মায়ার টানে মায়াবী ঝরনায়

আলমগীর হোসাইন
Published : 6 July 2017, 07:20 PM
Updated : 6 July 2017, 07:20 PM

শাঁ শাঁ শব্দে পাহাড়ের বুক চিরে ঝরে পড়ছে স্বচ্ছ জলের ঝর্ণাধারা। পাথর ফেটে শিরশিরে সে শীতল জল প্রবল বেগে আছড়ে পড়ছে পাথর থেকে পাথরের গায় । কোমল জলে গা ভিজিয়ে সৌন্দর্যের পিয়াসা মেঠাচ্ছে সৌন্দর্য পিপাসু পর্যটকের দল। ঝর্নার গায়ে পাথুরে প্রাকৃতিক সিঁড়ি বেয়ে একেবারে চূড়ায় চড়ে দূরন্ত পর্যটকেরা দিচ্ছে আনন্দের হাতছানি, চলছে সেলফি, গ্রুপফি। মনে জেগেছে তাঁদের এভারেস্ট জয়ের আনন্দ তাই তো জয়উল্লাস পৌঁছে গেছে পাহাড়ের চূড়ায় । এভারেস্ট জয়ের সিকি ভাগ কষ্ট হয়তো এখানে নেই, তবু পাহাড়ি গাছের শিকড় ধরে, আর মস্ত বড় সব পাথর ডিঙ্গিয়ে এডভেঞ্চারময় পাহাড় জয় মোটেই কম আনন্দের নয়। আর এতো সব সৌন্দর্য আর মনভোলানো আনন্দের শিহরন যে স্থানকে ঘিরে, তার প্রতি তো পর্যটকদের মায়া বসারই কথা।

হ্যা! পর্যটকদের মায়ার নজর কেড়েছে বলেই হয়তো এ ঝরনার নাম হয়েছে মায়াবী ঝরনা । বলছি জাফলংয়ের মায়াবী ঝরনার কথা । মায়াবী ঝরনার সন্ধান পাওয়ার পূর্বে যারা জাফলং গিয়েছেন তাঁরা নিশ্চই এবার মাথায় হাত দিয়ে জিহ্বা কামড়ে দিয়ে বলবেন হায়  কি জিনিসটাই মিস করলাম! কিন্তু সমস্যা নেই, মায়াবী ঝরনা আছে আপনারই অপেক্ষায়।

পর্যটকদের বুকে টেনে নিতে প্রতিনিয়ত নতুন রূপে সাজে সিলেট। সিলেটের মাধবকুণ্ড, রাতারগুল, উৎলারপার, লালাখাল, জৈয়ন্তিয়া রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ, চা-বাগান, খাঁশিয়া পুঞ্জি, বিছনাকান্দি আর জাফলং জিরো পয়েন্টে এর মতোই সিলেটের প্রাকৃতিক বহুরূপী সাজের আরেক অলংকারই যেন জাফলংয়ের মায়াবী ঝরনা। ইতোমধ্যে জাফলংয়ের প্রেমে পড়ে অনেক প্রকৃতি প্রেমিক বারবার ছুটে গিয়েছেন সেখানে। আমি যে কতবার জাফলং গিয়েছি সেটা বেহিসাবী পর্যায়ের। অবশ্য আমার মতো অন্য সিলেটিদের কাছেও সেটা বেহিসাবি হওয়ারই কথা।

ঈদের তৃতীয় দিন সকালে হঠাৎ সাইদুল মামার ফোন, খইবা ফ্রি আছোনি? জাফলং গেলে তাড়াতাড়ি রেডি অউ! ঈদের দিন থেকেই জ্বরে জর্জরিত হয়ে বিছানায় শুয়েছিলাম। সাইদুল মামার ফোন পেয়ে আর প্রিয় জায়গা জাফলংয়ের কথা শুনে জ্বর  কোথায় যে পালিয়ে গেল বুঝতেই পারলামনা। প্রিয় মানুষদের ফোন পেলে বোধহয় এমনই হয়। মাত্র পনেরো-বিশ মিনিটে প্রস্তুতি সেরে নিলাম। প্রায় আধঘন্টার ভেতরে মামাদের নোয়া গাড়ি আমার বাড়ির সামনে হাজির। আমিসহ তখন যাত্রী দশ জন। অর্থাৎ নয় মামার সাথে আমি অনলি ওয়ানপিছ ভাগনা, নয় জনের মাঝে পাঁচজন মামা রাজধানী ঢাকা থেকে আগত। কথায় আছে মামা-ভাগনা যেখানে আপদ নাই সেখানে, আর সেখানে যদি একের জায়গায় মামার সংখ্যা হয় নয় তবে তো সব আপদের নয়-ছয় অবস্থা হবেই।

