ব্লগারদের সাহায্য ও দুর্গত এলাকার সমস্যা

আরিফ হোসেন সাঈদ
Published : 10 July 2012, 08:16 AM
Updated : 10 July 2012, 08:16 AM

গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হওয়া সাম্প্রতিক সময়ে, বাকখালী নদী ঘেঁষা কক্সবাজার শহর ও রামু এলাকায় উজানের পাহাড়ি ঢলে ব্যাপক বন্যা ও নদী ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এতে নদী তীরবর্তী মানুষগুলো তাদের ঘরবাড়ি সহ সবকিছুই হারিয়েছে। কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন জিকু জানান, বাকখালী নদী ঘেঁষা গ্রামগুলোর প্রায় চার হাজার বাড়িঘর ভেঙ্গে গেছে এবং প্রায় এক হাজার ঘরবাড়ি পুরোপুরি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তাই দুর্গত এলাকাগুলোতে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দিতে ব্লগাররা সে এলাকাগুলোতে যায়। গত, ৬ই জুলাই, ২০১২, ব্লগারদের একটি দল কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নে হাজির হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত ৭৫টি পরিবারের কাছে ব্লগারদের সংগ্রহ করা অর্থ ও অন্যান্য ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেয়। অন্যান্য ত্রাণ সহায়তার মধ্যে ছিল শুকনো খাবার, গুড়, মুড়ি, বিস্কিট, ওরস্যালাইন, অন্যান্য ঔষধ, দিয়াশলাই ও মোমবাতি।

জানা গেছে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া ও নাব্যতা হারানোর কারণে প্রায় প্রতি বছরই উজানের পাহাড়ি ঢলে এ আকস্মিক বন্যা সমস্যা দেখা দেয়। জানা গেছে, বাকখালী নদীতে পূর্বে যে বাঁধ ছিল তা সংস্কারের অভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কখনও কখনও জনপ্রতিনিধিরা এই বাঁধগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও তা পূর্ণতা পায়নি যার ফলে তা সুফল বয়ে আনেনি। নদীর তলদেশের দুই-তৃতীয়াংশ পলি জমে ভরাট হয়ে যাবার কারণে সামান্য উজানের ঢলেই এই অঞ্চলগুলোতে এই বন্যা সমস্যা দেখা দেয়। কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন জিকুকে বাঁধের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দেন, 'আমাদের বাকখালী নদীর জন্য বাধটি খুবই দরকার তবে বাঁধ কোন কাজে আসবে না যদি না আমরা ভরাট হয়ে যাওয়া নদীর তলদেশ সংস্কার না করি। একটি পরিকল্পিত ড্রেইজিং ব্যবস্থার খুবই জরুরী।'

তিনি জানান, 'আমি সরকারকে বাকখালী নদী উন্নয়নে একটি প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সরকার যদি সেটি গ্রহণ করে তবে বাকখালী নদী সমস্যা সমাধানে সরকারের কোন টাকা ব্যয় হবে না। শুধু সরকারের অনুমতি প্রয়োজন। বর্তমানে অপরিকল্পিত ড্রেইজিং ও পাহাড় কাটা এ অঞ্চলের জন্য বড় সমস্যা। পানি উন্নয়ন বোর্ডে যদি স্থানগুলো আমাদের চিহ্নিত করে দেয় তবে আমরা তাদের কাজে লাগাতে পারি। এতে সরকারের কোন অর্থ ব্যয় হবে না। পাহাড় কাটা বন্ধ হবে, নদীগুলো সংস্কার হবে আমাদের দুর্ভোগ কমবে এবং প্রচুর লোকের যারা এ কাজের সাথে জড়িত তাদের কর্মসংস্থান হবে। আশা করছি সরকার এ বিষয়টিতে সদয় দৃষ্টি দিবেন।'

কক্সবাজার সদর ইউএনও আমির আবদুল্লাহ মোহাম্মদ মনজুরুল করিম বলেন, 'এলাকার মানুষ ভুলে গেছে শেষ কবে এই নদী খনন করা হয়েছে। বাঁধের চেয়ে নদী খনন করা বেশি জরুরী।'

তিনি জানান, 'এলাকার মানুষের দাবি তাদের ত্রাণ দিতে হবে না। অন্য কোন সাহায্য তাদের চাই না, শুধু নদী খনন করে দেয়া হোক। নদী খনন হলে যেমন ফসল চাষের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হবে তেমনি নদীর মাধ্যমে নদী তীরবর্তী মানুষগুলো তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে।'

