আমার আব্বু, আমার হিরো

আসাদুজজেমান
Published : 17 June 2012, 03:36 PM
Updated : 17 June 2012, 03:36 PM

আব্বুকে আমি কখনো লিখিনি, জানিনা আব্বুকে কি করে লিখতে হয়! কি বলে সম্মোধন করতে হয়! আর বিশেষনই বা কি?

প্রিয় আব্বু…..কিম্বা সুপ্রিয় আব্বু…..

বিশেষনেই কেটে দিতে হলো অসংখ্যবার! কারন আব্বুর বিশেষনের প্রয়োজন নেই! আব্বু তো আব্বুই। এ উদ্দাম গতিময়তার যুগে তিনি শুধু লালন কর্তা, পালনকর্তা এবং প্রয়োজনের যোগানদাতাই নয় বরং আরো বড় কিছু……

আমার আব্বু, আমার হিরো। আমার অনুপ্রেরনার আশ্রয়স্থল। আমার আব্বু, আমার পৃথিবী।

মনে পড়ে ছোটবেলায় একবার আব্বুর ঘড়ি হারিয়ে ফেলেছিলাম। আব্বু আমাকে কিছুই বলেননি।

তারপর অনেকদিন তার হাতটা ঘড়িবিহীন ছিলো, হয়তো আর্থিক সীমাবদ্ধতায় কিনতে পারেননি! আব্বুর ঘড়ি বিহীন হাতটি দেখে আমার এতো কষ্ট হতো, তারপর ১৬-১৭ বছর কেটে গেছে, আমি সে কষ্ট বুকে চেপে আজো কোন ঘড়ি হাতে দেইনি।

ও…আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথা যখন আসলোই, তখন বলেই ফেলি- আমাদের পরিবারটা মধ্যবিত্ত। নুন আনতে হয়তো আমাদের পান্তা ফুরায় না! কিন্তু আব্বু এতো বিলাসী, নুন পান্তার জন্য তিনি ব্যবস্থা করেন ইলিশ! তখন হয়তো মধ্যবিত্ত সংসারে নুন পান্তা ইলিশে, থাকেনা পেঁয়াজ মরিচ! আব্বু সেটাও ব্যবস্থা করেন, কিন্তু কিভাবে তা আমি জানি না, আব্বু কখনো জানতেও দেননি।

এমন একটি মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানের জন্য উচ্চ মাধ্যমিকে স্থানীয়(পাবনা) একটি কলেজে পড়াই ছিলো সংগত। কিন্তু আব্বু ছেলের আরো সুন্দর ভবিষৎ নিশ্চিত করতে আমাকে পাঠালেন ঢাকায়, ভর্তি করলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে সেরা কলেজটিতে(নটর ডেম)।

মাসের শুরুতে আমি চাইবার আগেই তিনি ফোন করে জানতে চাইতেন- কত টাকা লাগবে?

টাকা হাতে পাবার পর সব সময় দেখতাম- যা দেবার কথা দিয়েছেন অনেক বেশী। এ নিয়ে ফোনে আব্বুর সে কি মনোমুগ্ধকর অযুহাত-

বই মেলা চলছে, মেলায় যেয়ো ১০০০ টাকা বেশী দিলাম…..

পেপারে দেখলাম, বানিজ্য মেলায় ভালো ব্লেজার পাওয়া যাচ্ছে, ১৫০০ টাকা আলাদা পাঠালাম…কিনে নিয়ো…..

এ মাসে না তোমার জন্মদিন বন্ধুদের সাথে বাহিরে খেয়ো….ইত্যাদি…..ইত্যাদি

আব্বু কাউকে বুঝতে দেননি- আমার বিশাল খরচ, ছোটভাইয়ের লেখাপড়া, সংসার খরচ, নিজের হাত খরচ, সব মিলিয়ে তার আর্থিক অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হতে থাকলো। আব্বু ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। কারো কাছে হাত পাতা কিম্বা ধার দেনা করার মানুষ তিনি নন। তাই প্রয়োজনের তাগিদে আমাদের বসত বাড়ির বাহিরে একমাত্র জমিটি তিনি বিক্রি করে দিলেন। আমাদের আত্বীয় স্বজনেরা তাকে বুঝিয়েছিলো- এক ছেলের পেছনেই সব খরচ করছো? তোমার তো আরেক ছেলে আছে, তার ভবিষৎ এর কথাও ভাবো….

আব্বু সেদিন বলেছিলো- ও যদি মানুষ হয়। আমার আরেক ছেলে আর আমি দুজনেই ওর ছেলেতে পরিনত হবো। তখন এই দুই ছেলেকে ওই দেখবে……..

এ কথা যখন আমি শুনেছিলাম, আমার চোখে পানি চলে এসেছিলো। একজন বাবা তার ছেলেকে কতটুকু ভালোবাসতে পারে, বিশ্বাস করতে পারে…….

অথচ আমার যখন এইচএসসিতে রেজাল্ট খারাপ হলো! আব্বু কষ্ট পেলেও কি আশ্চর্যজনক ভাবেই না নিজের কষ্ট গোপন করলেন! আমাকে বললেন- এমন হতেই পারে, ভালো কোথাও ভর্তির চেষ্টা করো, এ রেজাল্টকে জীবনে প্রভাব পড়তে দিয়ো না…..

ছোটবেলায় যখন বড়শি দিয়ে মাছ ধরতাম। ঘন্টার পর ঘন্টা ফাতনাতে মাছের টোকা ছাড়াই অপেক্ষা করতাম, পরেরদিন আবার বড়শি ফেলতাম। ফিডব্যাক না পেলেও প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতাম। ভাবতাম- মাছ ধরাই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র কাজ যেখানে ফিডব্যাক না পেলেও প্রচেষ্টা চালানো যায়…….

কিন্তু আব্বুকে দেখে বুঝেছি, পিতা হলেন এমন একজন যিনি সন্তানের কাছে আশানুরুপ ফিডব্যাক না পেলেও সন্তানের সুখের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।

আজ বাবা দিবসে, সকালে আব্বুকে ফোন করেছিলাম- কিন্তু বলতে পারিনি আব্বু, আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। তুমিই আমার হিরো, তুমিই আমার পৃথিবী।

তাই লিখতে বসলাম- আব্বুকে আমি কখনো লিখিনি, জানিনা আব্বুকে কি করে লিখতে হয়…….আমি লিখতে পারছিলাম না। অবশেষে কাগজটি ছিঁড়ে শত টুকরা করে ফেললাম!!!

পরক্ষনে ভাবছিলাম, হায়…আব্বু যদি জানতো, তাহলে হয়তো শত টুকরা একে মিলাতো। একটি শব্দই শুধু বোঝা যেত- ভালো থেকো আব্বু।।।

আব্বু সে সময় নিশ্চই হেসে বলতেন- বোকা ছেলে, আব্বুকে কি লেখার কিম্বা বলার প্রয়োজন আছে? আব্বু তো জানেই তার ছেলে তাকে কত ভালোবাসে……