আত্মহত্যার কি আছে কোন যৌক্তিক কারণ?

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 13 Oct 2011, 09:18 AM
Updated : 13 Oct 2011, 09:18 AM

ইদানিং আমাদের চারপাশে চলছে আত্মহত্যার মহামারী। এই আত্মহত্যার শিকার মূলত নারীরা। এইতো ৩ দিন আগেও হৃদিতা নামের এক কিশোরী আত্মহত্যা করলো। নানান কারনে আত্মহত্যার ঘটনাগুলো হয়। কিশোরীরা আত্মহত্যা করে ইভ টিজিং/যৌন হয়রানির শিকার হয়ে, বাবা-মায়ের বকুনি খেয়ে, পারিবারিক অশান্তি সহ্য করতে না পেরে, পরীক্ষায় ফেল করে, এমনকি আমি এমন একটা ঘটনার কথা জানি যেখানে ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া শিশু আত্মহত্যা করেছিল টিভি গেম না পেয়ে। তরুনীরা আত্মহত্যা করে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, প্রেম ভেঙ্গে গেলে, ধর্ষিত হয়ে দাম্পত্য কলহে, বা ডিভোর্সের কারনে। এই ভয়ঙ্কর ঘটনাও আমরা এই দেশে দেখেছি যে মা তার সন্তানসহ আত্মহত্যা করেছেন।

এসব আত্মহত্যার ঘটনা পরে পত্রিকায়, টিভিতে খবর হয়, টক শো তে বা আমাদের ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আলোচিত হয়। আমরা সবাই মিলে আলচনা করে বের করার চেষ্টা করি কি পরিস্থিতিতে ওই মানুষটা আত্মহত্যা করেছে, এবং আমরা সবাই মিলে দায়ী মানুষটাকে নিন্দা জানিয়ে আমাদের কর্তব্য শেষ করি। ভীষণ অবাক হয়ে খেয়াল করি, এই আলোচনায় কেউ এই প্রশ্ন তুলছে না যে, জীবনে যত খারাপ পরিস্থিতিই আসুক না কেন তার জন্য কি আত্মহত্যা করা যায়?

আসলেই কি আছে আত্মহত্যার কোন যৌক্তিক কারন? অন্তত একটা কারন নিয়ে পৃথিবীতে আলোচনা চলছে। সেটা হল, যদি এমন হয় যে কেউ কোন অসুস্থতায় ভুগছে যা থেকে তার সেরে ওঠার কোন সম্ভাবনা নেই এবং সে সেই অসুস্থতার কারনে ভীষন কষ্ট পাচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে ডাক্তারের সাহায্যে মৃত্যু বেছে নেয়ার অধিকার (ইউথ্যানাসিয়া) নিয়ে সারা পৃথিবীতে আলোচনা চলছে। আমি ব্যাক্তিগতভাবেও এই পরিস্থিতিতে স্বেচ্ছা মৃত্যুর পক্ষে। কিন্তু এটা ছাড়া কি আর কোন গ্রহনযোগ্য কারন আছে আত্মহত্যার? জীবন যতোই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠুক না কেন, জীবনে যত কষ্টই আসুক না কেন তার সমাধান কি হতে পারে আত্মহত্যা?

আসলে প্রতিটা আত্মহত্যার ঘটনার পর আমরা সবাই যেহেতু এটা দেখাতে উঠেপড়ে লাগি যে কত কষ্ট পেয়ে কোন মানুষ আত্মহত্যা করে, তাই যারা ছোটবেলা থেকে এই ধারনা নিয়ে বেড়ে ওঠে যে জীবনের কিছু সংকটময় পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা একটা সমাধান। মিডিয়াও অনেক ক্ষেত্রেই অনেকের ওপর দোষ চাপিয়ে আত্মহত্যা কে এক ধরনের যৌক্তিকতা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা কোন দিন বলতে চায় না কখনো, কোন পরিস্থিতিতেই আত্মহত্যা নয়। তারা কিন্তু এই সচেতনতা গড়ে তুলতে যায় না। মানুষের দুরবস্থা, বিপর্যয় আর নানা দুর্ঘটনার খবর বিক্রি করাই যাদের পেশা এবং ব্যবসায় তাদের কাছে এরকম প্রত্যাশা হয়তো বাড়াবাড়িই। তাই এগিয়ে আসতে হবে আমাদেরই।

প্রতিটি শিশুকে ছোটবেলা থেকেই চাপ সামলানোর শিক্ষা দেয়া উচিত, ধৈর্য ধরতে শেখানো উচিত। আজকের এই ভীষন রকম জটিল সমাজে নানা দিক থেকে চাপ আসতেই পারে। কোন পরিস্থিতিতেই কোন চাপেই যেন আমরা ভেঙ্গে না পড়ি এই শিক্ষা সবার দরকার। আত্মহত্যা কখনোই সমাধান হতে পারে না। আমরা নাগরিকরা এই ব্যাপারে নিজেরা উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠে সরকার এবং মিডিয়ার ওপর চাপ তৈরি করতে হবে যাতে সবাই এই মহামারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আমি অবশ্যই এটা বলছি না যে, যে সব অনাচারের কারনে এক জন মানুষ আত্মহত্যায় প্রলুব্ধ হয়, সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। সেগুলো তো দূর করতে হবেই।

দীর্ঘদিন সমাজে এরকম একটা প্রথা চালু থাকলে সেটা এক সময় জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ হয়ে যায়। জাপান এর চমৎকার একটা উদাহরন। সেই দেশে অতি তুচ্ছ কারনেও মানুষ আত্মহত্যা করে। পৃথিবীতে আত্মহত্যার হার জাপানেই সবচাইতে বেশী। আমরা এখনি সাবধান না হলে আমাদের জন্যও একি পরিনতি অপেক্ষা করছে।

শেষ করছি আত্মহত্যার বিরুদ্ধে অমর সাহিত্যিক আর্নেষ্ট হেমিংওয়ের একটা বিখ্যাত উক্তি দিয়ে (যদিও তিনি নিজেও আত্মহত্যা করেছিলেন) –

"যে কষ্টের কারনে তুমি এখন আত্মহত্যা করতে চাইছ, সেটা কেটে গেলে আবার তুমি দেখবে জীবনটা অনেক সুন্দর"।