হয়েও ছিল তাই। প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে মায়াবী ঝর্ণার বরফঠাণ্ডা জলে গোসল করে জ্বর কোথায় আরো বেড়ে গিয়ে বিছানায় কাত করে দেবে, তা না হয়ে সেখানে উল্টো জ্বর পানির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল! তবে বিকেলের দিকে সে জ্বর কিন্তু মামাদের দিকে ধাওয়া করেছিল। সে যাই হোক, সব কিছু ছাপিয়ে সেই যাত্রা আর আনন্দ আড্ডা যেন এক মধুর স্মৃতি হয়েই স্মৃতির এ্যালবামে যোগ হয়েছে । প্রিয় জায়গায় প্রিয় মানুষদের সাথে যে আড্ডা জমে সে আড্ডার স্মৃতিগুলো আসলেই বড় মধুর ।

ঢাকা বা অন্য শহর হতে যারা সিলেট আসবেন তাঁরা কদমতলী বাসস্ট্যাণ্ডে নেমেই ধরতে পারেন জাফলংয়ের বাস, কিংবা ওসমানী শিশু পার্কের সামনে থেকে জাফলংগামী লেগুনা। গাড়িতে আধঘন্টা চড়েই যে কারো ভ্রমণ ক্লান্তি মিশে যাবে প্রকৃতির বুকে, যখন শহুরে সব দৃশ্য হারিয়ে যেতে থাকবে প্রকৃতির অপরূপ লীলায়। গাড়ি থেকে বসে বাহিরের সব দৃশ্যতে ডুবে যেতে থাকবেন ভ্রমণরত পর্যটক। জাফলং যাওয়ার মূল সড়ক সিলেট তামাবিল সড়ক। ঘটেরচটির জৈন্তা গেইট পেরিয়ে ৫-৭ মিনিটের মাথায় চিকনাগুল বাজার পেরিয়েই পর্যটকের চোখ আবিস্কার করবে দু-ধারে সারিসারি চায়ের বাগান। প্রতিদিন সকালে যে চা না হলে বাঙালির চলেই না সে চায়ের বাগান পর্যটক মনে একটা মৃদৃ ধাক্কাতো দেবেই। গাড়ি এখানে থামাবে না, ছুটে যাবে সম্মুখে। তবু নাছোড়বান্দা পর্যটক, কিংবা রিজার্ভ গাড়ি হলে নেমে কয়টা ছবিতো তোলাই যায় ।

চিকনাগুল পেরিয়ে গেলেই হরিপুরের বিস্তির্ণ হাওরের বুক চিরে বাতাসের সাথে দোল খেয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলবে আপনার গাড়ি, সারি সারি গাছ আপনাকে জানাবে সাদর সম্ভাসন । সারিঘাট বাজারে ঢুকতেই স্বাগতম জানাবে নীলাভ সারি নদীর হাল্কা হাতছানি। গাড়ি চলতে চলতে মনে হবে অল্প দূরেই মেঘালয় পাহাড়। কিন্তু পাহাড় তবু দেয়না ধরা। গাড়ি চলছেই। কবে সে পাহাড়ের নাগাল পাওয়া যাবে? সে উত্তেজনায় ক্রমশ উত্তেজিত হয় মন। রাস্তার মাঝ বরাবর হঠাৎ দাঁড়িয়ে যেন পর্যটকদের মনে ভাবনার শিহরন ঢেলে দেয় জৈয়ন্তীয়া রানী ইরাদেবীর বিশ্রামাগার। জৈন্তাপুর বাজার, শ্রীপুর চা বাগান, তামাবিলে কয়লার কালো কালো স্তুপ আর মেঘালয় পাহাড়ে মেঘের ওড়াওড়ি দেখতে দেখতে প্রায় দেড়-দুই ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে কখন যে জাফলং মামার দোকান এসে পৌছাবেন টেরই পাবেন না। মামার দোকান থেকে ডান দিকে মাত্র ২০ মিনিটি হাঁটলেই জিরো পয়েন্ট।