নদী খননের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ইউএনও আমির জানান, 'গত বছর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখানে এসেছিলেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড ২২৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প দাখিল করেছে যা একনেক'এ এখনও অনুমোদন হয়নি। এটি অনুমোদন হলে পুরো কক্সবাজারের ৫০-৬০ ভাগ ও কক্সবাজার সদর উপজেলার ৮০-৯০ ভাগ সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীর দু'পারে বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব করেছে।'

তিনি আরও জানান, 'বর্তমানে ঈদগাহ ও মাতামুহুরী নদী দুটিও বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। ঈদগাহ নদীটি সম্পূর্ণ ভরাট হয়ে গেছে।' তিনি বলেন, জনসংখ্যার ঘনত্ব এ অঞ্চলের বর সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, 'ভেতরের কথা হল, এখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন হাত নেই। আসল ব্যাপার হল সমস্যা সমাধান হচ্ছে না কারণ এ এলাকায় যখন সরকার হয় তখন এমপি থাকে না আবার যখন এমপি হয় তখন সরকারের কেউ থাকে না। পুরো রাজনীতির ব্যাপার।'

পশ্চিম মুক্তারকুল, খরুলিয়া গ্রামের ফরিদুল আলম জানান, 'দশ/বার দিন হল বন্যা শুরু হয়েছে। তিনি জানান, তাঁর বাড়িতে তিন দিন বন্যা ছিল। তাঁর নিজের ঘরও বন্যায় ভেঙ্গে গেছে। তিনি জানান, বাকখালী নদীতে প্রায় ১০০ ঘরের মত ভেঙ্গে গেছে এবং ৬০/৭০ ঘর ভেঙ্গে নদীর ভেতর চলে গেছে।'

এ বছর তেমন রোগ বালাই দেখা দেয়নি তবে জ্বর ও বন্যার পানিতে পায়ে চর্ম রোগ দেখা দিয়েছে। এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য যে আশ্রয় কেন্দ্রটি ছিল, সেটিতে আশ্রয় নেয়া সম্ভব হয়নি। কারণ পানিতে সেটির নিচ তলা ডুবে গেছে। এলাকার মানুষ স্থানীয় মায়াবী কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নেয়। এলাকায় বিভিন্ন এনজিও যেমন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ব্র্যাক, কারিতাশ, আশা, আনন্দ, প্রশিকা, বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি, ওয়ার্ল্ড ভিশন, কনসার্ন ও এম.এস.এফ এগুলো থাকলেও তারা সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। জানা যায়, গত বছরও কোন এনজিও তাদের সহায়তায় আগিয়ে আসেনি। জানা গেছে দু'একটি এনজিও কিস্তিতে পরিশোধের শর্তে লোণ দেয়। এলাকার মহিলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি এবারের বন্যায় ভেঙ্গে গেছে। এলাকায় কোন ধরনের বেসরকারি সাহায্য আসেনি। সরকারি সাহায্য বলতে স্থানীয় প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রত্যেককে দু কেজি করে চাল দেওয়া হয়। জানা গেছে এলাকা পরিদর্শনে কোন নেতা, এমপি, মন্ত্রী আসেননি। আমাদের ত্রাণকার্য পরিচালনার সময় কক্সবাজার সদর ইউএনও আমির আবদুল্লাহ মোহাম্মদ মনজুরুল করিম ও ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন জিকু উপস্থিত ছিলেন। তবে এ পর্যন্ত ডিসি এবং এডিসি কেউ দুর্গত এলাকা আসেননি।

এলাকায় খাবার ও দুর্গতদের অর্থ সমস্যা দেখা দিয়েছে।

আরিফ হোসেন সাঈদ, ৭ই জুলাই ২০১২

আরও দেখুন:
বাঁকখালীর বাঁকে বাঁকে ত্রাণ অথবা পরিত্রাণের গল্প
কক্সবাজারের ঝিলংজা ইউনিয়নে ব্লগারদের ত্রাণ সহায়তার কিছু ছবি
বিডিনিউজ ব্লগের ব্লগারদের ত্রাণ কার্যক্রমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত!
বিডি নিউজ ব্লগারদের একটি সফল মিশন !!!
মিশন একমপ্লিশড! ব্লগারদের আন্তরিক অভিনন্দন!

ব্লগাররা যাচ্ছেন দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় ব্লগারদের সাহায্য নিয়ে