জাফর স্যার, কেন লিখেননি ‘তোমরা যারা লীগ কর’?

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 31 August 2015, 10:50 AM
Updated : 31 August 2015, 10:50 AM

ভিসি'র সাথে গণ্ডগোলের জের ধরে কাল শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষকদের পিটিয়েছে ছাত্রলীগ; পিটুনি খাওয়া শিক্ষকদের মধ্যে আছেন ডঃ জাফর ইকবাল স্যারের স্ত্রী ডঃ ইয়াসমিন হকও (ভিসির রাস্তা খালি করতে শিক্ষকদের পেটাল ছাত্রলীগ)। ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই দারুণ আঘাত পেয়ে জাফর ইকবাল স্যার বলেছেন – আমার গলায় দড়ি দিয়ে মরা উচিৎ। অবশ্যই আক্ষরিক অর্থে মরার কথা বলেননি তিনি, এই উক্তির মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন ক্ষোভের প্রাবল্য।

একই ধরণের পোস্ট আমি কিছুদিন আগেও আরেকটি লিখেছিলাম (জাফর ইকবাল স্যার, অনেক দায় আছে আপনারও) যখন সিলেটের এক 'মহামহিম' এমপি জ্যাফর স্যারকে চাবকাতে চেয়েছিলেন। কাল আবার জাফর স্যারের ক্ষোভ-হতাশা দেখে আবার লিখতে ইচ্ছে হল।

জাফর স্যার, আর তাঁর মত কিছু মানুষ মনে করেন (অন্তত মুখে তাই বলেন) আওয়ামী লীগ এই দেশে স্বাধীনতার চেতনা বাস্তবায়ন করবে। এর প্রমাণ হিসাবে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের উদাহরণ দেখান তাঁরা। নিশ্চয়ই এই ভয়ঙ্কর অপরাধের বিচার করার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার ধন্যবাদ প্রাপ্য, কিন্তু শুধু এর মানেই কি স্বাধীনতার চেতনা বাস্তবায়ন! আমরা ন্যুনতমও তলিয়ে দেখি না, স্বাধীনতার সত্যিকার চেতনা থেকে আওয়ামী লীগ সরকার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করে।

দু'টো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গিয়ে আমি ব্যক্তিগত আগ্রহে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞেস করে দেখেছি প্রায় কেউই জানে না 'স্বাধীনতার চেতনা' বস্তুটা কী। এটা নিয়ে আস্ত একটা পোস্টই লিখেছিলাম বেশ কিছুদিন আগে (স্বাধীনতা দিবসঃ কী বলার কথা…কী বলছি!)। আমাদের প্রথম সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশের দু'টো অনুচ্ছেদে খুব চমৎকারভাবে লিখা আছে কোন চেতনা নিয়ে আমরা আমাদের স্বাধীন দেশটিকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম। অনুচ্ছেদ দু'টো হল (এটুকু বুঝতে বিরাট কোন 'সংবিধান বিশেষজ্ঞ' হবার দরকার নেই) –

"আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগনকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদ দিগকে প্রানোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল – জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গনতন্ত্র ও ধর্মনিরেপেক্ষতার সেই সকলআদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।"

"আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা – যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।"

এবার মিলিয়ে নিয়ে আমরা সহজেই বুঝতে পারি, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার মুখে যখন স্বাধীনতার চেতনার কথা বলে সেটা কত বড় ফালতু কথা। আওয়ামী লীগ তার লুটপাটের 'রাজনীতি'র স্বার্থে স্বাধীনতার চেতনার ধারক ও বাহক হবার গোয়েবলসীয় প্রোপাগান্ডা চালাবেই, এতে অবাক হই না মোটেও। কিন্তু এটা দেখে ভীষণ মন খারাপ হয়, যখন দেখি ডঃ জাফর ইকবাল এবং তাঁর মত আরো কিছু মানুষও মানুষকে এটাই বোঝানোর চেষ্টা করেন। এক মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার শর্তে তাঁরা আওয়ামী লিগকে যাচ্ছেতাই করার ছাড় দিয়েছেন। তাই জাফর স্যার আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ভীষণরকমভাবে নিশ্চুপ, আবার মাঝে মাঝে সাফাইও গান এই সরকারের নোংরামির (যেমন ৫ জানুয়ারির নির্বাচন)।