জাফলংয়ে কেউ যদি শুধু মায়াবী ঝরনা দেখতে যায় তবে বাকি সব অতি বোনাস। কেন না সৌন্দর্যের হিরো, জিরো পয়েন্ট বরাবরই জাফলং আসাকে সার্থক করে তোলে। ডাউকির ঝুলন্ত ব্রিজ, আর তাঁর নিচে দিয়ে বাংলাদেশ অভিমুখে ছুটে আসা আয়নার মতো ঝকঝকে স্বচ্ছ জলে শরীরের সাথে যেন ভিজে যায় মন। জিরো পয়েন্ট থেকে ১০ টাকায় নৌকা পাড়ি দিয়ে তপ্ত বালুর উপর দিয়ে ১৫ মিনিট হাঁটলেই চোখের সামনে ধরা খাবে চোঁখ ধাঁধানো সেই মায়াবী ঝর্ণা।

পাহাড়ের একদম ওপর থেকে শুরু হওয়া জলপ্রপাতের বড় পাথরের কারণে প্রথমে ভাগ হয়ে গেছে দুই ভাগে। দুই ভাগ থেকে চার ভাগে। এভাবে বিভিন্ন খণ্ডে ভাগ হয়ে নিচে নেমেছে তীব্র সুন্দর ঝর্ণার মধ্য দিয়ে। নিচের সেই ছোট ঝর্ণায়ও একসঙ্গে চার-পাঁচজন দাঁড়িয়ে গোসল করা যায়। এ এক অপূর্ব দৃশ্য। বড় বড় পাথর এমনভাবে সাজানো যেন মনে হয় সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে একেবারে এক ধামাকাতেই পাহাড়ের ওপরে ঝরনাটার কাছে চলে যায় যে কেউ । শহুরে খোলস ছেড়ে কিংবা কর্মজীবনের একগুয়েমিতা আর ক্লান্তিকে সাময়িক অবসান দিয়ে একদণ্ড শান্তিতে ডুবে যেতে প্রকৃতির মহানুভবতার কাছে আত্মসমর্পণের এ সুযোগ যেন দু-হাতে লুফে নেয় সবাই।

ঝরনাটি সম্পূর্ণ পাথুরে হওয়ায় আছে পা পিছলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা , সতর্ক না হলে যেকোনো মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের দূর্ঘটনা। তাই উপরে উঠা বা নামার সময় পর্যটক সেদিকে অবশ্যই দিতে হবে বিশেষ খেয়াল। না হলে বেখেয়ালি মনের সব আনন্দ নিমিষে বেদনার কুয়াশায় মিলিয়ে যেতে পারে। একটু সতর্ক হয়ে ঝরনার দ্রুত গতির জলে গা ভিজিয়ে একমুঠো স্বপ্ন ছোঁয়ার মতো আনন্দে শিহরিত হোক আমার মতো শত-সহস্র পর্যটক মন, এটাই আমার প্রত্যাশা । জানি মায়াবী ঝর্নার মায়ায় পড়ে একটু অবসরে যে কেউ বারবার ছুটে যেতে চাইবে অপলক সৌন্দর্যের প্রকৃতির অলংকার মায়াবী ঝর্নায় আর অকৃপণ মায়াবী ঝরনাও পর্যটকদের জন্য দু-হাত বাড়িয়ে সর্বদা অপেক্ষায় আছে মায়া ছড়িয়ে দিতে সর্বদা সকল প্রাণে ।