখল আর গদি ধরে রাখা নিয়ে। এর মধ্যেই আমাদের সমাজে, অন্য দেশের সমাজে ঘটে চলে নানা ঘটনা, যেগুলোর বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা আমাদের ভবিষ্যৎ বিনির্মানে অনেক বড় ভূমিকা রাখতো।

বলছিলাম বিবিসির প্রামাণ্যচিত্র "ইন্ডিয়া'স ডটার" (ইউটিউব লিঙ্ক – https://www.youtube.com/watch?v=dWwM3j6sx28) এর কথা। এই প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা নিয়ে ভারতে রাজনৈতিক দলগুলো, মিডিয়া আর নাগরিকরা দারুন বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। আমাদের পত্রিকায়, টিভিতে এটা খবর হিসেবে এসেছে, কিন্তু আমাদের কোন আলোচনা, বিশ্লেষণ ছিল না।

https://www.youtube.com/watch?v=dWwM3j6sx28

যারা খবরটা ফলো করতে পারেননি, তাদের জন্য কিছু তথ্য। দিল্লীর চলন্ত বাসে সেই আলোচিত 'নির্ভয়া' ধর্ষণ (যার পরিণতিতে মেয়েটি মারা যায়, আহত হয় তার বন্ধু) নিয়ে বিবিসি এই প্রামাণ্যচিত্রটি তৈরি করে। যেটা ভারতসহ সারাবিশ্বে প্রচার করার কথা ছিল বিশ্ব নারী দিবসে (৮ মার্চ)। কিন্তু প্রামাণ্যচিত্রটি প্রচার করার কয়েকদিন আগেই পত্রিকা আর টিভির খবরে আসা একটা বিষয় ভারতে ক্ষমতাসীন সরকারকে ভীষণ নাখোশ করে তোলে।

ওই প্রামাণ্যচিত্রে নির্ভয়ার ধর্ষকদের একজনের (মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত) বক্তব্য আছে। সেখানে সে অনুতাপহীনভাবে যা বলেছে তা মোটামুটিভাবে এরকম – নির্ভয়ার কোনভাবেই উচিৎ হয়নি ধর্ষনে বাধা দেয়া। সে যদি বাধাহীনভাবে ধর্ষণ করতে দিতো তাহলে তারা তাকে ধর্ষণ করে নিরাপদে ছেড়ে দিতো। তার কথামতো ভদ্র মেয়েরা কখনও রাত ৯টার দিকে ঘুরে বেড়ায় না। ধর্ষণের জন্য একটা ছেলে যতটা দায়ী, একজন মেয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী। মেয়েদের কাজ হলো ঘরের কাজ করা,সংসার সামলানো। রাতে ডিসকো নাচে যাওয়া ও বারে ঘুরে বেড়ানো, আজেবাজে কাজ করা, ভুলভাল পোশাক পরা তাদের কাজ নয়। এ ধরনের মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার অধিকার অন্যদের আছে। কেবল ২০ শতাংশ মেয়ে ভালো। সে আর বলেছে এই ঘতনায় তার মৃত্যুদন্ড হলে ধর্ষণ তো কমবেই না, বরং আরো খারাপ হবে। এখন থেকে ধর্ষকরা সাক্ষী না রাখার জন্য ধর্ষিতাকে আর বাঁচিয়ে রাখবে না, স্রেফ মেরে ফেলবে।

ওই ধর্ষকের বক্তব্য নেয়া হয়েছিল জেলে, আগের কংগ্রেস সরকারের কাছ থেকে যথাযথ অনুমতি নিয়েই। কিন্তু এই বক্তব্য দেখানো নিয়েই আঁতে ঘা লাগে বর্তমান বিজেপি সরকারের। তারা এই প্রামাণ্যচিত্র প্রচার না করার জন্য বিবিসি কে চাপ দেয়। বিবিসি অবশ্য এই চাপ অগ্রাহ্য করে নির্ধারিত তারিখের আগেই ওটা প্রচার করে দেয়। ক্ষিপ্ত বিজেপি সরকার বিবিসির বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নেয়ার উপায় খতিয়ে দেখছে। সরকারের এই পদক্ষেপ নিয়ে স্পষ্টতই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে ভারতের সবাই। আমি বিশ্বাস করি এই বিষয় নিয়ে আমাদের সমাজেও গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক হওয়া উচিৎ ছিল।

