অনুসন্ধান: আশুলিয়ার শ্রমিক নেতা আমিনুল খুন, ১২ই মার্চ বিএনপির মহাসমাবেশে..

আবু সুফিয়ান_অনুসন্ধানী প্রতিবেদক
Published : 9 June 2012, 09:40 AM
Updated : 9 June 2012, 09:40 AM

গত ৪ঠা এপ্রিল ২০১২ সন্ধ্যা আনুমানিক সাতটায় গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানার হিজলহাটি মৃধাপাড়া গ্রামের মৃত মফিজ উদ্দিন ও তসিরন বেগমের ছেলে মোঃ আমিনুল ইসলাম (৩৯) নিখোঁজ হন।

পরদিন (৫ই এপ্রিল) সকালে পৌনে আটটার দিকে ব্রাহ্মণ শাসন মহিলা মহাবিদ্যালয়ের প্রধান গেটের সামনের রাস্তায় পাওয়া যায় আমিনুলের লাশ।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিএনপির ১২ই মার্চ এর মহাসমাবেশে ১০ হাজার লোক নিয়ে যোগ দেয়ার ভয়ে ভীত হয়ে তাকে হত্যা করা হতে পারে। অভিযোগ করেছেন তার স্ত্রী ও সহকর্মীরা।

স্ত্রীর অভিযোগ আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা তার স্বামীকে অপহরণের পর নির্যাতন করে হত্যা করেছে।

নিহত আমিনুল ইসলামের স্ত্রী হোসনে আরা বেগম ফাহিমা (৩২) জানান, তাঁর স্বামী শ্রমিক সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কাস ফেডারেশন (বিসিডব্লিউএস) নেতা ছিলেন। এছাড়াও আমিনুল বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কাস সলিডারিটিতে সংগঠক হিসেবে চাকরী করতেন।

৪ঠা এপ্রিল, ২০১২ ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানার মধ্যগাজীর চট গ্রামের আবুল কালামের বাড়ীতে বিসিডব্লিউএস এর আঞ্চালিক কার্যালয়ে অফিস করেন। সন্ধ্যায় আমিনুল বাসায় না ফেরায় মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে তিনি তাঁর স্বামীর দুইটি মোবাইল ফোনই বন্ধ পান। এরপর তিনি আমিনুলের সহকর্মী লাবনী আক্তারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে আমিনুলের খোঁজ জানতে চান।

লাবনী আক্তার তাঁকে (আমিনুলের স্ত্রীকে) জানান, বিকেলের দিকে মোস্তাফিজুর রহমান নামে আমিনুলের এক বন্ধু অফিসে আসেন এবং আমিনুলকে রাতে একটি বিয়ে পড়ানোর জন্য অনুরোধ করেন। সন্ধ্যা আনুমানিক সাড়ে ছয়টায় তিনি (লাবনী আক্তার), আমিনুল ও মোস্তাফিজুর একই সঙ্গে অফিস থেকে বের হয়ে যান। মোস্তাফিজুর এবং আমিনুল একটি রিক্সায় চড়ে চলে যান বলে লাবনী আক্তার তাঁকে জানান।

ফাহিমা বিভিন্ন জায়গায় ও আত্মীয় স্বজনের বাসায় খোঁজ করেও তাঁর স্বামীকে আর পাননি। ৭ই এপ্রিল ২০১২, পত্রিকায় স্বামীর লাশ এর ছবি দেখেন তিনি।

ফাহিমা বিষয়টি বিসিডব্লিউএস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাবুল আখতারকে মোবাইল ফোনে জানান। বাবুল তখন ঘাটাইল থানায় যান এবং ফাহিমাকে জানান যে, পুলিশ আমিনুলের মৃতদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় গোরস্থানে দাফন করেছে।

৯ই এপ্রিল ২০১২, আদালতের অনুমতিতে বাবুল আখতারের সহযোগিতায় টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় গোরস্থান থেকে আমিনুলের লাশ তোলা হয় এবং লাশ গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরের হিজলহাটিতে আমিনুলের নিজের বাড়ীতে পুনরায় দাফন করা হয়।

তিনি অভিযোগ করেন, শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করার কারণে ২০১০ সালে পুলিশ সদস্যরা কয়েকবার তাঁর স্বামীকে ধরে নিয়ে যেয়ে নির্যাতন করে।

