বিজয় দিবস: আমার চোখে অপ্রাপ্তির ‘ঠুলি’, প্রকৃত বিজয় তো দেখি না!

আনা নাসরীন
Published : 15 Dec 2016, 07:20 PM
Updated : 15 Dec 2016, 07:20 PM

আজকের পাকিস্তান দেখলে ভীষণভাবে শিউরে উঠি, আমরা একদিন ছিলাম এই ভয়ঙ্কর দেশটার অংশ! তাই '৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর আমরা যে যুদ্ধ বিজয় করেছিলাম, সেটা যে কতো বড় অর্জন ছিলো, সেটা বর্তমান পাকিস্তান এর সাথে আমাদের তুলনা করলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। এই তুলনার সুখের অংশ এটুকুই; ওদিকে এই তুলণা আমাদের ভয়ঙ্কর ক্ষতিও করে চলেছে নিঃসন্দেহে।

১৬ই ডিসেম্বর একটা সশস্ত্র যুদ্ধের সমাপ্তি হয়েছে, যাতে আমরা জয়ী হয়েছিলাম; আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের যুদ্ধটা তো স্রেফ আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিলো না! আমাদের যুদ্ধটা তো ছিলো 'মুক্তিযুদ্ধ'। তাই ১৬ ডিসেম্বরের সশস্ত্র যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারা ছিলো মুক্তি অর্জনের পথে একটা পদক্ষেপ মাত্র। আমরা তখন অন্তত স্বপ্ন দেখেছিলাম আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা গেলে আমরা আমাদের স্বপ্নের মুক্তি অর্জনের জন্য কাজ করে যেতে পারবো, যেটা পাকিস্তান থাকাকালে সম্ভব ছিলো না। কিন্তু আজ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরের বাংলাদেশ দেখে কি মনে হয় না, আমরা পাকিস্তান থেকে বিযুক্ত হয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার আনন্দে বুঁদ হয়ে থেকে ভুলেই গেছি আমাদের আসল সংগ্রামের কথা?

পরবর্তী আলোচনায় যাবার আগে আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের একটা খুব উল্লেখযোগ্য অংশ পড়ে নেয়া যাক। কোন পরিস্থিতিতে আমরা স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছি, সেটা বিস্তারিত বর্ণনার পর আমরা বলেছিলাম – "সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারষ্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি" (বিস্তারিত পড়ুন)।

হ্যাঁ, সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার সংকল্পে আমরা এই দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছিলাম।

আজ বিজয়ের ৪৫ বছরে এসে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসহ আরও কিছু ক্ষেত্রে অর্জন দেখতেই পারি। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্যের পরিমাণ বাড়ছে প্রতিদিন। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৪ অনুযায়ী, ধনী ১০ শতাংশ মানুষের দখলে দেশের মোট সম্পদের ৩৬ শতাংশ। বিপরীতে সবচেয়ে গরিব ১০ ভাগের হাতে সম্পত্তি রয়েছে মাত্র ২ শতাংশ (বিস্তারিত পড়ুন)। একদিকে আমরা মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির প্রচারণা করি, কিন্তু অন্যদিকে স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে এসেও এই দেশের চার কোটির বেশি মানুষ দরিদ্র, আর এদের অর্ধেকই হতদরিদ্র (বিস্তারিত পড়ুন)।

স্পষ্টভাবে দেখা যায় এমন রাষ্ট্র আমরা তৈরি করেছি যেখানে রাষ্ট্র ধনীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে দরিদ্রের শোষণ নিশ্চিত করে। অথচ জীবন বাজি রেখে, জীবন দিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা মানুষদের মূল অংশই ছিল দরিদ্র মানুষ। অভাবের তাড়নায় আধপেটা খেয়ে আছেন, কিংবা অনাহারে থাকা মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষা করছেন, এমন খবর পত্রিকায় এসেছে বহুবার।

