৪৮ ঘণ্টা: রিসা, সাগর-রুনি হত্যা আর খুনির জাতপাত

আনা নাসরীন
Published : 31 August 2016, 07:22 PM
Updated : 31 August 2016, 07:22 PM

'৪৮ ঘণ্টা' কথাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে লিখিত থাকবে স্বর্ণাক্ষরে – সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ওই সময়ের মধ্যে খুনিদেরকে ধরা হবে বলে ঘোষণা করেছিলেন। এরপর ঘন্টার হিসাব দিন পেরিয়ে মাসে, মাস পেরিয়ে বছরে, আর এখন সেটা রওয়ানা হয়েছে যুগের পথে।

"৪৮ ঘন্টা"র আরেকটি ঘটনা ঘটলো বাংলাদেশে; এবার অবশ্য সফলতার ইতিহাস। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী রিসা খুন হবার পর শিক্ষার্থীরা যখন কাকরাইল মোড় অবরোধ করে খুনিকে গ্রেফতারের দাবী জানাচ্ছিল, তখন পুলিশের মধ্যম পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা অভিযুক্ত খুনীকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে গ্রেফতারের আশ্বাস দেন। পুলিশ বাহিনী তার কথা রেখেছে – প্রায় এই সময়ের মধ্যেই আটক করা গেছে রিসার অভিযুক্ত খুনীকে।

আশা করা যায় দ্রুতই তাকে বিচার বিভাগের হাতে সোপর্দ করা হবে। কিংবা পুলিশের মনে হতেও পারে দিনে-দুপুরে কাকরাইলের মতো শহরের প্রাণকেন্দ্রে যে মানুষটা একটা মেয়েকে খুন করে ফেলতে পারে, সে তো ভীষণ দুর্ধর্ষ অপরাধী। তার কাছে অনেক অস্ত্র-শস্ত্র থাকতে পারে, থাকতে পারে অনেক দুর্ধর্ষ সাঙ্গপাঙ্গ। তাই কোন গভীর রাতে পুলিশের ইচ্ছে হতে পারে তাকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে যেতে। সেই স্থানে পৌঁছলে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকে সাঙ্গপাঙ্গরা পুলিশকে দেখেই গুলি করতে পারে, পুলিশও নিশ্চয়ই চালাবে পাল্টা গুলি। এর সেই গোলাগুলির মধ্যে পড়ে….

একটা প্রশ্ন অনিবার্যভাবেই আসে – দু'টো "৪৮ ঘন্টা"র মধ্যে এতো ভীন্নতা কেন? এখানেই এসে যায় অভিযুক্ত খুনীদের জাত-পাতের কথা। রিসার মায়ের বর্ণনা মতো রিসার অভিযুক্ত খুনী দর্জির দোকানের একজন কর্মচারী, মানে সমাজের অর্থনৈতিক শ্রেণীর নীচের দিকেই তার অবস্থান। এরকম প্রান্তিক অবস্থানে থাকা মানুষ 'ন্যায়বিচার' টের পাবার সম্ভাবনা অনেক বেশি তাদের তুলণায় যারা সমাজের ক্ষমতাশালী অংশ।

সাগর-রুনি হত্যার অনেক বিস্তারিত তথ্য আমরা পাইনি, কিন্তু অনেক সংবাদ মাধ্যমে তখন এসেছে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যিনি বা যারা ছিলেন তারা ছিলেন রাষ্ট্রের সবচাইতে প্রভাবশালী মানুষদের অন্তর্গত। তাই "৪৮ ঘন্টা" ফুরোয় না বহু বছরেও; ফুরোবে না ৪৮ বছরেও।

আলোচিত তনু হত্যাকাণ্ড এর ক্ষত্রেও তো তনুর মা দুইজন সন্দেহভাজনের নাম স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন, ধরা হয়নি তো তাদের। নারায়ণগঞ্জের ত্বকী হত্যার বিচারে আমরা কী দেখেছি? খুনের দায়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে টাঙ্গাইলের এমপি রানা সংসদ সদস্যের পদ রক্ষা করার জন্য সংসদ ভবনের মতো সংরক্ষিত এলাকায় গিয়ে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে এসেছেন, কিন্তু তাকে নাকি কেউ দেখেনি! এই তো সেদিন, সারা দেশবাসী ভিডিওতে দেখলো একজন শিক্ষককে কান ধরে উঠবস করিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের সাংসদ সেলিম ওসমান, কিন্তু আদালতে দাখিলকৃত অভিযোগনামায় পুলিশ বলেছে ওই ঘটনায় কারো দায় নেই, ওটা ঘটেছে "পরিস্থিতির কারণে"। এরকম উদাহরণ ভুরি ভুরি দেয়া যায়, তাই আর বাড়াচ্ছি না।

রিসা হত্যার সাথে বাঁকি ঘটনাগুলোর তুলণা করলে এটা স্পষ্ট না হবার কোন কারণ নেই, আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা অপরাধীর, খুনীর বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে জাত-পাত বিবেচনা করে। "আইনের হাত অনেক লম্বা" কথাটা খুব শোনা যায় চারদিকে। কথাটা আংশিক সত্য, এটা সত্য কেবল সমাজের 'নীচুজাত' এর বেলায়ই; সমাজের 'উঁচুজাত' এর বেলায় আইনের হাত খুব ছোট – একের পর এক ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এটা।

শেষ করছি হুমায়ূন আজাদকে ধার করে, "আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম?"