১২ই মার্চ ২০১২ তারিখে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মহাসমাবেশে আমিনুলের ১০,০০০ লোক পাঠানোর ব্যাপারে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে একটি গোপন খবর ছিল বলে তিনি শুনেছেন। যার কারণে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানার পুলিশ সদস্যরাও আমিনুলকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে এবং পরে ছেড়ে দেয়।

এছাড়া ১২ মার্চ ২০১২ সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরা সারাদিন আমিনুলকে নজরদারীতে রেখেছিল বলেও তিনি জানতে পারেন। আমিনুল নিখোঁজ হবার সময় থেকে তাঁর বন্ধু মোস্তাফিজুর রহমানকেও না পাওয়ায় তিনি ধারণা করেন, মোস্তফিজুর রহমানকে ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই তাঁর স্বামীকে অপহরণের পর নির্যাতন করে হত্যা করে লাশ ঘাটাইলে ফেলে গেছে।

আমিনুলের সহকর্মী লাবনী আক্তার জানান, ৪ঠা এপ্রিল ২০১২ তিনিসহ আমিনুল এবং মোস্তাফিজুর একই সঙ্গে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় আশুলিয়ার বিসিডব্লিউএস এর আঞ্চালিক কার্যালয় থেকে বাসায় যাবার উদ্দেশ্যে বের হন। বের হয়ে গেটের সামনে একটি পুলিশ ভ্যান দাঁড়ানো দেখে আমিনুল তাঁকে বলেন, আবারো কোন পুলিশি হয়রানিতে পড়তে হতে পারে। এরপর আমিনুল একটি রিকশায় চড়ে চলে যান।

বিসিডব্লিউএস এর নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার (৪৫) জানান, আমিনুল ২০০৬ সাল থেকে বিসিডব্লিউএস এর সঙ্গে কাজ করছিলেন এবং তিনি একজন ভাল সংগঠকও ছিলেন

তিনি আরো, ৪ঠা এপ্রিল ২০১২ এর আগে ২০০৬ সালে কয়েকবার এবং ২০১০ সালের ১৬ থেকে ১৮ই জুন ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটিলিজেন্স (এনএসআই) এর সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদের নামে আমিনুলকে ধরে নিয়ে যেয়ে নির্যাতন করেছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই আমিনুলকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে বলে তিনি মনে করেন।

বিসিডব্লিউএস ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাবুল আখতার (৪২) ২০০৬ ও ২০১০ সালে দুইবার পুলিশের সদস্যরা আমিনুলকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয়।

তিনি জানান, ৯ই মার্চ ২০১২ সকাল আনুমানিক ১১.৩০ টায় ঢাকা জেলার সাভার থানার শ্রীপুরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ অফিস-১ এর সদস্যরা বিসিডব্লিউএস এর আঞ্চলিক কার্যালয় আসে এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমিনুলকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তিনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ অফিস-১ এর শ্রীপুর কার্যালয়ে যান এবং আমিনুলকে ছাড়িয়ে নিতে চান। তখন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ অফিস-১ এর পরিচালক একটি মুচলেকায় স্বাক্ষর করে আমিনুলকে ছাড়িয়ে নিতে বলেন। তিনি দেখেন, মুচলেকায় লেখা আছে, ১২ মার্চ ২০১২ সকাল ৯.০০ টা থেকে বিকেল ৫.৩০ টা পর্যন্ত আমিনুল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের অফিস-১ এ থাকবে। সেই শর্তে তিনি আমিনুলকে ছাড়িয়ে আনেন।