সরকারি নানা সংস্থা, বাহিনীর হাতে মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা (মাঝারি থেকে ক্রসফায়ার-গুম পর্যন্ত) এতটাই সাধারণ ঘটনা যে এসব এখন আর পত্রিকার খবরও হয় না। আর এই দেশের সাধারণ নাগরিকরা একরকম মেনেই নিয়েছে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণের মধ্যে থেকেই জীবনযাপন করতে হবে। শুধু সরকারই নয়, কেউ যদি ক্ষমতাশালী মানুষ হয়, তাহলে সে দুর্বলের ওপর যাচ্ছেতাই করে পার পেয়ে যায়। 'আইনের হাত অনেক লম্বা' বলে যে কথাটা শোনা যায়, সেটা এই দেশে স্রেফ ফালতু কথা। আইনের হাতের দীর্ঘ গরিব আর ক্ষমতাহীন পর্যন্ত; ওই হাত পৌঁছে না ধনী আর ক্ষমতাশালী পর্যন্ত।

এনজিও'র সামান্য কয়েক হাজার টাকার ঋণ নিয়মিত পরিশোধ করতে না পারা মানুষের চালের টিন, গরু-ছাগল নিয়ে গিয়ে কিস্তি শোধ করা হয়, আর ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দেয়া মানুষ প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হয়। সরকারি দলের একেবারে চনোপুঁটিও এখন কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে নানান ধান্দাবাজি করে। আর প্রতি বছর ৫০/৬০ হাজার কোটি টাকা পাচার করা মানুষরা তো আছেই, যারা নিরাপদ থেকে যায় ক্ষমতার বলয়ের মধ্যেই।

ফিরিস্তিটা আরও অনেক বড় করা যায়। করছি না, এই দেশে থেকে আমরা জানি কম-বেশি সবই। আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে এটা স্পষ্ট, আমাদের স্বাধীনতার সেই তিন মূল উদ্দেশ্য "সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার" স্রেফ কথার কথা হয়েই থাকলো এতগুলো বছর। আর পাল্টাপাল্টি করে ক্ষমতায় থাকা দল দু'টো আমাদের দেশের জনগণের মধ্যে এই বোধ ঢুকতে দিতে চায় না, কারণ এটা হলে তাদের যাচ্ছেতাই করার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে।

এজন্যই স্বাধীনতা/বিজয় দিবস কেন্দ্র করে দারুণ সব জাঁকজমক আর আনুষ্ঠানিকতার ছড়াছড়ি হয় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। ক্ষমতায় থাকা দলগুলো আমাদের এটাই বোঝাতে চায়, যুদ্ধ জয় করে পাকিস্তান থেকে বিযুক্ত হওয়া মানেই আমাদের সর্বোচ্চ অর্জন। তাই এই দিনটিতেই হতে হবে যাবতীয় উৎসব। হ্যাঁ, দিনটি এই দেশের ক্ষমতাশালীদের জন্য বিশেষ দিন তো বটেই, পাকিস্তান থেকে বিযুক্ত না হলে পাকিস্তানিদের চেয়ার দখল করে তাদের মতো লুটপাট করতে পারতেন তারা?

কিন্তু দেশের আপামর জনসাধারণ এই বিজয়ের খুব সামান্য সুফলই পেয়েছে। জনগণ কতোটা সুফল পেয়েছে, সেটা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে, কিন্তু এই তর্ক সম্ভবতঃ থাকবে না, মুক্তিযুদ্ধের সময় দেখা আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশের আশেপাশেও যেতে পারিনি আমরা। তাই তোপধ্বনি, দারুন আলোকসজ্জা, আতশবাজি উৎসব, উচ্চস্বরে দেশাত্মবোধক গান, সামরিক কুচকাওয়াজ, টিভিতে যুদ্ধের নাটক, পত্রিকার বিশেষ ক্রোড়পত্র – সবকিছুর ভীড়ে আমি প্রকৃত বিজয় দেখি না; দুঃখিত, আমার চোখে অপ্রাপ্তির 'ঠুলি'।