যে ছাত্রলীগের হাতে আজ তাঁর সহকর্মীরা পিটুনি খেলেন, হেনস্তা হলেন তাঁর স্ত্রী, সেই ছাত্রলীগের তাণ্ডবে এই দেশের প্রতিটি কোন জর্জরিত হয়েছে, আক্রান্ত হয়েছিল মায়ের জরায়ুতে থাকা শিশুও। বেশ কিছুদিন আগে ঘৃণ্য সংগঠন ছাত্র শিবিরকে নিয়ে লিখেছিলেন চমৎকার লিখা "তোমরা যারা শিবির কর"; কই বছরের পর ছাত্রলীগের তাণ্ডব দেখার পরও তিনি লিখেননি "তোমরা যারা লীগ কর"। নাকি তিনি মনে করেন ছাত্রলীগ এই সরকারের 'স্বাধীনতার চেতনা' বাস্তবায়নের সংগ্রামের সেনানী। মনে পড়লো টিভি ক্যামেরার সামনে বিশ্বজিৎকে যখন কুপিয়ে মেরে ফেলা হল, তখন তিনি লিখেছিলেন। ওটা ছিল এক ধরণের আবেগী লিখা, কিন্তু ওতে সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছিলেন মূল কারণকে।

ক্রমাগত চুপ করে থেকে থেকে এই রাষ্ট্রকে ফ্যাসিস্ট বানিয়ে তোলার বিরাট দায় আছে জাফর ইকবালদের। আর কে না জানে, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র তার পথে আসা সবাইকে ধ্বংস করে দেবেই। ন্যুনতম রাজনৈতিক জ্ঞান দিয়েই বোঝা যায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্ত ভিসি'রা সরকারের 'খাস লোক'; তাদের বিরুদ্ধে লাগাটা সহ্য করা হবে না। দেশে জারি থাকা বর্বর শাসনের তুলণায় এটা আসলে অতি তুচ্ছ একটা ঘটনা, কিন্তু এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, এই রাষ্ট্র কোন পর্যায়ের দানবে পরিণত হয়েছে!

আজ সকালে অনলাইন খবরে দেখলাম কালকের শিক্ষক পেটানোর অভিযোগে একজনকে আটক করা হয়েছে। জানি, এর সাথে হয়তো যুক্ত হবে আরো কিছু আইওয়াশ – কয়েকজনকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার, কয়েকজনকে ভার্সিটি থেকেও বহিষ্কার, বা উপাচার্যের পদত্যাগ/বরখাস্তও হয়ে যেতে পারে। অনুমান করি, এর পর জাফর স্যারের 'গলায় দড়ি দিয়ে মরার ইচ্ছে' আপাতত দূর হবে। কিন্তু আমি বাজি ধরে বলতে পারি, এরকম গলায় দড়ি দেবার ইচ্ছে তাঁর আবার হবেই, কারণ উনি মূল কারণ নিয়ে কথা তো বলছেনই না, বরং সেই কারণ তৈরি হবার, শক্তিশালী হবার পেছনে ইন্ধন যোগাচ্ছেন।

বয়সে আমার চাইতে অনেক সিনিয়র এবং আমার চাইতে অনেক বেশী জ্ঞানী জাফর স্যারের এটা বুঝতে তো সমস্যা হবার কথা নয় এমনকি এই 'ভয়ঙ্কর ভিলেইন' ছাত্রলীগও আসলে স্রেফ একটা উপসর্গ, রোগ নয়। মূল রোগ হল পচে গিয়ে উৎকট গন্ধ বেরোনো 'রাজনীতি'। তাঁর বিচারে স্বাধীনতার ধ্বজাধারী 'রাজনৈতিক' দলটিকে বহুদিন থেকেই আমি অন্তত কোনভাবেই রাজনৈতিক দল বলে সংজ্ঞায়িত করতে পারি না। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে লুটপাট করা যেসব দলের একমাত্র উদ্দেশ্য (আমাদের 'বড়' দুই দলের চরিত্র এই ক্ষেত্রে একেবারেই এক), সেসব দলকে আর যাই হোক রাজনৈতিক দল বলা যায় না। ব্লগার হত্যা নিয়ে রয়টার্সকে দেয়া বর্তমান ডাইনেস্টির রাজপুত্রের সাক্ষাতকারের পরও কি ওসব দলের উদ্দেশ্য নিয়ে জাফর স্যারের কোন সংশয় আছে?

দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আমরা সত্যিকার পথ প্রদর্শকের অভাবে ভুগছি, কেউ হালুয়া-রুটির লোভে, আর কেউ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ব্যস্ত থাকা সরকারকে না ঘাঁটানোর চিন্তায় চুপ করে আছেন। আর 'হক কথা' বলা হাতে গোনা কিছু মানুষকে তো মিডিয়ার সামনে আসতেই বাধা তৈরি করা হচ্ছে। তাই দেশটা ক্রমাগত ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

৪৩ বছর আগে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া, আর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার কারণে একটা দল একটা দেশ আর ১৬ কোটি মানুষকে নিয়ে ফাজলামো করতে পারে না – যতদিন জাফর স্যারের মত মানুষরা এই সত্য উচ্চারণ করবেন না, ততোদিন এভাবেই মাঝে মাঝে ওনার গলায় দড়ি দিয়ে মরতে ইচ্ছে হবে, আর এই ফাঁকে গোটা জাতির গলায় এর মধ্যেই পড়ে যাওয়া দড়িটা আরো চেপে বসবে।