কোন সন্দেহ নেই, নির্ভয়ার ধর্ষকের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা ওই কথাগুলো ভয়ঙ্কর, বিভৎস, মর্মান্তিক। এসব ক্ষেত্রে আমাদের মত দেশগুলো যা করি, ওসব কথা সামনে আসতে দেই না। আমাদের ধারণা এমন ভয়ঙ্কর অপরাধীর কথা সবার সামনে আসবে কেন? এদেরকে ধরে ঝুলিয়ে দিলেই তো সব ল্যাঠা চুকে যায়। এবং আমাদের ধারণা এতেই সমাজে এইসব ভয়ঙ্কর অপরাধ কমে যাবে। কিন্তু ওটা হয় না; আমরা ভুলে যাই কার্পেটের নীচে ধূলাকে লুকানোই যায় শুধু, ওটার মানে পরিচ্ছন্নতা না। বরং ক্রমাগত ধূলা জমে জমে ঘরটাই ভাগাড়ে পরিণত হয় একদিন।

অপরাধীর মনস্তত্ত্ব সুস্থ সমাজ গঠনের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। অপরাধীরা এই সমাজেরই মানুষ এবং তারা তাদের এই মূল্যবোধ (সেটা যতোই নোংরা হোক না কেন) পায় এই সমাজ থেকেই। এর স্পষ্ট অর্থই হল ভয়ঙ্কর গলদ আছে আমাদের সমাজেই, যেখানে বসবাস করা মানুষের মধ্যে এমন মূল্যবোধ তৈরি হয়! এজন্যই আমরা এসব কথা সামনে আসতে দিতে চাই না। বলাই বাহুল্য সমাজের এই পচনের পেছনে দায় আছে সমাজের সবার। অপরাধের দায় নিতে না চাওয়া আমাদের মজ্জাগত। বরং অপরাধের যাবতীয় দায়ভার অপরাধীকে দিয়ে তাকে ঝুলিয়ে দিতে পারলেই আমরা দায়মুক্ত বোধ করি। আমরা ভাবি বটে, কিন্তু এতে কি আর দায় শেষ হয়?

নির্ভয়ার ধর্ষকের যে বক্তব্য, এমন চিন্তা করার মানুষ ভারতের সমাজে যেমন প্রচুর আছে, তেমনি আছে আমাদের সমাজেও। এই মতামতগুলোর গলা না টিপে ধরে বরং সামনে আসতে দেয়া উচিৎ। তাদের সাথে কথা বলতে দেয়া উচিৎ সাইকোলজিস্ট, সোশ্যলজিস্ট, ক্রিমিনোলজিস্টদের। তারপর সব মিডিয়ায় হওয়া উচিৎ দীর্ঘ আলোচনা, বিতর্ক। মানুষ সব জানুক, বুঝুক।

যে সমাজে ভয়ঙ্কর সব মূল্যবোধ বিরাজ করে, সেই সমাজের মানুষের মানুষকে প্রথমেই সমাজের পচনকে স্বীকার করে নিতে হবে। সবাইকে তার অনুপাতের দায় মাথা পেতে নিতে হবে (এই দায় আপনার আমার মত সব সাধারণ মানুষেরও আছে)। তারপর গোড়ায় কাজ করতে হবে সেই পচন বন্ধ করার জন্য। সেটা না করে, অপরাধীর মনস্তত্ত্ব লুকিয়ে রেখে, তাকে ঝুলিয়ে দেয়াকেই আমরা যারা সমাধান বলে মনে করি, তাদের জেনে রাখা জরুরী এতে কোনভাবেই নির্ভয়া কান্ড ঠেকানো যাবে না, বরং আরো বাড়বে।

একটা ছোট তথ্য দিয়ে শেষ করি, ভয়ঙ্কর অপরাধীকে প্রকাশ্যে শিরোশ্ছেদের নিয়ম করে সৌদিআরব ভেবেছিল সমাজে সুড়সুড় করে ভয়ঙ্কর অপরাধ কমে যাবে। কিন্তু ওদের মৃত্যুদন্ডের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছেই, আর সেটা কার্যকর করার মতো পর্যাপ্ত জল্লাদ এখন পাওয়া যাচ্ছে না। ওদিকে মৃত্যুদন্ড নেই এমন বহু দেশে এসব ভয়ঙ্কর অপরাধের মাত্রা অনেক কম।