ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ছাত্র রাজনীতি এবং বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট

এনামুল হক
Published : 27 June 2015, 07:15 PM
Updated : 27 June 2015, 07:15 PM

ফেইসবুকে অনলাইন নিউজ পোর্টালে এক বন্ধু দেখলাম শেয়ার করেছেন এক উঠতি নেতার খবর, যিনি পঞ্চম শ্রেণী পাশ এবং মোটর মেকানিক… যিনি কিনা আগামীতে একটি ছাত্র সংঘটনের সম্ভাব্য সভাপতি। আমি এতে কোনো অসুবিধা দেখি না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এইসবই চলে আসছে। কোনো ছাত্র সংঘটন যদি নীতিমালা বহির্ভূত এইসব ব্যাপারে প্রশ্রয় দেয় সেটা তাদের সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যাপার মনে করি। আমি ধরে লই, এমন নেতার আসলেই তাদের দরকার।

কিছু লিখতে বসলেই নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলে আপনাদের বরাবরই বিরক্ত করি। এবারেও করছি। রাজনৈতিক ভাবে আমি একটি মতাদর্শ সমর্থন করি। তবে তা শুধু মাত্র সমর্থনের পর্যায়েই থাকে। ২০০৮ সালে নির্বাচনের পূর্ব মূহুর্তে নিজের মতাদর্শের পক্ষে জনসংযোগ করতে বের হয়েছিলাম। সমর্থিত মতাদর্শের একটি কট্টরপন্থী পরিবারে জন্ম বিধায় নির্বাচনে জনসংযোগের অভিজ্ঞতা আমার ৯১ এবং ৯৬সালের নির্বাচনেও ছিলো (২০০১-এ দেশের বাইরে ছিলাম)। এ প্রেক্ষিতে বলা চলে আমার মতাদর্শের সিলেটের নেতৃত্ব স্থানীয় সকল নেতার সাথে যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক আছে এবং তারা আমায় খুবই স্নেহ করেন। নিজের ঢোল না বাজিয়ে মূল প্রসঙ্গে আসি, ২০০৮ এ পাড়ায় পাড়ায় জনসংযোগ এবং নির্বাচনী মিটিং এ যাওয়া এবং নেতাদের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা দেখে অনেকেই মনে করেছিলেন আমি হয়তো মাঠ পর্যায়ের রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছি। যদিও ব্যাপারটা কখনোই হবার নয়। নির্বাচন শেষ হবার পর পরিচিত একটি ছেলে ২০-২৫জন ছেলে নিয়ে আমার বাসায় এলো। নিজেদের ছাত্র দাবী করে তার প্রস্তাব আমার সাথে রাজনীতি করবে। তার ক্ষমতা সম্পর্কে আমাকে ধারণা দিলো, তার এক ফোনে এক ঘণ্টার ভিতরে শহরের যেকোনো জায়গায় ৫০জন ছেলে জড়ো হবে। আমি খুবই বিনয়ের সাথে বললাম, ভাই আমি তো মাঠ পর্যায়ে রাজনীতি কোনো দিনই করবো না। তাছাড়া তোমার কথায় বুঝতে পারছি, তুমি গ্রুপিং এর রাজনীতির কথা বলছো, এই ধরণের রাজনীতির গুন, সক্ষমতা কিংবা দক্ষতা কোনোটাই আমার নেই। যা আছে তা পুরোটাই তিক্ত অভিজ্ঞতা। (আমার পরিচিত যারা তারা জানেন, কি ধরণের দুঃসহ সময়ের ভিতর দিয়ে আমি এবং আমার পরিবার গেছে, যারা জানেন না তাদের অন্য কোনোদিন জানাবো)। সেই ছেলেটি সেদিন নিরাশ হয়ে চলে গিয়েছিলো। ছেলেটিকে আমি একেবারেই প্রশ্রয় দিতে চাইনি কারণ তাকে আমি চিনি, কবে স্কুলের বারান্দায় গিয়েছিলো তা হয়তো নিজেই ভুলে গেছে, ছিনতাই, রাহাজানি, মারামারি, জমি দখল হেন কুকর্ম নাই যে করে না। এখনও রাস্তায় প্রায়ই মাঝে মধ্যে দেখা হয়, আমি দেখেও না দেখার ভান করে চলার চেষ্টা করি।

ছাত্র সংঘটনের কমিটি হবে একরাতে ১০-১২জন ছেলে এলো। তাদের দাবি তাদের ছাত্র সংঘটনের কমিটিতে আনতে হবে। আমি নিজেও জানতাম না আমার এহেন ক্ষমতা আছে!!! আমি ঐদিনও বিনয়ের সাথে বলেছি, আমি তো কোনো ছাত্র সংঘটন করি না, ছাত্র নেতাদের সাথে আমার যোগাযোগও নাই। রাজনৈতিক কোনো সভায়ও যাই না (ততদিনে আমি সরকারি চাকরি করি) । আমার এই ক্ষমতা নেই তাদের জানিয়ে দিলাম। সিলেটের শ্রদ্ধেয় কয়েকজন নেতার নাম নিয়ে তারা বার বার অনুরোধ করলো আমি যেনো নেতাদের ফোন করে একটু সুপারিশ করি। তখন আমি একটু কৌশলের আশ্রয় নিলাম, তাদের বললাম, এখানে যারা এসেছো তাদের প্রায় সকলকেই আমি চিনি, দু-একজন বাদে তোমরা কেউই ছাত্র না। আমার জানামতে এই-দুই একজনও লেখাপড়াতে নিয়মিত না। কলেজের খাতায় নাম আছে কি না নিজেও জানো না। তোমরা আমাকে চেনো, আমি এমন কারো জন্য কোনো সুপারিশ করবো না যারা ছাত্র না। যার কাছে সুপারিশ করবো, তিনি আমায় প্রশ্ন করে লজ্জা দেবেন। সিলেট শহর ছোট কে কি, কে কি করেন তা নেতাদের নখর দর্পে। তাছাড়া যাচাই বাছাইয়ে তোমরা অযোগ্যও বিবেচিত হতে পারো একই কারণে। তোমরা আমায় ক্ষমা করো।