১২ই মার্চ ২০১২ তারিখে বিএনপির মহাসমাবেশে করার জন্য আমিনুল নাকি ১০ হাজার লোক দেবে এমন একটি খবর এনএসআই এর সদস্যরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের অফিস-১ কে দিয়েছিল। যার ফলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ সদস্যরা আমিনুলকে ধরে নিয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ অফিস-১ সারাদিন আটক রেখে বিকেলে ছেড়ে দেয়।
আমিনুলকে কেন বারবার ধরে নিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে এ ব্যাপারে জানার জন্য বাবুল আখতার ১০ই এপ্রিল ২০১২ বিকেল আনুমানিক ৪.৩০ টায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ এর ইপিজেড শাখার সহকারী পরিচালক ফসিয়ার রহমানের সঙ্গে মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগ করেন। ফসিয়ার রহমান তাঁকে জানান, এনএসআই এর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ সদস্যরা আমিনুলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গ্রেপ্তার করেছিল। গ্রেপ্তারের বিস্তারিত জানার জন্য তাঁকে এনএসআই এর অতিরিক্ত পরিচালক, আমিনুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগ করতে বলেন। তিনি প্রায় ১০ মিনিট পর অর্থ্যাৎ বিকেল আনুমানিক ৪.৪০ টায় অতিরিক্ত পরিচালক, আমিনুল ইসলামের সঙ্গে শ্রমিক নেতা আমিনুলকে কেন বারবার গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তার কারণ জানতে চান। অতিরিক্ত পরিচালক আমিনুল ইসলাম তখন বাবুল আখতারকে এ ব্যাপারে কোন রকম তৎপরতা চালাতে নিষেধ করেই ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

৫ই এপ্রিল ২০১২ আমিনুলের অপহরণ এবং মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই জড়িত রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইলের অধিবাসী মোঃ লুৎফর রহমান (৩৮) জানান, তাঁর বাসা ব্রাহ্মণ শাসন মহিলা মহাবিদ্যালয়ের পেছনে। ৫ই এপ্রিল ২০১২ ভোর আনুমানিক ৫.৩০ টায় তিনি বাসা থেকে বের হয়ে মহাবিদ্যালয়ের গেট থেকে ১০ গজ সামনের রাস্তায় লোকজনের জটলা দেখতে পান। জটলার কাছে গিয়ে পায়জামা পরা একটি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। তিনি দেখেন, মৃতদেহের ডান হাঁটুর নিচে একটি কাপড় বাঁধা, যেখানে রক্ত জমাট বেঁধে ছিল এবং দুই পায়ের বুড়ো আঙ্গুল থেঁতলানো ছিল বলে তিনি জানান।

একই এলাকার অধিবাসী আব্দুল হান্নান (৪০) জানান, মৃতদেহের আশেপাশের মাটিতে তিনি জমাট বাঁধা রক্ত পড়ে থাকতে দেখেন এবং মাটিতে আঁচড়ের দাগ দেখতে পান।

আর একই এলাকার অধিবাসী এসআই শাহিন মিয়া জানান, মৃতদেহের ডান হাটুর নিচে একটি ছিদ্র ছিল। দুই পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দুইটি থেঁতলানো ছিল।

এএসপি ফসিয়ার রহমান, সহকারী পরিচালক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ-১, শ্রীপুর, সাভার, ঢাকা, বলেন, ১২ই মার্চ ২০১২ বিএনপির মহাসমাবেশে শ্রমিক নেতা আমিনুল বেশ কিছু শ্রমিক সরবরাহ করবেন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থার এমন একটি তথ্যের ভিত্তিতে ৯ই মার্চ ২০১২ সকাল আনুমানিক ৯.০০ টায় আমিনুলকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের অফিস-১ এ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ৯ই মার্চ ২০১২ বিকেল আনুমানিক ৫.০০ টায় বিসিডব্লিউএস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাবুল আখতার ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের অফিস-১ এ এসে আমিনুলকে সঠিকভাবে বুঝিয়া পাইলাম এমন একটি মুচলেকায় স্বাক্ষর করে আমিনুলকে নিয়ে চলে যান।

তিনি আরো জানান, ১২ই মার্চ ২০১২ আমিনুল নিজের নিরাপত্তার জন্য সকাল আনুমানিক ৯.০০ টায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের অফিস-১ এ আসেন এবং সারাদিন অবস্থান করে বিকেল আনুমানিক ৫.৩০ টায় তাঁর নিজ বাড়ীর উদ্দেশ্যে চলে যান।

ডাঃ মোঃ রফিকুল ইসলাম মিয়া, আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা, জেনারেল হাসপাতাল, টাঙ্গাইল, ময়নাতদন্তের সময় তিনি মৃতদেহের ডান হাঁটুর একটু নিচে একটি ছিদ্র দেখেন, ছিদ্রটি কোন ধারালো কিছু দিয়ে করা হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। দুই পায়ের বুড়ো আঙ্গুল থেঁতলানো ছিলো বলেও তিনি জানান। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণেই আমিনুলের মৃত্যু হয়েছে।

সূত্র:অধিকার