জাতীয় ঈদগাহ: গরীব রাষ্ট্রের ’ঘোড়ারোগ’

আনা নাসরীন
Published : 12 Sept 2016, 02:46 PM
Updated : 12 Sept 2016, 02:46 PM

কাল ঈদ, কাল আমরা টিভি'র রিপোর্টে দেখবো জাতীয় ঈদগাহ থেকে মুসল্লিরা নামাজ পড়ে বের হচ্ছে। প্রতিবার এই রিপোর্ট দেখলেও আমরা কি জানি, এই একবার নামাজ পড়ার জন্য জাতীয় ঈদগাহ প্রস্তুত করতে খরচ হয় ৭৫ লক্ষ টাকা! (বিস্তারিত পড়ুন)। মানে প্রতি বছরের দুই ঈদের নামাজ পড়ার জন্য এই ঈদগাহে এই রাষ্ট্র খরচ করে দেড় কোটি টাকা। এই টাকাটা খরচ হয় মূলত প্রতিকূল আবহাওয়ায় নামাজ পড়ার জন্য বৃষ্টিরোধক ছাউনি সহ ঈদগাহকে প্রস্তুত করতে, যেটা ধর্মীয় দৃষ্টিতেও অপ্রয়োজনীয়। অনুকূল আবহাওয়ায় খোলা ঈদগাহে নামাজ হতেই পারে, কিন্তু এই বিপুল ব্যয় করা নিয়ে কিছু কথা বলার আছে। (আগ্রহীরা ধর্মীয় রেফারেন্স এর ভিত্তিতে আলোচনা মন্তব্যে দেখুন)।

এই ঈদগাহে সাকুল্যে লাখখানেক মানুষ নামাজ পড়তে পারে, যেটা দুই কোটি জনসংখ্যার একটা শহরের জন্য কিছুই না। এই ঈদগাহে নামাজ না হলেও এই শহরের মানুষ নির্বিঘ্নেই ঈদের নামাজ পড়তে পারতেন – এই শহর যেমন রিকশার শহর, তেমনি মসজিদেরও; অসংখ্য মসজিদ আছে এই শহরে। ঈদগাহে নামাজ পড়া ওই এক লক্ষ মানুষ খুব সহজেই নামাজ পড়ে ফেলতে পারতেন তাঁদের আশপাশের মসজিদেই। যারা বড় জামাত চান, তাদের জন্য তো আছেই আমাদের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, যেটি পৃথিবীর দশম বৃহত্তম মসজিদ। আর এতে একবারেই নামাজ আদায় করতে পারেন ৪০ হাজারের বেশি মুসল্লি। মনের মধ্যে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাওয়া কি স্বাভাবিক না, কেন আমাদের রাষ্ট্র এই পরিমাণ টাকা খরচ করে? প্রতিকূল আবহাওয়াও এখানে নামাজ পড়া আমাদের কি বাড়তি কিছু দেয়, যেটা বিদ্যমান মসজিদগুলোতে পড়লে পাওয়া যেত না? আমি তো দেখি না। প্রতিকূল আবহাওয়ায় এখানে নামাজ পড়ার কোন দরকার ধর্মীয় দৃষ্টিতেই নেই।

এখানে কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, বছরে দেড় কোটি টাকা ব্যয় নিয়ে এত কথা কেন, যখন আমাদের "সামর্থ্যবান" সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে নানা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে? ব্যাপারটা বুঝে নেই একটা ছোট উদাহরণ দিয়ে। আমার যদি কয়েকটি জামা থাকে তাহলে আমি এরপর আবার জামা কিনলে সেটাকে "বাড়তি" (ভিন্ন পয়েন্ট অব ভিউ থেকে অপচয়) বলাই যায়, কারণ আমার নতুন জামাটিও আদতে আমার আগের জামাগুলোর কাজই করবে। কিন্তু জামার চাইতে অনেক বেশি দাম দিয়ে আমি একটা ক্যামেরা কিনলে সেটাকে "বাড়তি" বলা যাবে না, যেহেতু ক্যামেরা আমাকে একেবারেই ভিন্ন একটা কাজ করে দেবে যেটা অসংখ্য জামা করে দেবে না।

এই কারণেই এইতো সেদিন পত্রিকায় যখন খবর আসলো বাংলাদেশ ১৪০০ কোটি টাকায় নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে যাচ্ছে তখন সেটা নিয়ে ঈদগাহ এর মতো প্রশ্ন মাথায় আসেনি। তবে আমাদের একটি স্যাটেলাইট যদি এর মধ্যেই থাকতো, আর সেটা যদি খুব ভালোভাবেই আমাদের যাবতীয় কাজ করে দিতে পারতো, তাহলে এরপর আরেকটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ নিয়ে অপচয়ের প্রশ্ন আসতো অবশ্যই।

কয়েকদিন আগেই প্রধানমন্ত্রী ১০ টাকায় চাল বিক্রয় কার্যক্রমের উদ্বোধন করলেন। ঠিকঠাকভাবে সত্যিকার দুঃস্থ মানুষে কাছে এই চাল পৌঁছে দেয়া গেলে নিঃসন্দেহে এটা একটা সুন্দর পদক্ষেপ। যে দেশে ১০ টাকায় চাল পেয়ে কৃতার্থ হবার মতো অসংখ্য মানুষ আছে, যে দেশে ১০ টাকায় চাল বিক্রি করে সরকার বাহবা নেয়, সেই দেশ অর্থনৈতিকভাবে কেমন সেটা বলাই বাহুল্য।

আমাদের দেশের কমপক্ষে সাড়ে চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে অবস্থান করে। এটাও মনে রাখবো, যে মানদণ্ডে দারিদ্র্য পরিমাপ করা হয় সেটাও ভীষণই তর্কসাপেক্ষ – মানে দারিদ্র্যসীমার ওপরের অনেক মানুষও প্রকৃত অর্থে দরিদ্র। প্রশ্ন হতেই পারে, বছরে "মাত্র" দেড় কোটি টাকা বাঁচিয়ে অসংখ্য দরিদ্র মানুষের জন্য আমরা আর কী ই বা করতে পারি?

জানি, তেমন কিছু হবে না এতে। কিন্তু এতে এটা প্রমাণিত হতো এই গরীব রাষ্ট্র তার ২৬ শতাংশ মানুষকে দরিদ্র রেখে অন্তত কোন অপচয় করে না; এই গরীব রাষ্ট্রের অন্তত কোন "ঘোড়ারোগ" নেই। কিন্তু না, এটা হচ্ছেই বছরের পর বছর, অনুমান করি চলবে সামনের বছরগুলোতেও, বাজেট বাড়বে নিশ্চয়ই আরও – সামনের বছরগুলোতেও এই রাষ্ট্র প্রমাণ করে যাবে 'গরীবের ঘোড়ারোগ' প্রবচনটি বাংলায় কেন আছে।