তখন তারা আমায় অদ্ভুত কথা শুনিয়েছিলো, তাদের এক সপ্তাহের সময় দিলে নাকি তারা কলেজে ভর্তি দেখিয়ে দেবে। এতে আমার সুপারিশ করতে কোনো অসুবিধা হবে না। আমি অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার কাছে সুবিধা করতে না পেরে তারা চলে গিয়েছিলো। সেদিন জানলাম, ছাত্র সংঘটন করার জন্যই অনেকেই ছাত্র সেজে বসে আছেন। জাতি এমন ছাত্র নেতাদের কাছ থেকে কি পাচ্ছে আর কি পাবে তা তো আমরা দিব্য চোখেই দেখতে পারছি।

আমি যে কখনো কারো জন্য সুপারিশ করিনি বললে মিথ্যে বলা হবে। পাড়ার ইন্টারমিডিয়েটে পড়ুয়া একটি ছেলে জানতাম যে সাহসী, ভালো বক্তৃতা দেয়, ভালো পড়ালেখা করে, রাজনীতিও রাজনৈতিক ইতিহাসেও তার বেশ দখল। ইচ্ছে থাকলেও সে কখনো আমাকে অনুরোধ করেনি। আমি নিজ থেকেই পরিচিত একজন বড় নেতাকে তার সম্পর্কে সুপারিশ করেছিলাম। ছেলেটি তখন ইন্টারমিডিয়েট -এ ভালো রেজাল্ট করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কমিটি যখন ঘোষণা হলো তখন দেখি তার নাম নেই। নেতাকে ফোন দিয়ে কারণ জিজ্ঞাস করাতে জানতে পারলাম, ছেলেটি অনেকের দৃষ্টিতে একেবারেই নাবালক, একটু বেশি পড়ুয়া টাইপের এবং মাঠের রাজনীতিতে টিকবে না। আরও সময় যাক, সে আমাদের নজরে আছে, ভবিষ্যতে সময় হলে তাকে কমিটিতে নেয়া হবে। ছেলেটির আরও কিছু অযোগ্যতা ছিলো যা নেতা সেদিন আমায় বলেননি, তা হলো, সে মারামারি কোপা-কোপিতে একেবারেই অচল, অস্ত্রবাজি প্রচণ্ড ভয় পায়, জোর করেও কখনো কোনো টেন্ডার-বাজিতে নেয়া যায় না। মাঠের রাজনীতিতে এমন ছেলে সুবিধাবাদী ভীতু টাইপের। অথবা এও হতে আমার সুপারিশের ততটা শক্তি বা ক্ষমতা কোনোটাই ছিলো না।

যাই হোক, ভাগ্যিস সেদিন সে ছেলেটির নাম ঐ ছাত্র সংঘটনের কমিটিতে আসেনি। কারণ এর কিছু দিন পর ছেলেটি সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞানও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পায়। বর্তমানে আমি মাঝে মধ্যে তার খোঁজ খবর নেই, ছেলেটা ভাল আছে, লেখাপড়াও ভালো করছে। নেতাদের ধন্যবাদ দেই তাকে অযোগ্য ঘোষণার জন্য, মাঠের বর্তমান ছাত্র রাজনীতিতে অযোগ্য বলেই হয়তো জীবনে অনেক দূর যাবে।

শ্রদ্ধেয় নেতাদের সাথে একই সভায় বক্তৃতা দিতে দেখি, মাদক ব্যবসায়ী, চিহ্নিত ছিনতাইকারী, খুনি, মটর সাইকেল কিংবা গাড়ী চুর, দখলবাজ সহ অসৎ মধ্যম এবং উঠতি নেতাদের। পত্রিকায় যখন ছবি দেখি বা তাদের নাম পড়ি তখন আমার প্রচণ্ড খারাপ লাগে, লজ্জা লাগে… প্রিয় নেতাদের অনুভূতি কী তা আমার জানার খুবই ইচ্ছা করে।

(কলামটি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লিখিত। কাউকে আঘাত কিংবা অসম্মান করার জন্য নয়। কেউ যদি স্ট্যাটাসটি পড়ে দুঃখ পান বা অসম্মানবোধ করেন তবে নিজ গুনে ক্ষমা করে দেবেন। কাউকে অসম্মান করার ইচ্ছা আমার কোনো কালেও ছিলো না, এখনো নাই)